ঢাকা, রবিবার ০৮, সেপ্টেম্বর ২০২৪ ৭:০১:৩৫ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
নামছে বন্যার পানি, বাড়ছে নদীভাঙন কুমিল্লায় বন্যায় ১১০০ কিলোমিটার পাকা সড়কের ক্ষতি যে কারণে বাড়ছে চালের দাম গাজায় টিকা কর্মসূচির মধ্যেই ইসরায়েলি হামলা:নিহত ২৭ শুল্ক কমলেও বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে আলু বঙ্গবন্ধু সেতুতে বাস-ট্রাক সংঘর্ষ, ৩ জনের প্রাণহানী

সাংবাদিক সমাজের রাজনীতি নারী সাংবাদিকদের জন্য ক্ষতিকর

মাহমুদা চৌধুরী | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৮:৩৯ পিএম, ৫ জুলাই ২০২৪ শুক্রবার

সিনিয়র সাংবাদিক মাহমুদা চৌধুরী।

সিনিয়র সাংবাদিক মাহমুদা চৌধুরী।

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে অনেক নারী সাংবাদিকতা পেশায় আসছেন। বিশেষ করে দেশটির ক্রমবর্ধমান টেলিভিশন শিল্পে নারীদের উপস্থিতি পুরুষদের চাইতে কোন অংশে কম নয়। কিন্তু মূলধারার সংবাদপত্রগুলোতে নারীরা বলতে গেলে ব্রাত্য হয়েই রয়েছেন। আজ দেশ স্বাধীনের ৫২ বছর পর এসে ফিরে তাকালে দেখা যায়, দেশের সাংবাদিকতায় যে হারে পুরুষ বেড়েছে সেভাবে মেয়েদের সংখ্যা বাড়েনি।

উপমহাদেশের নারী সাংবাদিকতার পথিকৃতি নূরজাহান বেগম:
আজ থেকে প্রায় আট দশক আগে বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় নারীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ থেকে সম্পাদনাসহ সমস্ত যাত্রা শুরু হয়েছিল নূরজাহান বেগমের হাত ধরে।
নিজের বাবা সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরুদ্দীনের সাহচর্যে তিনি যেমন শাণিত হয়েছেন তেমনি বাংলাদেশের অসংখ্য মেয়েকে তিনি নিজের ছায়ায় রেখে করেছেন সমৃদ্ধ। বাংলাদেশ তো বটেই, উপমহাদেশের নারী সাংবাদিকতারও পথিকৃতি ছিলেন নূরজাহান বেগম। বেগম পত্রিকার মধ্য দিয়ে সব মহলে নারীর ভাষ্যকে উপস্থাপন করেছেন নূরজাহান বেগম। তার দেখানো পথে বাংলাদেশে নারী স্বাধীনতার পথ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নারীরা নিজেদের অধিকারের বিষয়ে হয়েছেন সচেতন। গোটা দুইটি প্রজন্ম নূরজাহান বেগম সম্পাদিত বেগম পত্রিকার লেখনী ও পাঠের মধ্য দিয়ে হয়েছে সমৃদ্ধ।

সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরুদ্দীন ও আজকের নারী সাংবাদিক: 
মোহাম্মদ নাসিরুদ্দীন না থাকলে বাংলাদেশের মেয়েরা সত্যি সাংবাদিকতায় আজকের পর্যায়ে আসতে পারতেন না। আর দ্বিতীয়জন হচ্ছে নাঈমুল ইসলাম খান। এই দু’জনকে আমি মনে করি নারীবান্ধব সম্পাদক। যারা নারী সাংবাদিক তৈরি করেছেন। আবার নারীদের যথেষ্ট এগিয়ে নেয়ার জন্য কাজ করেছেন। 
সেই সময়ে মোহাম্মদ নাসিরুদ্দীন সাহিত্যচর্চায় নারীদের নিয়োজিত করেছেন, যথেষ্ট সুযোগ দিয়েছেন। আজকে রিজিয়া রহমান, রাবেয়া খাতুন থেকে শুরু করে ড. নীলিমা ইব্রাহীম প্রত্যেকের লেখা বেগম-এ প্রকাশিত হতো। তার হাত ধরে এদেশে অগণিত নারী সাংবাদিক, লেখক-কবি উঠে এসেছেন। মেধা ও যোগ্যতায় আলোকিত করেছেন এ জগতকে। নাসিরুদ্দীন সাহেব না থাকলে আজ এসব নারী সাংবাদিক বা লেখকদের কেউ জানতে পারত না, চিনতে পারত না। 

