ঢাকা, মঙ্গলবার ২৬, নভেম্বর ২০২৪ ১৫:৪৪:৫২ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
কুমিল্লায় ট্রেনের ধাক্কায় নারীসহ ৫ অটোরিকশা যাত্রী নিহত ভারত থেকে আলু ও পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ, বেড়েছে দাম গ্রীসে অভিবাসীদের নৌকাডুবি: ৬ শিশুর মরদেহ উদ্ধার ১৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় কাঁপছে নীলফামারী বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ, বন্দরগুলোতে সতর্ক সংকেত খালেদা জিয়াকে উমরাহ পালনের আমন্ত্রণ জানাল সৌদি আরব পঞ্চগড়ে জেঁকে বসেছে শীত, তাপমাত্রা নামল ১৩ ডিগ্রিতে

একদিন কেইকো আজুমার মুখোমুখি

প্রবীর বিকাশ সরকার | উইমেননিউজ২৪.কম

আপডেট: ০৭:৪০ পিএম, ২৭ জানুয়ারি ২০১৮ শনিবার

নমস্কার জানিয়ে ফোন করেছিলাম ৩০ জুন ২০১৩ তারিখে বললেন, ‘একটু ব্যস্ত আছি পড়ালেখা নিয়ে। ৪ঠা জুলাই তোচিগি-প্রিফেকচারের উজিয়ে যেতে হবে। সেখানে সাকুরা শহরে কাম্পো-তাগো-রু কাই (কাম্পো-টেগোর সংস্থা) ‘ইনদো.তাগোর-রু তো নো কোওরিউ’ (ভারত.টেগোর মধ্যকার ভাববিনিময়) শীর্ষক একটি আলোচনায় কিছু বলতে হবে আমাকে। তাই পড়ালেখা করছি। নতুন কিছু বলতে হবে তো।’ কাম্পো আরাই (১৮৭৮-১৯৪৫) জাপানের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী যিনি রবীন্দ্রনাথের বন্ধু ছিলেন এবং বিচিত্রায় শিক্ষকতা করেছেন ১৯১৬-১৮ সাল পর্যন্ত। তাঁর দৌহিত্র কাওয়াই ৎসুতোমু এই ‘কাম্পো-আরাই কাই’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। শুধু তাই নয়, রবীন্দ্রনাথের নামে একটি উদ্যানও নির্মাণ করে নগর প্রশাসনকে দান করে দিয়েছেন। এরকম ঘটনা আর কোনো দেশে হয়েছে বলে আমার অন্তত জানা নেই।

 

বাংলাতেই ফোনে অকপট সরল তাঁর উক্তি, ‘রবীন্দ্রনাথকে এখনো পড়ছি।’ বয়স ৭৫, এখনো রবীন্দ্রনাথকে জানার তৃষ্ণা! স্বামী জাপানশীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক, বাংলা ভাষা ও বাঙালিপ্রেমী ‘দেশিকোত্তম’ অধ্যাপক কাজুও আজুমা চলে গেছেন পরপারে ২০১১ সালের ২৮ জুলাই দীর্ঘ বছর নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে। এই বছর তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। আজুমাস্যারবিহীন কেইকো মাদাম কেমন আছেন তাই দেখতে যাওয়া।

 

সেই তরুণকালে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে দুজনের সাক্ষাৎ। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আলোচনা, গবেষণা করতে গিয়ে বাঁধা পড়লেন গভীর বন্ধনে। বলা যায় রবীন্দ্রনাথই তাঁদের বিয়ের ঘটক। ‘বলাকা’ কাব্যগ্রন্থ নিয়ে এমএ পরীক্ষার সন্দর্ভ লিখেছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একাডেমিক গবেষণাও মনে হয় এই প্রথম জাপানে হয়েছিল তিনি সেটা করেছিলেন। সেই কৃতীমানুষটির আসল নাম কেইকো কাসাহারা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে কাজুও আজুমাকে বিয়ে করে হলেন কেইকো আজুমা।

 

