ঢাকা, রবিবার ০৮, সেপ্টেম্বর ২০২৪ ৬:৫৭:৩৪ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
নামছে বন্যার পানি, বাড়ছে নদীভাঙন কুমিল্লায় বন্যায় ১১০০ কিলোমিটার পাকা সড়কের ক্ষতি যে কারণে বাড়ছে চালের দাম গাজায় টিকা কর্মসূচির মধ্যেই ইসরায়েলি হামলা:নিহত ২৭ শুল্ক কমলেও বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে আলু বঙ্গবন্ধু সেতুতে বাস-ট্রাক সংঘর্ষ, ৩ জনের প্রাণহানী

শেখ রাসেলের কথা বলছি: আইরীন নিয়াজী মান্না

আইরীন নিয়াজী মান্না | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৬:৩২ পিএম, ২৫ জুন ২০২৪ মঙ্গলবার

শেখ রাসেল

শেখ রাসেল

জামা-জুতো পড়ে আছে/পরে আছে বই,/ঘর জুড়ে নেই শুধু
তোর হই চই!
ছোট ছোট হাত দুটি/ছোট ছোট কথা,/আজ শুধু তোর মুখে
কী যে নিরবতা!
ছোট ওই বুকে তোর/বিধলো তো গুলি,/সেই কথা কারে কই
কী করে যে ভুলি!

শেখ রাসেলের কথা বলছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে ছোট সন্তান তিনি।

ছোট্ট রাসেলের জগৎ ছিলো বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং ভাই শেখ কামাল ও শেখ জামালকে ঘিরে। তাদের কোলে কোলেই আনন্দ আর আবদারে কেটে যেতে রাসেলের সারাবেলা। ছোট্ট একটি লাল সাইকেল চালাতেন তিনি বাড়ির আঙ্গনায়। ওই ছোট্ট হৃদয়ে নিশ্চয় ছিলো কত স্বপ্ন, ছিলো কত সাধ।  

১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর এক শুভলগ্নে ধানমন্ডির ঐতিহাসিক বঙ্গববন্ধু ভবনে জন্মগ্রহণ করেন রাসেল। রাসেলের যেদিন জন্ম হয় বঙ্গবন্ধু সেদিন ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে প্রচারণায় অংশ নিতে চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন। নতুন শিশুর আগমনে পরিবারের প্রতিটি সদস্যর জন্য দিনটি ছিলো সে কি উৎকণ্ঠা ও আনন্দের। 

এ প্রসঙ্গে শেখ রাসেলের বড় বোন আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বইয়ের এক স্মৃতিচারণে লিখেছেন, ‘রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিল ভীষণ উৎকণ্ঠার। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা চাচা বাসায়। বড় ফুফু ও মেজো ফুফু মার সাথে। একজন ডাক্তার ও নার্সও এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আবার জেগে ওঠে। আমরা ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমন বার্তা শোনার অপেক্ষায়। মেজো ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলেন আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখব। ফুফু বললেন, তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথাভরা ঘন কালো চুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড় সড় হয়েছিল রাসেল।’

বঙ্গবন্ধু নিজের প্রিয় লেখক খ্যাতিমান দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে পরিবারের নতুন সদস্যের নাম রাখলেন ‘রাসেল’। ছোট্ট রাসেল পরিবারের প্রতিটি সদস্যের পরম মমতায় ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে।

বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানার স্মৃতিরোমন্থন করে ডায়েরির পাতায় লিখে রেখেছেন, ‘বাবার কাছে আমাদের ছোট্ট ভাইটির নানা আবদার ছিলো। রাসেলকে আব্বা সব সময় তাঁর কাছে রাখতে চাইতেন। মাঝেমধ্যে ওর সঙ্গে আমার লেগে যেতো, আমি বলতাম, আমি ছোট, ও বলত তুমি আগে ছোট ছিলে, এখন আমি ছোট।’

শেখ রেহানা লিখেছেন, আমাদের সঙ্গে রাসেলেরও জার্মানিতে যাবার কথা ছিল। মা ওকে ছাড়েনি না। সেদিন যদি আসতো তাহলে রাসেলও বেঁচে যেতো। 