সাংবাদিক সমাজের রাজনীতি নারী সাংবাদিকদের জন্য ক্ষতিকর: 
সাংবাদিক সমাজে যে পলিটিক্স কাজ করছে তা আমাদের জন্য বেশি ক্ষতিকর। না হলে, আমরা সাংবাদিকরা বিশেষ করে মেয়েরা সাংবাদিকতায় আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতাম। দিল্লীতে শুধু মেয়ে সাংবাদিকদের জন্য আলাদা  প্রেসক্লাব আছে। পৃথিবীর আর কোনো দেশে আছে কিনা আমার জানা নেই। 
আমরা সাধারণত দেখি, একজন নারী সাংবাদিক অফিস শেষে ঘরে ফিরে যায়। একটা ছেলে কিন্তু অফিস শেষ করেই ঘরে ফেরে না। সে আড্ডা দেয়, সোর্সের কাছে যায়। কোথায় কী হচ্ছে তার খবর নেয়, আলোচনা করে। সবকিছু সে জানতে পারে, তার জনসংযোগটা হয় নিয়মিত। এ কারণে তার সোর্স  তৈরি হয় দ্রুত। নানা কারণে একজন মেয়ে তা করতে পারে না। সংসারের প্রয়োজনে হোক অথবা অন্য কোনো সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে হোক তাকে অফিস শেষে দ্রুত বাড়ি ফিরে যেতে হয়। এজন্য আমার মনে হয়, মেয়েদের জন্য আলাদা প্রেসক্লাব থাকা দরকার। তাহলে তাদের এই আন্তঃযোগাযোগটা সহজ হবে। মেয়েরা সেখানে নিজেদের মত করে সময় কাটাতে পারবে। বিভিন্ন পেশাগত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হলে সে বেশ শাণিত হবে এবং আপ-টু-ডেট থাকবে। 
আমাদের দেশে দেখা যায়, সাংবাদিক সংগঠনগুলোতে নারীসম্পাদক বলে একটা পদ সৃষ্টি করা হয়। শুধু মেয়েরাই এই পদের জন্য লড়াই করে। একটা মেয়ে অন্য মেয়ের পদের বিপরীতে এই একই পদে কেন দাঁড়াব, লড়াই করবে? এখানে তো একটি মেয়েই কনটেস্ট করবে। কোন ছেলে করবে না! নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ের কী দরকার! বিষয়টি আমার কাছে মোস্ট ডিস্ক্রিমিনেশন মনে হয়। মেয়েদের সাথে মেয়েদের লড়াইয়ের এই যে মানসিকতা, এ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে এবং তা খুবই জরুরি। মনে রাখা দরকার, একতা না থাকলে এগিয়ে যাওয়া যাবে না। ভোটের নামে নিজেদের মধ্যে লড়াই করে কোনো ফলপ্রসু ফল লাভ করা যাবে না। এই যে, এখানে একধরণের অস্পষ্ট একটি নেতিবাচক রাজনীতি কাজ করছে তা আমাদের অধিকাংশ নারী সাংবাদিকই বোঝে না, বা বুঝতে চায় না। কিন্তু এই বিষয়টি বুঝতে হবে। এই রাজনীতি যে পুরুষ শাসিত মিডিয়ার তৈরি এই বিষয়টি নারী সাংবাদিকদেও বিশেষভাবে বুঝতে হবে।