৩৬ বছর বয়সে কাজুও আজুমা য়োকোহামা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হন। জার্মানিতে গিয়ে গবেষণা করার আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন সেদেশ থেকে যাননি ততদিনে রবীন্দ্রনাথ এবং বাংলাভাষার প্রেমে হাবুডুবু এবং দুজনেই। চলে গেলেন শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতীর জাপানি বিভাগের অতিথি অধ্যাপক আজুমা। তারপর মাস ছয়েক পর দুই সন্তান নিয়ে সহধর্মিণী কেইকো আজুমা গেলেন স্বামীর কর্মস্থলে। ১৯৬৭ সাল কী উতপ্ত তখন পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতা নকশাল বাড়ি আন্দোলনের কারণে! যত্রতত্র সন্ত্রাস, গুপ্ত হামলা, মানুষ খুন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। তাছাড়া প্রচণ্ড গরম এবং অনিয়ম-অব্যবস্থা তো আছেই! সেসব তোয়াক্কা না করে দুজনেই রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে চলেছেন গ্রন্থ, মানুষ আর প্রকৃতির মধ্যে। বাংলা ভাষার অলিগলি পর্যন্ত হেঁটে চলেছেন অক্লান্ত উদ্যমে। শান্তিনিকেতনের বিরূপ প্রকৃতি, রুদ্ররুক্ষ অনাত্মীয় পরিবেশে এমনভাবে মানিয়ে নিয়েছেন যে সাঁওতালরা পর্যন্ত অবাক! অধ্যাপক আজুমা ছিলেন সাড়ে তিন বছর আর কেইকো আজুমা দেড় বছর। এর মধ্যে তাঁরা বোলপুর, শান্তিনিকেতন তো বটেই সমগ্র কলকাকাতেই পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। বাংলা সঙ্গীত, বাংলা রান্নাসহ বাঙালি সংস্কৃতিকে এমনভাবে আত্মস্থ করেছেন যার তুলনা পাওয়া আজও কঠিন। বলা যায় তাঁরা সম্পূর্ণ বাঙালি হয়ে গিয়েছিলেন। কতবার যে গিয়েছেন কলকাতা, শান্তিনিকেতনে এবং বাংলাদেশে তার হিসেব নেই। কত কাজ, কত গবেষণা রবীন্দ্রনাথ ও বাঙালিকে নিয়ে। আজুমা স্যারের বাসায় বাংলা বইয়ের সংগ্রহই ছিল ১০ হাজারের বেশি।

 

১৯৭১ সালে জাপানে ফিরে এসে কতগুলো প্রকল্প নিয়েছিলেন আজুমা স্যার যার মূলে রয়েছেন কেইকো মাদাম। একান্ত সচিবের চেয়েও বেশি। সেইসব প্রকল্প ছিল জাপানি ভাষায় রবীন্দ্রসাহিত্যের অনুবাদ, শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন ‘জাপান ভবন’ নির্মাণ, বিশ্বভারতীতে জাপানি ছাত্র ও গবেষকদের প্রেরণ, জাপানে রবীন্দ্র সংস্থা গঠন, পুরনো-প্রবীণ জাপানি রবীন্দ্রভক্তদের একত্রীকরণ, জাপানিদেরকে বাংলা শেখানো, আন্তর্জাতিক সাহিত্য সংস্থা গঠন ইত্যাদি। স্বস্তিকর যে সব প্রকল্পই সুসম্পাদন করে গেছেন অধ্যাপক আজুমা। যার সহযোগিতা না থাকলে এতসব সম্ভব হত না তিনি অর্ধাঙ্গিণী কেইকো আজুমা।

 

চারটি ছেলেমেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পাঠানো, ফাঁকে-ফাঁকে খণ্ডকালীন চাকরি, জাপানে আগত অতিথিদেরকে সেবাযত্ন করা, স্বামীর বিপুল গবেষণা দলিলপত্র গোছগাছ করে রাখা, চিঠিপত্রের জবাব তৈরি করা, স্যারের লেখাগুলোর অনুলিপি করা, রবীন্দ্রনাথসহ অন্যান্য বিষয়ে নিজেরও লেখালেখি করা আবার একসঙ্গে জরুরিভিত্তিতে ভারতে যাওয়া কী না করেছেন কেইকো মাদাম, যা ভাবতে গেলে মাথায় ধরে না! একজন নারীর মধ্যে কত শক্তি ভাবলে আশ্চর্য হতেই হয়! অধিকাংশ সময় আজুমা স্যার কলকাতা, দিল্লি না হয় শান্তিনিকেতনে কাজে অবস্থান করেছেন আর এদিকে জাপানে সব একা সামলিয়েছেন কেইকো মাদাম। কোনোদিন তাঁদের মধ্যে সমান্যা ঝগড়া বা মনোমালিন্য হয়নি বলে ঘনিষ্ঠ জনের কাছেই শুনেছি। হাসিমুখে স্বামীর সব আবদার, আদেশ-নির্দেশ মেনে নিয়েছেন হাসিমুখে। ২০০০ সাল থেকে তাঁর স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়েন। ক্রমাগত স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়তে থাকে। কিন্তু স্যারের কাজের ক্ষান্তি নেই আর কেইকো মাদামেরও সেবাশুশ্রুষায় ক্লান্তি নেই। প্রায় অচল স্বামীকে বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়ার জন্য ৫৩ বছর বয়সে গাড়ি চালানোর অনুমোদনপত্র (ড্রাইভিং লাইসেন্স) লাভ করেন। এমনটি এই আধুনিক জাপানেও বিরল ঘটনা।

