ঢাকা, রবিবার ২৪, নভেম্বর ২০২৪ ১৩:৫৭:৪৩ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
মিরপুরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, নারী-শিশুসহ দগ্ধ ৭ ইসরায়েলি হামলায় গাজায় ৩৮, লেবাননে ৩৩ প্রাণহানী প্রথমবার নির্বাচনে অংশ নিয়েই প্রিয়াঙ্কার বাজিমাত বাংলাদেশ সফরে আসতে পারেন ব্রিটিশ রাজা চার্লস আজ ১০ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায় বাংলাদেশ সফরে আসতে পারেন ব্রিটিশ রাজা চার্লস কুড়িগ্রামে বাড়ছে শীতের প্রকোপ, তাপমাত্রা নামল ১৫.৬ ডিগ্রিতে

কন্যাশিশুর প্রতি বৈষম্যের প্রকৃতি ও অধিকার সুরক্ষায় করণীয়

সজীব সরকার | উইমেননিউজ২৪.কম

আপডেট: ০৫:২৭ পিএম, ৭ অক্টোবর ২০১৭ শনিবার

সজীব সরকার

সজীব সরকার

জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মেয়েরা বৈষম্যের শিকার; এমনকি মাতৃগর্ভে বেড়ে ওঠার অধিকার থেকেও কখনো কখনো তারা বঞ্চিত হয়, বিশেষ করে বাংলাদেশ ও ভারতের মতো এশীয় দেশগুলোতে মেয়ে ভ্রুণ হত্যার ঘটনা (female foeticide বা sex selective abortion) এ কথাই প্রমাণ করে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন-এর মতে, জেন্ডার বৈষম্যের কারণে পৃথিবীর অনেক দেশেই নারীর মৃত্যুহার পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি। অর্থাৎ ছোট্ট একটি কন্যাশিশুর পর্যায় থেকে শুরু করে বালিকা, কিশোরী, তরুণী বা নারী- যেভাবেই বলা হোক না কেন নারীরা বৈষম্য আর নিপীড়নের শিকার। আর তাই বৈষম্য ও অধিকারের বেলায় কন্যাশিশু বা নারীকে ঠিক আলাদা করা চলে না। কেননা নারীর ভাগ্যে বঞ্চনা ও নিপীড়নের যে মহীরূহ বোঝা হয়ে ওঠে তার বীজের অঙ্কুরোদগম হয় একেবারে শৈশবেই। তাই প্রয়োজন কন্যাশিশুর অধিকার নিশ্চিত করা।

কন্যাশিশু/নারীর প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতা : নানা ধরন

অমর্ত্য সেন কন্যাশিশুর বিরুদ্ধে বৈষম্যের বড় দুটি ক্ষেত্র হিসেবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে চিহ্নিত করেছেন। তবে সার্বিকভাবে কন্যাশিশু ও নারীর প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতার একটি বৈশ্বিক চরিত্র রয়েছে। একে মূলত এই ৪টি বড় ভাগে দেখানো যায় :

১. শারীরিক : এর মধ্যে রয়েছে চড়/থাপ্পড় বা ঘুষি মারা, আঘাতের উদ্দেশ্যে কোন বস্তু ছুঁড়ে মারা, ধাক্কা দেওয়া, চুল ধরে টানা, গরম কিছু দিয়ে ছ্যাঁকা দেওয়া বা আঘাত করা, অ্যাসিড বা গরম পানি ছুঁড়ে মারা, গলা টিপে ধরা, বৈদ্যুতিক শক দেওয়া, আগুনে পোড়ানো, আগ্নেয়াস্ত্র, ছুরি বা অন্য কোনো ধারালো অস্ত্র দিয়ে ভয়-ভীতি দেখানো বা হুমকি দেওয়া, মারধর করা ইত্যাদি।

২. মানসিক : নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ যেমন- আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না দেওয়া, অহেতুক সন্দেহ করা, চিকিৎসাসেবা নিতে না দেওয়া, হিজাব/বোরকা পরতে বাধ্য করা, পড়াশোনা বা কাজ-কর্মে বাধা দেওয়া, বিনোদনের জন্যে ঘরের বাইরে যেতে না দেওয়া, বাবা-মায়ের উদ্দেশে অশোভন শব্দ ব্যবহার করা, জন্মনিরোধক ব্যবহারে বা ব্যবহার না করতে বাধ্য করা, কন্যাশিশু জন্ম দেওয়ার কারণে দুর্ব্যবহার করা, অপমান করা, আবারো বিয়ে বা তালাকের হুমকি দেওয়া ইত্যাদি।