নারীবাদী কমলা ভাসিনের কথায় দিনকালে জয়েন করি: সাংবাদিকতা একটি কঠিন জগত। এখানে টিকে থাকতে হয় প্রতিক্ষণ লড়াই করে। আবার একজন নারী সাংবাদিকের লড়াইটা আসলে বহুমাত্রিকি। ১৯৯১ সালে আমি দিনকালে কাজ শুরু করলাম। দিনকাল যে একটা রাজনৈতিক দলের পত্রিকা তাতো বোঝাই যায়। 
আমি ১৯৮৯ সালে জেন্ডার বিষয়ক একটি কোর্স করতে গেছিলাম ভারতে। সেসময় নারীবাদী কমলা ভাসিন দিল্লিতে একটা প্রোগ্রামে আমাকে বলেছিলেন, ‘মাহমুদা, আমি বাংলাদেশে গিয়েছি। তোমাদের দেশের দৈনিক পত্রিকাগুলোতে মেয়েদের নিউজগুলো খুব নেগিটিভ। তোমরা যা লেখ ভীষণ কষ্ট হয়। তোমাদের মেয়ে রিপোর্টার নাই? তুমি দেশে ফিরে চেষ্টা করবে দৈনিক পত্রিকায় রিপোর্টিং করতে।’ 
আমি তার কথাগুলো মন দিয়ে শুনলাম। সত্যি তো! কারণ আমি এমন সব নিউজ পড়েছি যেখানে মেয়েদের খুব অসম্মান করা হয়। এমন কি বিজ্ঞাপনের মধ্যেও দেখেছি মেয়েদের খুব ডিস্ক্রিমিনেশন করা হয়। যেহেতু আমি খুব মনোযোগী পাঠক খুব স্বাভাবিকভাবেই এগুলো আমার চোখে পড়ত। আমি কমলা ভাসিনকে বললাম, ‘আমি অবশ্যই চেষ্টা করব।’ 
এক সময় আমি প্রগতিশীল চিন্তার পত্রিকাগুলোতে চাকরির জন্য খুব চেষ্টা করেছি। কিন্তু অবাক বিষয় হলো, ওসব প্রতিষ্ঠান নারী রিপোর্টার নিতে অনিহা প্রকাশ করেছে বার বার। আমি দৈনিক বাংলায় গেছিলাম, কিন্তু তারাও নিতে চায় নি। কারণ তখন অলরেডি দুজন নারী রিপোর্টার তাদের কাগজে ছিলেন। তখন হাসিনা আশরাফ ছিলেন দৈনিক বাংলায়। তিনি রিপোর্টিংয়ে বাইরে যাবেন না। শুধু প্রেসরিলিজ করবেন। অফিসে বসেই তিনি কাজ করবেন। 
একদিন আমি ওই পত্রিকার চিফ রিপোর্টারের সাথে দেখা করে কাজ করতে চাই জানালাম। তখন তিনি আমাকে বললেন, ‘না না, আমরা আর একটা হাসিনা আশরাফ চাই না।’ 
আমি বললাম, ‘কেন, কী করেছেন হাসিনা আপা?’
তখন তিনি বললেন, ‘উনি তো বাইরে যান না।’ 
সে সময় দৈনিক বাংলায় আরও একজন নারী ছিলেন, তিনি স্টাফ রিপোর্টার ছিলেন। তবে তিনি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় জয়েন করার পর ফিচার লিখতেন। তিনি খুব ভালো লেখেন। তিনিও রিপোর্টিংয়ের চেয়ে ফিচার বেশি লেখেন। 

আমি বিভিন্ন হাউজে ঢুঁ মারলাম, সব জায়গা থেকে আমাকে ডিসকারেজ করা হলো। বাংলার বাণীর সাংবাদিক আকতারুজ্জামান আমাকে একদিন শেখ সেলিমের কাছে নিয়ে গেছিলেন। উনি বললেন, ‘তুমি পত্রিকায় কাজ করতে চাও। ঠিক আছে, ডেস্কে কাজ কর।’  
আমি তো অবাক, আমি আর কোথায় যাব? আমি তো রিপোর্টিং করতে চাই। দৈনিক সংবাদেও বলা হল, ‘ডেস্কে কাজ করো! ডেস্কে মেয়েরা আছে।’ 
আমি বললাম, ‘না বজলু ভাই, আমি কিছুতেই ডেস্কে কাজ করব না। আমার ইচ্ছে আমি রিপোর্টিং করব।’ 