১৯৭৫ সালের ২৯ জুলাই পশ্চিম জার্মানিতে থাকা স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী ডঃ এম এ ওয়াজেদের কাছে বেড়াতে যান বঙ্গববন্ধুর বড় মেয়ে শেখ হাসিনা তাঁর দুই শিশুসন্তান সজিব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে নিয়ে। সঙ্গে ছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানা। রাসেলের জ্বর থাকায় মা রাসেলকে যেতে দেননি।
 দশ বছরের ছোট্ট শিশু শেখ রাসেল ছিলেন ভীষণ মানবদরদী, বন্ধুবৎসল। গরিবদের জন্য ছিল তার মায়া-দরদ ও মমতা। তিনি যখন গ্রামের বাড়ি টুঙ্গিপাড়ায় যেতন তখন গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য জামা-কাপড় নিয়ে যেতেন। হাত ভরে তাদের উপহার দিতেন।

শৈশব থেকেই ছোট্ট আদুরে ও প্রাণবন্ত রাসেল ছিলেন পরিবারের সবার অতি আদরের। কিন্তু মাত্র দেড় বছর বয়স থেকেই প্রিয় বাবার সঙ্গে তার দেখা হওয়ার একমাত্র জায়গা হয়ে ওঠে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। বিষয়টি তার ছোট্ট হৃদয়ে বিশাল দাগ কাটে। বাবার দূরে থাকার ব্যাপারটি তার শিশুমনে বেশ কষ্ট দিতো।

আর তাই তো কারাগারে দেখা করতে গেলে রাসেল কিছুতেই বাবাকে ওখানে রেখে আসতে চাইতেন না। বাবাকে একলা রেখে আসার কারণে তার মন খারাপ থাকতো। কারাগারের রোজনামচায় ১৯৬৬ সালের ১৫ জুনের দিনলিপিতে রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না- যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম দূর থেকে পূর্বের মতোই ‘আব্বা আব্বা’ বলে চিৎকার করছে...। ... আমি তাই জানালার পাশে দাঁড়াইয়া ওকে আদর করলাম। একটু পরে ভিতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল। ওরা বলল আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে ‘আব্বার বাড়ি’। এখন ধারণা হয়েছে এটা ওর আব্বার বাড়ি।’

নিজের বাবার বার বার জেলে যাওয়া বা বন্দি হওয়া মোটেও পছন্দ করতেন না শিশু রাসেল, মনে ব্যথা পেতেন। অথচ সাত বছর বয়সে ১৯৭১ সালে তিনি নিজেই বন্দি হয়ে যান। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে রাসেল তার মা ও দুই আপাসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ধানমন্ডি ১৮ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে বন্দি জীবন কাটাতে শুরু করেন। বাবা শেখ মুজিব তখন পাকিস্তনে কারাগারে বন্দি। বড় দুই ভাই শেখ কামাল ও শেখ জামাল চলে গেছেন মুক্তিযুদ্ধে। সে কী দুর্বিসহ বন্দি জীবন কেটেছে ছোট্ট রাসেলের। অত্যন্ত কষ্টকর ছিল তার দিনগুলো। 
তার বন্দিত্ব সম্পর্কে বোন শেখ হাসিনা ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ নিবন্ধে লিখেছেন,‘ছোট্ট রাসেলও বন্দী জীবন যাপন শুরু করে। ঠিকমতো খাবারদাবার নেই। কোনো খেলনা নেই, বইপত্র নেই, কী কষ্টের দিন যে ওর জন্য শুরু হলো। বন্দিখানায় থাকতে আব্বার কোনো খবর আমরা জানি না। কোথায় আছেন, কেমন আছেন, কিছুই জানি না। প্রথমদিকে রাসেল আব্বার জন্য খুব কান্নাকাটি করত। তার ওপর আদরের কামাল ভাইকে পাচ্ছে না, সেটাও ওর জন্য কষ্টকর।’(ইতিহাসের মহানায়ক)।

অবশেষে মা ও দুই আপাসহ পরিবারের সদস্যরা ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর মুক্ত হন। রাসেল ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বাংলা’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। ঘরের বাইরে তখন চলছে সদ্যস্বাধীন দেশে বিজয় উৎসব।