৩. যৌন : স্বামী কর্তৃক ইচ্ছের বিরুদ্ধে যৌন সম্পর্ক স্থাপন বা এ সময় আঘাত দেওয়া, জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপন, যৌন মিলনের সময় অপমানজনক আচরণ করা বা অন্য কোনোভাবে সহিংস আচরণ করা; স্বামী বা যৌনসঙ্গীর বাইরে অন্য কারো যৌন সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব বা জোর করে যৌন মিলন বা অন্য কোনো ধরনের যৌন আচরণে বাধ্য করা যাতে কোনো মেয়ে বা নারী অপমানিত বোধ করে; শিশুদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন এবং উত্যক্ত করাও এর মধ্যে পড়ে।

৪. অর্থনৈতিক : সংসার খরচ চালানোর জন্যে পর্যাপ্ত অর্থ যোগান দিতে রাজি না হওয়া, হাত-খরচা বা পকেট-মানি না দেওয়া, যৌতুক নেওয়া, বাবা-মায়ের কাছ থেকে অর্থ আদায়ে স্ত্রীকে চাপ দেওয়া ইত্যাদি।

কন্যাশিশুর প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতা প্রতিরোধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানাবিধ আইন রয়েছে। কিন্তু এর পরও কন্যাশিশুরা সুরক্ষা পাচ্ছে না (UN EGM, ২০০৬)। আর দুঃখজনকভাবে, বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার এ মেয়েদের বেশিরভাগেরই পরিবার একে ‘স্বাভাবিক’ ব্যাপার বলে মনে করে। নানা গবেষণা ও কেস স্টাডি থেকে দেখা যায়, জন্ম থেকে শুরু করে কন্যাশিশুরা এসব নেতিবাচক ঘটনার সম্মুখীন হয় এবং শৈশব পেরিয়ে কৈশোর ও যৌবনে পদার্পণের সময়ে ক্রমান্বয়ে এসব বৈষম্য ও সহিংসতা বাড়তে থাকে। আর এসব ঘটনা ঘটে তাদের পরিবারে, স্কুলে ও সংশ্লিষ্ট সমাজে। এই ৩টি ক্ষেত্রেই মেয়েশিশুরা যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় সেগুলোর মধ্যে প্রধান হলো :

  • পরিবার ও এর বাইরে (যেমন : আত্মীয়ের বাসা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়) যৌন নিপীড়ন/ধর্ষণ
  • বাল্যবিবাহ বা পছন্দ/সম্মতির বাইরে জোরপূর্বক বিয়ে
  • শৈশবেই অর্থ রোজগারে বাধ্য হওয়া
  • স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন বা চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হওয়া
  • কন্যাশিশুর শিক্ষা সম্পর্কে বাবা-মা/অভিভাবকের নেতিবাচক মনোভাব
  • পারিবারিক সহিংসতা
  • বাণিজ্যিকভাবে যৌন সম্পর্কে বাধ্য হওয়া
  • শ্রমিক বা যৌনকর্মী হিসেবে পাচার হওয়া
  • বয়ঃপ্রাপ্তির আগেই (শৈশব বা কৈশোরে) গর্ভধারণে বাধ্য হওয়া
  • গৃহকর্মী হিসেবে নির্যাতনের শিকার হওয়া
  • শ্রমের যথাযথ মূল্যায়ন ও মজুরি না পাওয়া

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সমীক্ষায় দেখা যায়, ৮৭ শতাংশ নারী স্বামীর দ্বারা নির্যাতিত হন আর এই নির্যাতনের ৬৬ শতাংশই শারীরিক সহিংসতা। গত ১ বছরে দেশের এক-তৃতীয়াংশ নারীই পরিবারে, কর্মক্ষেত্রে বা রাস্তা-ঘাটে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন; ১ বছরে এর গড় সংখ্যা ১ কোটি ৩০ লাখ। এই নারীরা শারীরিক সহিংসতার পাশাপাশি মানসিকভাবেও নিপীড়িত হয়েছেন।