সাংবাদিকতায় মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ায় প্রধান বাধা পুরুষতান্ত্রিকতা: 
পুরুষতান্ত্রিকতা আমাদের মেয়েদের মধ্যেও আছে। পুরুষদের মধ্যে আছে। ছেলেরা এখনও বের হতে পারেনি এর থেকে, মেয়েরা তো নয়ই। তার মধ্যে আর একটা বিষয় যুক্ত আছে, পুঁজিবাদী সমাজের ভোগলিপ্সা। এই বিষয়টি ছেলেদের মধ্যেও আছে মেয়েদের মধ্যেও আছে। আমার মতে, এটা নতুন একটা উপদ্রব। 
একে তো পুরুষতন্ত্র তার উপরে পুঁজিবাদী ভোগবাদ। ভোগবাদ আমাদের নারী সাংবাদিক এবং পুরুষ সাংবাদিক উভয়ের মধ্যেই ভর করেছে। যার ফলে আমরা সেভাবে মেয়েদের আর দেখতে পাচ্ছি না। অন্যরকম ঝলসে ওঠা মেয়ে আমরা পাচ্ছি না। এর জন্য দায়ী মালিক পক্ষ, আর দায়ী মেয়েদের কম পড়াশোনা। আমাদের মেয়েদের নারীবাদের উপর কোন আগ্রহ নেই। জানার এবং শেখার আগ্রহ নেই। তারা জেন্ডারটা বোঝে, কিন্তু নারীবাদটা বোঝে না। আমাদের মেয়েরা যেদিন সত্যিকারের দীক্ষা নেবে সেদিন আমি মনে করি আমাদের মেয়েরা সত্যিকারের মানুষ হবে। আর তখন কোনো সমস্যাই থাকবে না। সাংবাদিকতায় এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে মেয়েরা পথ তৈরি করতে পারবে। 
আমাদের দেশের মিডিয়াগুলোতে নারী সম্পাদক আছেন বেশ কয়েকজন। এদের সবাই সম্পাদক হয়েছেন মালিকানা সূত্রে, সাংবাদিকতা করার সূত্রে নয়। তারা তো পুরুষতন্ত্রের ভাবাদর্শ ধারণ করেই আছেন। তারা অবশ্যই যোগ্য। যদিও সবাই স্বামীর নামে, স্বামীর সহযোগিতায় এগিয়েছেন এ পেশায়। ইত্তেফাকের তাসমিমা হোসেনের স্বামী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। মাহবুবা চৌধুরী মানবজমিনের সম্পাদক, তিনি স্বামীর মাধ্যমে এসেছেন সাংবাদিকতা পেশায়। এ দুজন নারীকে আমরা স্বামীর মাধ্যমে পেয়ে যাচ্ছি। দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক সালমা ইসলাম একইভাবে এসেছেন এ জগতে। কিন্তু লড়াকু নারীদের মধ্যে থেকে যারা মাঠে কাজ করছে এই সব নারীদের কেন আমরা পাচ্ছি না এসব পদে। বাংলাদেশে টিভি সাংবাদিকতার গত দুই-আড়াই যুগের ইতিহাসে নারীদের প্রাধান্য দেখা গেছে মূলত সংবাদ উপস্থাপনায়, সাংবাদিকতা করতে করতে প্রতিষ্ঠানের শীর্ষস্থানীয় পদে আসীন হতে দেখা গেছে শাহানাজ মুন্নী এবং মুন্নী সাহার মতো হাতে গোনা দুয়েকজনকে। উদাহরণ হিসেবে আমরা শুধু এ দুয়েকজনের নামই টানি। কিন্তু আরও মেয়ে কেন বেরিয়ে আসছে না তা নিয়ে কিন্তু আমরা ভাবছি না, কাজ করছি না। সম্পাদক হিসেবে মেয়েদের কেন নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না, মিডিয়া হাউজগুলোর উঁচু পদে কেন যথেষ্ট পরিমাণ মেয়ে সাংবাদিক আজও নেই। এসব বিষয়গুলো ভেবে দেখা এখন খুবই জরুরি এবং সময়ের দাবী। এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করার সময় কিন্তু অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে। 
সাংবাদিকতা একটি দায়িত্বশীল কাজ। জাতিকে এগিয়ে নেয়ার প্রয়োজনে সাংবাদিকরা কাজ করছে। শুধু নারী বলে কেন আমি সুবিধা পাব না? আমারও নানা সুযোগ-সুবিধা পেতে হবে। আমার অধিকারগুলো আমি চাই। আমার একটা আলাদা বাথরুম চাই। আলাদা রেস্টরুম চাই। আমার জন্য পরিবহন ব্যবস্থা চাই। সুষ্ঠু কাজের সুযোগ এবং বেশি বেশি ট্রেনিং চাই। সেইসঙ্গে বিভিন্ন দেশে পেশাগত অ্যাসাইনমেন্টে যাওয়ার সুযোগ পেতে চাই। লিডারশীপের ট্রেনিংগুলোতে মেয়েদের অংশগ্রহণের সুযোগ চাই। একজন তরুণী সাংবাদিক যদি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ পায় তাহলে তার দৃষ্টিভঙ্গি বাড়বে, সমৃদ্ধ ও প্রসারিত হবে তার ভাবনা। নতুন মেয়েদের জন্য এবং পুরনো মেয়েদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ট্যুরে যাওয়ার আলাদা কোটা থাকা দরকার। এর ফলে মেয়েরা কাজের সুযোগ পাবে। আমরা বরাবরই দেখছি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ট্যুরগুলোতে ছেলেদেরই শুধু পাঠানো হয়, মেয়ে সাংবাদিকদের খুব একটা পাঠানো হয় না। কিন্তু এটা ঠিক বিচার নয়। এ ধরনের অ্যাসাইনমেন্টে যাওয়ার জন্য অনেক যোগ্য নারী সাংবাদিক আছে হাউজগুলোতে।