ছোট থেকে বাবা শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগারে দেখতে দেখতে বড় হওয়া রাসেল অজান্তেই চাপা স্বভাবের হয়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে বিষয়ে এক বক্তৃতায় বলেন, ‘খুব চাপা স্বভাবের ছিল। সহজে নিজের কিছু বলত না। তার চোখে যখন পানি, চোখে পানি কেন জানতে চাইলে বলত, চোখে যেন কী পড়েছে। ওইটুকু ছোট বাচ্চা, নিজের মনের ব্যথাটা পর্যন্ত কীভাবে লুকিয়ে রাখতে হয় শিখেছিল।’

স্বাধীন দেশের মাটিতে খুব কী ভালো ছিলেন রাসেল! নিরাপদ ছিলেন? কে জানতো মৃত্যু ওত পেতে আছে জীবনের পরতে পরতে! হায়নারা ধীরে ধীরে প্রস্তুত হচ্ছে এই শিশুকে হত্যা করতে, নির্মূল করতে চাচ্ছে তার বাবাকে যিনি বাঙালিকে এনে দিয়েছেন স্বাধীনতা, দিয়েছেন পরিচয়, দিয়েছেন স্বাধীন রাষ্ট্র! কে জানতো স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় এই শিশুসহ পুরো পরিবারে ওপর নেমে আসবে এক কালো তমাশা।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে দেশি-বিদেশি চক্রান্তে পরিবারের সদস্যদের সাথে শেখ রাসেলকেও হত্যা করা হয়। তখন রাসেল ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের ক্লাস ফোরে পড়তেন।

১৫ আগস্ট খুব ভোরে, তখনও আকাশ তেমন পরিস্কার হয়নি। এসময় একদল তরুণ সেনা কর্মকর্তা ট্যাঙ্ক দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ধানম-ি ৩২ নম্বরের বাসভবনটি ঘিরে ফেলে। নিষ্ঠুর এই কাপুরুষের দল শেখ মুজিব, তার পরিবার এবং তার ব্যক্তিগত কর্মচারিদের সাথে শেখ রাসেলকেও হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে রাসেলকে নিয়ে পালানোর সময় তার ব্যক্তিগত কর্মচারিসহ রাসেলকে এই নিষ্ঠুর হায়নারা আটক করে। আতঙ্কিত হয়ে শিশু রাসেল কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমি মায়ের কাছে যাব’। পরবর্তীতে মায়ের লাশ দেখার পর অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে মিনতি করেছিলেন, ‘আমাকে হাসু আপার (শেখ হাসিনা) কাছে পাঠিয়ে দাও’। 

জাতির পিতার ব্যক্তিগত কর্মচারি এএফএম মহিতুল ইসলামের ভাষ্যমতে, ‘রাসেল  দৌঁড়ে এসে আমাকে জাপটে ধরলো। আমাকে বললো, ভাইয়া আমাকে মারবে না তো? ওর সে কণ্ঠ শুনে আমার চোখ ফেটে পানি এসেছিল। এ সময় একজন ঘাতক এসে আমাকে রাইফেলের বাট দিয়ে ভীষণ মারলো। আমাকে মারতে দেখে রাসেল আমাকে ছেড়ে দিল। ও (শেখ রাসেল) কান্নাকাটি করছিল আর বলছিলো, ‘আমি মায়ের কাছে যাব, আমি মায়ের কাছে যাব’। একজন ঘাতক এসে ওকে বললো, ‘চল, তোকে তোর মায়ের কাছে দিয়ে আসি’। বিশ্বাস করতে পারিনি যে ঘাতকরা এতো নির্মমভাবে ছোট্ট সেই শিশুকেও হত্যা করবে। রাসেলকে ভিতরে নিয়ে গেল এবং তারপর ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করলো এই অবুঝ শিশুটিকে।’


বাবা-মা-ভাই-ভাবি ও অন্যান্য স্বজনদের সাথে শেখ রাসেল চলে গেছেন জীবনের ওপাড়ে। কিন্তু প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ বাংলার ঘরে ঘরে নতুন শিশু হয়ে শেখ রাসেল ফিরে ফিরে আসেন। তিনি বেঁচে আছেন আমাদের মন ও মননে, প্রতিটি বাঙালীর হৃদয়ে-সত্তায়। বাংলাদেশের প্রতিটি শিশুর মুখ যেন আজ শেখ রাসেলেরই মুখ।

লেখক পরিচিতি: আইরীন নিয়াজী মান্না, শিশুসাহিত্যিক ও সাংবাদিক। সম্পাদক-উইমেননিউজ২৪.কম।