বৈষম্য ও নিপীড়নের কারণ

বিশ্বজুড়েই কন্যাশিশু তার অধিকার থেকে কম-বেশি বঞ্চিত এমনকি নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে আসছে। এর পেছনে কারণ হিসেবে রয়েছে দারিদ্র্য, সুশিক্ষার অভাব, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার এবং সর্বোপরি সমাজের পুরুষতান্ত্রিক প্রবণতা। লৈঙ্গিক অসমতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আধুনিক সমাজেও তাই মেয়েশিশুরা বেড়ে উঠছে অধিকার বঞ্চিত, নিগৃহীত সমাজের ‘দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক’ হিসেবে। সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাবের পাশাপাশি বঞ্চনা ও নিপীড়নের নানা ঘটনার বিচার না হওয়া এই অবস্থা থেকে উত্তরণের অন্যতম একটি বাধা। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, বিশ্বজুড়েই এই অবস্থা বিরাজ করলেও বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার নারীদের মধ্যে বেশিরভাগই আইনী সহায়তার জন্যে চেষ্টা করেন না কারণ সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলো এসব ঘটনার মাত্রাকে তেমন গুরুত্ব দেয় না।

কন্যাশিশু/নারীর অধিকার : বাংলাদেশের সংবিধান

নারীর প্রতি সহিংসতা আসে সমাজ ও রাষ্ট্রে বিদ্যমান জেন্ডার বৈষম্য থেকে। বাংলাদেশও এ থেকে ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রেই নারী ও পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের যেসব ধারায় বিশেষ করে নারীর অধিকার সংরক্ষণের কথা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বলা হয়েছে সেগুলোর কয়েকটি এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে :

  • ১৭ (ক)। একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
  • ১৯ (১)। সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হবে।
  • ২০। কর্ম হচ্ছে কর্মক্ষম প্রত্যেক নাগরিকের পক্ষে অধিকার, কর্তব্য ও সম্মানের বিষয়, এবং “প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্যতানুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী” - এই নীতির ভিত্তিতে প্রত্যেকে স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করবেন।
  • ২৭। সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী।
  • ২৮ (১)। কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না।
  • ২৮ (২)। রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করবেন।
  • ২৮ (৩)। কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোন বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোন নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাবে না।
  • ২৮ (৪)। নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করবে না।
  • ২৯ (১)। প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকবে।
  • ২৯ (২)। কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাবে না।
  • ২৯ (৩)। এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই
  • (ক) নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশ যাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান প্রণয়ন করা হতে,
  • (খ) কোন ধর্মীয় বা উপ-সম্প্রদায়গত প্রতিষ্ঠানে উক্ত ধর্মাবলম্বী বা উপ-সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিদের জন্য নিয়োগ সংরক্ষণের বিধান-সংবলিত যে কোন আইন কার্যকর করা হতে,
  • (গ) যে শ্রেণীর কর্মের বিশেষ প্রকৃতির জন্য তা নারী বা পুরুষের পক্ষে অনুপযোগী বিবেচিত হয়, সেইরূপ যে কোন শ্রেণীর নিয়োগ বা পদ যথাক্রমে পুরুষ বা নারীর জন্য সংরক্ষণ করা হতে রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করবে না।

এছাড়া বাংলাদেশ নারীর প্রতি বিদ্যমান বৈষম্য ও সহিংসতা প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চুক্তি/সমঝোতা স্মারকেরও অনুস্বাক্ষরকারী বা অংশীদার, যেমন : নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা নিরোধ কনভেনশন বা সিডও (১৯৮৪) এবং বেইজিং প্লাটফর্ম ফর অ্যাকশন বা বিপিএফএ (১৯৯৫)। এর বাইরে বাংলাদেশ সরকার নারীর প্রতি বৈষম্য ও নির্যাতন প্রতিরোধ এবং তাদের আর্থ-সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন আইনী ও নীতিগত কৌশল বা অ্যাকশন প্ল্যানও গ্রহণ করেছে, যেমন : যৌতুক নিরোধ আইন (১৯৮০) - যার আওতায় যৌতুক দেওয়া ও নেওয়াকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে; নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন (২০০০) - যেখানে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নকে আরো স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে; অ্যাসিড অপরাধ প্রতিরোধ আইন (২০০০) ও অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ আইন (২০০০) - যার উদ্দেশ্য হলো অ্যাসিড সন্ত্রাস প্রতিরোধ করা; পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন (২০১০) এবং জাতীয় নারী নীতি (২০১১) - যার লক্ষ্য হলো নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা। এর বাইরেও কন্যাশিশুর শিক্ষা, জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কোটার ব্যবস্থা সুরক্ষায় বিশেষ নিয়ম-নীতি রয়েছে।