দেশে কত নারী সাংবাদিক আছে তার পরিসংখ্যান নেই:
অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, বাংলাদেশে মোট কত নারী সাংবাদিক আছে তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। আমরা মুখে মুখে বলি এক হাজার বা দেড় হাজার। প্রকৃতঅর্থে কতজন মেয়ে সাংবাদিকতায় আছে তার একটা তালিকা থাকা খুবই দরকার। প্রেস ইনস্টিটিউট এই তালিকা করতে পারে। এই কাজ হতে হবে নিরপেক্ষ এবং বিস্তৃতভাবে। সারা বাংলাদেশের নারী সাংবাদিকদের সে তালিকায় রাখতে হবে। কেউ যেন  বাদ না পরে সে দিকটি বিশেষভাবে নজরে রাখা জরুরি। 
মজার ব্যাপার হচ্ছে, বেশ কিছুদিন আগে প্রেস ইনস্টিটিউট থেকে সাংবাদিক আকতার জাহানের একটা লেখা বেরিয়েছে। সেখানে আমার নাম নেই। বিসিডিজেসি থেকেও একটা তালিকা করা হয়েছে সেখানেও আমার নাম নেই। চারজন মেয়ের নাম দেয়া হয়েছে। জাহ্নবী দাশ, মুন্নী সাহা, পারভীন এবং আর একজন মেয়ে। এই চারজনের নাম আছে। রোজী ফেরদৌস বা হাসিনা আশরাফের নামও আসেনি সেখানে।
আমি সেই কত বছর আগে থেকে রিপোর্টিংয়ে আছি, অথচ আমার নাম আসেনি। এতে আমার কোনো দুঃখ নেই। আমি ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট ছিলাম। ধর্মঘট থেকে শুরু করে রাজনীতি, সিটি কর্পোরেশন, নির্বাচন কমিশন, ক্রাইম রিপোর্ট, অর্থনৈতিক, কৃষি, অনুসন্ধানী রিপোর্ট থেকে শুরু করে সব ধরনের রিপোর্টই আমি করেছি। কিন্তু আমার নামই তারা দেননি!
আমাদের সাংবাদিকদের মধ্যে হীনমন্যতা আমাদের পিছিয়ে রাখছে। আমাদের শত্রু আমরা নিজেরাই, যেমন পুরুষতান্ত্রিকতা আমাদের শত্রু, তেমনি আমাদের পুরুষতান্ত্রিক নারীরাও আমাদের পিছনে টেনে রাখছে। এ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।  