 

কতদিন তাঁদের সান্নিধ্যে কেটেছে আমার পুরনো কাঠের দ্বিতল বাড়িতে। নিজ হাতে রান্না করে বাঙালি খাবার পরিবেশ করেছেন খ্যাত-অখ্যাত বহু বাঙালিকে। আমিও তাঁদের মধ্যে সৌভাগ্যবান একজন। সম্প্রতি বাড়িটি ভেঙ্গে ফেলে নতুন দালান নির্মাণ করেছেন বড়ছেলে। পাশের একটি ছোট্ট দুকামরার বাসায় কেইকো মাদাম এখন একা থাকেন। স্বামীর স্মৃতি আগলে একাই বার্ধক্য জীবন অতিবাহিত করছেন। এখনো টেগোর তাঁর আরাধ্য দেবতা।

 

৮ জুলাই স্মরণীয় একটি দিন। স্যার লোকান্তরিত হওয়ার পর এই প্রথম কেইকো মাদামের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। বাসায় গেলে আগের মতোই অনাড়াম্বর আতিথেতায় বিমুগ্ধ হলাম। এখানে সেখানে আজুমা স্যারের বই, গবেষণাপত্র, ছবি ছড়িয়েছিটিয়ে আছে। দু-একটি দুর্লভ ছবি ক্যামেরায় তুলে নিলাম।

 

আজুমা স্যারের শেষ কীর্তি কলকাতার সল্টলেকে ২০০৭ সালে উন্মুক্ত ‘ভারত-জাপান সংস্কৃতি কেন্দ্র: রবীন্দ্র-ওকাকুরা ভবন।’ সুদৃশ্যমান এই ভবনটি এখন নানা সমস্যায় জর্জরিত। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি এর কর্ণধার হওয়া সত্ত্বেও মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়ার কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪ বছরের মাথায়। বাঙালির কোনো জিনিসই টিকে না। তাই বাঙালির জন্য কিছু করে লাভও নেই।

 

জিজ্ঞেস করলাম, ‘সেনসেই (স্যার, ম্যাডাম অর্থে) ‘ভারত-জাপান সংস্কৃতি কেন্দ্র’ নিয়ে কিছু ভাবছেন কিনা? আজুমা স্যারের এই মহান কীর্তিটি কী ধ্বংস হয়ে যাবে?’

 

কিছুক্ষণ ভাবলেন তিনি, তারপর বললেন, ‘নীলাঞ্জন এবং অলোকবাবুর কাছ থেকে টেলিফোন পেয়েছি। কিছু একটা করা দরকার। কিন্তু এখন তেমন কেউ নেই যাঁরা এই প্রতিষ্ঠানটি করার সময় জড়িত ছিলেন। জাপান-ভারত রবীন্দ্র সংস্থা এবং পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির যৌথ উদ্যোগে এটা হলেও প্রায় সব টাকাই জাপানের। এভাবে তো একে ধ্বংস করে দেয়া যায় না। প্রাক্তন রিয়োওজিকান (কলকাতার জাপান কনস্যুলেট) নোরো মোতোয়োশি সানের সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি এই প্রতিষ্ঠানটি উদ্বোধন করার সময় কলকাতার জাপান কনস্যুলেট প্রধান ছিলেন। তিনি তো বাংলা আকাদেমি এবং কনস্যুলেটকে এর দায়িত্ব নেয়ার কথা বলে এসেছিলেন। কিন্তু ভালোভাবে চলছে না। কোথাও কোনো ঘাপলা হয়েছে। আমি যাচ্ছি নভেম্বর মাসে। আপনিও তো জড়িত আছেন এর সঙ্গে আমার সঙ্গে যাবেন কি দেখে আসার জন্য?’

 

আমি কিছু বলেনি তখন। কিন্তু ফিরে এসে স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ হলে সে বলল, ‘আজুমা স্যারের স্বপ্ন এবং জাপানিদের অর্থ ও পরিশ্রম যাতে বিফলে না যায় তার জন্য তোমারও চেষ্টা করা প্রয়োজন। এটা দায়িত্বও বটে।’ উল্লেখ্য যে, কেইকো মাদামের কাছে আমার জাপানি স্ত্রী বাংলা ভাষা শিখেছে। তাছাড়া আজুমা স্যারের পরিবারের সঙ্গে আমরা সুদীর্ঘকাল পারিবারিকভাবে ঘনিষ্ঠ। তার কথা ফেলে দেবার মতো নয়।

 

অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে মাদাম কেইকো আজুমাই হচ্ছেন আপাত শেষ প্রবীণ রবীন্দ্রভক্ত যিনি বুকের ভেতরে গুরুদেবকে ধারণ করে এগিয়ে যেতে চান।