কন্যাশিশুর অধিকার সুরক্ষায় করণীয়

শিশুদের অধিকার সুরক্ষায় ১৯৫৪ সালে জাতিসংঘের এক প্রস্তাবে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ‘শিশু দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর পথ ধরে প্রতি বছর ২৯ সেপ্টেম্বর ‘শিশু অধিকার দিবস’ পালিত হয়ে আসছে। কন্যাশিশুর প্রতি বৈষম্যের বিষয়টি তীব্রভাবে প্রতীয়মান হওয়া শুরু করলে তাদের প্রতি এই বৈষম্য ও সহিংসতা প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে ২০০০ সালে বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি সরকারি আদেশের মাধ্যমে শিশু অধিকার সপ্তাহের দ্বিতীয় দিনকে কন্যাশিশু দিবস হিসেবে পালনের উদ্দেশ্যে ৩০ সেপ্টেম্বরকে ‘জাতীয় কন্যাশিশু দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়। এটি একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন। এছাড়া গুটিকয় বেসরকারি সংগঠন শুধু কন্যাশিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছে - এটিও প্রশংসনীয়। তবে আরো প্রতিষ্ঠানকে এ লক্ষ্যে এগিয়ে আসতে হবে।

তবে শুধু কন্যাশিশু নয়, কিশোরী-তরুণী-বৃদ্ধা বা নারী - যেভাবেই বলি, তাদের অধিকার সুরক্ষার প্রথম উপায় হলো বিদ্যমান সমস্যাগুলো যথাযথভাবে চিহ্নিত করা। মনীষীরা বলেন, সমস্যা চিহ্নিত করা গেলেই অর্ধেক সমাধান হয়ে যায়। সে বিচারে বলা যায়, চিহ্নিত সমস্যাগুলোর প্রতিটি আলাদা করে ও ক্ষেত্রবিশেষে সমন্বিতভাবে প্রতিকারের কৌশল প্রণয়ন করে কার্যকর অ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে হবে। দেখা যায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আর্থ-সামাজিক মর্যাদা এবং পরিবার ও এর বাইরে শারীরিক-মানসিক নিরাপত্তা - এগুলো হলো সার্বিকভাবে কন্যাশিশুর বঞ্চনা ও অধিকার - উভয়েরই প্রধান ক্ষেত্র। তাই এই প্রতিটি ক্ষেত্রেই সমান ও আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে। এর বাইরে ক্ষুদ্র পরিসরে এই বিষয়গুলো বিবেচনা করা যেতে পারে :