বাংলাদেশের সাংবাদিকতা বনাম বহির্বিশ্বের সাংবাদিকতা: 
টিভিতে সব মেয়েরা অল্প বয়সী সুন্দর মেয়ে থাকতে হবে। বেশ কয়েক বছর আগে বিসিডিজেসি থেকে আমাদের যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে আমরা কয়েকটা টিভি চ্যানেল ভিজিটে যাই। সেখানে বয়স্ক নারীরা খবর পড়ছে। ৭০ ঊর্ধ্ব নারী প্রডাকশন ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বললাম। ৬০-৭০ ঊর্ধ্ব নারীরাও কাজ করছে। তাদের কয়েকজনের সঙ্গেও আমি কথা বললাম। একজন সাংবাদিক আমাকে বললেন, আমি এখন ফ্রি হয়ে কাজ করছি। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে। এখন আর পিছুটান নেই। 
আর আমাদের দেশে সিনিয়র মেয়েদের কোন চান্সই দেয় না। অথচ তাদের দেশে বয়সের কোন বার নেই। 
এ ব্যাপারে এক নারী সাংবাদিক আমাকে বলল, কয়েক দশক আগে আমাদেরও বিভিন্ন বাধা ছিলো। এখানে একজন নারী সাংবাদিককে ইয়ং, গ্ল্যামারার্স হতে হবে। তিন দশক আগে মেয়েরা গণমাধ্যমে কাজ করতে এসে খুব এবিউজ হতো। এখন নিরাপত্তা বাহিনী, পুলিশ নারীদের পক্ষে। মেয়েরা স্বাধীন ও সুন্দরভাবে কাজ করছে। 

এদিকে বাংলাদেশে সরকার প্রধান নারী হওয়া সত্ত্বে এখনও মিডিয়াতে নারী নিপীড়ন বন্ধ হচ্ছে না। আমি যখন মাঠে কাজ করি, তখন অনেক বড় মাপের একজন পুরুষ সাংবাদিক আমাকে একদিন বললেন, ‘মাহমুদা তোমার কি ঘরে মন টেকে না? তুমি এখন ডেস্কে কাজ করো।’ 
আমি বললাম, ‘আপনি একজন কমিউনিস্ট। কমিউনিস্ট হয়ে এসব কি কথা বলছেন?’ 
তিনি বলেন, ‘আসলে কি স্বামীর সঙ্গে তোমার কোন মিলমিশ নাই!’ 
নারী সাংবাদিকদের সহকর্মীরা এভাবেই মূল্যায়ন করে! এই মানসিকতা থেকে আমাদেও মুক্তি কবে হবে তা আমার জানা নেই। আমাদের তো একসময় বলত, রিপোর্টিংটা ম্যান’স জব। আমাকে বলতো ‘তুমি কেন এই পেশায় এসেছ। এটা ম্যান’স জব, সাংবাদিকতা তোমাদের কাজ না।’ 
এত বছর পরও সেই মানসিকিতা কতটুকু বদলেছে, এটাই এখন বড় প্রশ্ন। নানা রকম যুদ্ধ করেও সাংবাদিকতায় টিকে থাকতে পারেননি অনেক মেয়ে। কাজ করতে গিয়ে নারী হিসেবে অসুবিধা এবং চ্যালেঞ্জগুলো এত বেশি যে শেষ পর্যন্ত অনেক মেয়ের পক্ষে সাংবাদিকতায় টেকাটাই কঠিন হয়ে যায়।
বাস্তবতা হলো বাংলাদেশে যেসব নারীরা চ্যালেঞ্জ নিয়ে মাঠের সাংবাদিকতা করতে চান, তাদের মধ্যে ব্যর্থতার গল্পই বেশি। সফলতার গল্প হাতে গোনা দুয়েকটি মাত্র।

শেষ কথা: স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে নারীরা নানাভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন এবং হচ্ছেন। আসলে আজও সাংবাদিকতাটাকে নারীর পেশা বলে মনে করা হয় না। এরকম মনোভাব আমি অনেক পুরুষ সাংবাদিকের মধ্যেই দেখেছি।
গত বিশ বছরে বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়েনি, বরং কোন কোন ক্ষেত্রে কমে গেছে। এখন আর মেয়েরা উৎসাহ নিয়ে সাংবাদিকতায় আসতে চায় না। এর চেয়ে বরং কোনো এনজিওতে বড় বেতনে কাজ করতে আগ্রহী তারা। 

মাহমুদা চৌধুরী: সিনিয়র সাংবাদিক। বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।


(লেখাটি আইরীন নিয়াজী মান্না ও সোমা দেব সম্পাদিত ‘নারী সাংবাদিক: অন্তরায় ও উত্তরণ’ বই থেকে নেওয়া।)