  • প্রথমত এবং প্রধানত কন্যাশিশুর শিক্ষার ওপর সর্বাত্মক মনোযোগ দিতে হবে কেননা শিক্ষাই হলো যে-কোনো ধরনের বৈষম্য ও অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের সর্বোত্তম উপায়। সারা বিশ্বে যতো শিশু শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত, তার প্রায় ৬০ শতাংশই মেয়ে। এজন্যে প্রাথমিক শিক্ষায় মেয়েদের অন্তর্ভুক্তির উচ্চহার নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের ঝরে পড়াও রোধ করতে হবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে মেয়েদের অন্তর্ভুক্তি ও পরীক্ষায় সাফল্যের হার তুলনামূলকভাবে বেশি হলেও উচ্চশিক্ষার পর্যায়ে এসে সেটি অনেকাংশেই কমে যায়। প্রাথমিক শিক্ষায় মেয়েদের অন্তর্ভুক্তির হার বর্তমানে প্রায় ৮৭.৮ শতাংশ; উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও মেয়েদের প্রবেশগম্যতা বাড়ানোর জন্যে সম্ভাব্য সব ব্যবস্থাই গ্রহণ করতে হবে।
  • বাল্যবিয়ে বা ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে বিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতি থেকে কন্যাশিশুদের সুরক্ষা দিতে হবে। এ বিষয়ে সরকারের সাম্প্রতিক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত (বা সিদ্ধান্তহীনতা!) কাটিয়ে উঠে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাল্যবিয়েকে বিশেষজ্ঞরা নারীর প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতার অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করেন। নারীর ক্ষমতায়ন ও লৈঙ্গিক সমতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করেন ক্রিস্টিন হান্টার। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, নারী-পুরুষ সমতা অর্জনে বড় বাধা বাল্যবিবাহ। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা যায়, দেশের ৬৮ শতাংশ নারীই বাল্যবিয়ের শিকার। আর এসব মেয়ের মাত্র ৭ শতাংশ বিয়ের পরে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে। বাকি ৯৩ শতাংশই স্বামী ও সংসারের সেবায় মনোযোগ দিতে বাধ্য হয় এমনকি শিশু মা-এ পরিণত হয়। বাংলাদেশ সরকারের ২০১১ সালের সর্বশেষ বাংলাদেশ জনমিতি স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) মতে, ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই প্রায় ৭০ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়। ১৯ বছরের মধ্যে প্রতি ৩ জনের ১ জন কিশোরী গর্ভধারণ করে বা সন্তানের জন্ম দেয়। প্রতি ৫ জনে একজন মা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায় যার মধ্যে কিশোরী মায়ের সংখ্যাই বেশি। এরাই পরে সন্তান জন্মদানকালে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। যারা বেঁচে যায় তারা বাকি জীবন অসুস্থ, দুর্বল ও রোগাক্রান্ত শরীর-মন নিয়ে কোনোক্রমে বেঁচে-বর্তে থাকে। ফলে মেয়ে বা নারীদের নিজেদের জীবনের যেমন পূর্ণাঙ্গ বিকাশ হয় না তেমনি অপুষ্টির শিকার সন্তান জন্ম দেওয়ার কারণে দেশও বঞ্চিত হয় সুস্থ-সবল ভবিষ্যত প্রজন্ম প্রাপ্তির সুযোগ থেকে। এই তথ্য মাথায় রেখে বাল্যবিবাহ ও অপরিণত বয়সে গর্ভধারণ রোধের পাশাপাশি যৌতুকের কারণে যেন তারা নির্যাতনের শিকার না হয় সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।
  • প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো পরিস্থিতিতে শিশু ও নারীরা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার মধ্যে থাকে। তাই দুর্যোগ মোকাবেলার ব্যবস্থা গ্রহণের সময় বিষয়টি অবশ্যই আলাদা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে।
  • সারা বিশ্বে সমন্বিতভাবে প্রতি ৩ জন মেয়ে বা নারীর মধ্যে ১ জন শৈশব থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে সহিংসতা বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। বিষয়টিকে অবশ্যই গুরুত্বের সাথে নিতে হবে এবং পরিবার-পরিজনসহ সবাইকেই এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
  • শিশুদের মধ্যে কন্যাশিশুর পাচার হওয়ার ঝুঁকি বিশ্বজুড়েই বেশি। এই বিষয়টি বিবেচনায় রেখে কন্যাশিশুদের সুরক্ষায় বিশেষ যত্নশীল হওয়া দরকার।
  • উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন নারী খর্বকায় বা অন্য কোনোভাবে শারীরিক দুর্বলতার শিকার। এর প্রধান কারণ হলো কন্যাশিশু হিসেবে জন্ম নেওয়ার কারণে তারা শৈশবে অপুষ্টিতে ভুগেছে। তাই কন্যাশিশুর পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এজন্যে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি পরিবারের অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে।
  • সার্বিকভাবে কন্যাশিশুর প্রতি বৈষম্যমূলক মনোভাব ও আচরণ নির্মূল করতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রের মানসিকতা পরিবর্তন না করে শুধু মেয়েদের শিক্ষিত করে তুললেই সমস্যার সমাধান হবে না।
  • মেয়েদের নিয়ে সামাজিক ও ধর্মীয় নানাবিধ কুসংস্কার রয়েছে যা পরিবার ও সমাজে তাদের হেয় প্রতিপন্ন এমনকি কখনো কখনো ‘অস্পৃশ্য’ করে তোলে। এসব ভুল ধারণা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে হবে।
  • কর্মক্ষেত্রে কন্যাশিশু ও নারীর প্রতি নিপীড়ন ও বৈষম্য নির্মূল করার পদক্ষেপ নিতে হবে। পারিশ্রমিকবিহীন শ্রমে নিয়োজিতদের ৯০ শতাংশই নারী; আবার পুরুষের সমান কাজ করেও কম মজুরি পাচ্ছেন নারীরা। এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো দরকার। তাছাড়া নারীদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির জন্যে প্রশিক্ষণের সুযোগ একেবারেই কম; এদিক থেকেও নারীর জন্যে পর্যাপ্ত সুযোগ তৈরি করতে হবে।
  • ক্রিস্টিন হান্টার পূর্বোক্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, আইনী, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে নারীদের সমমর্যাদা দেওয়া হচ্ছে না। এ অবস্থার পরিবর্তন জরুরি।
  • সবার আগে পরিবারে কন্যাশিশুর সম্মানজনক ও গ্রহণযোগ্য অবস্থান তৈরি করতে হবে।
  • সর্বোপরি, সুযোগ পেলে একটি কন্যাশিশুও যে ছেলেশিশুর মতোই সুযোগ্য সন্তান ও নাগরিক হয়ে বেড়ে উঠতে পারে- এটি সমাজের সর্বত্র অনুধাবন করতে হবে।

পরিশেষে

বাংলাদেশের বিভিন্ন বয়সের প্রায় ১ কোটি ৬৮ লাখ নারী অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুক্ত রয়েছে। অর্থনীতির স্থায়ী ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে কর্মরতদের প্রায় ৪০ শতাংশের বেশি নারী। রাজনীতিতেও নারীর অবদান আজ অনস্বীকার্য; ২০১৪ সালের ৩-৫ নভেম্বর মেক্সিকোতে 5th Global Forum on Gender Statistics-G ‘Measuring Gender-based violence: Results of the Violence Against Women (VAW) Survey in Bangladesh’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয় সংসদের ২০ শতাংশ নারী সংসদ সদস্য। ৪৯ জন মন্ত্রীর মধ্যে নারীর অধীনে রয়েছে ৮.১৬ শতাংশ। প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেতার পদে নারী আসীন রয়েছেন বিগত দুই দশক ধরে। বর্তমান সংসদের স্পিকার একজন নারী। স্থানীয় সরকার আইনের (১৯৯৭) আওতায় সরাসরি নির্বাচনে নারীর জন্যে ৩টি আসন বরাদ্দ রয়েছে। স্থানীয় সরকারের অন্যান্য পর্যায়েও (যেমন : কাউন্সিলর) নারীদের জন্যে বিশেষ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। শিক্ষা, চিকিৎসা বা স্বাস্থ্য, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ যে-কোনো ক্ষেত্রে সব পর্যায়েই নারীরা তাদের অবদান রাখছেন। তাই ‘মেয়েরা দুর্বল’ বা ‘মেয়েরা পারবে না’ - এমন পুরনো ধ্যান-ধারণা আজ আর লালন করার বা অজুহাত হিসেবে দেখানোর কোনো সুযোগ নেই।

শিশুরাই একটি জাতির ভবিষ্যত কর্ণধার; তাই শিশুমাত্রেরই বৈষম্য-বিদ্বেষহীন একটি সৃজনশীল পরিবেশ প্রাপ্য। যেহেতু কন্যাশিশুরা এদেশে তুলনামূলকভাবে কম সুবিধাপ্রাপ্ত তাই তাদের প্রতি বিশেষ যত্নশীল হওয়া পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তব্য। International Conference on Population and Development in Cairo (1994), Declaration of the World Summit for Children (1990), Beijing Platform for Action of the Fourth World Conference on Women (1995), 1989 Convention on the Rights of the Child (CRC), Millennium Declaration leading to the Millenium Development Goals (MDGs) (2000) Ges 1979 Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination against Women (CEDAW)- সর্বত্রই বৈশ্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বৈষম্য নিরসনকল্পে পৃথিবীর নানা দেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। এসব প্রতিশ্রুতিতে শিশুদের বেলাতেও বৈষম্য না করে ছেলেশিশুর পাশাপাশি কন্যাশিশুদেরকেও যথাযথভাবে মূলধারায় নিয়ে এসে বৈষম্য কমিয়ে সমতার ভিত্তিতে একটি বিশ্ব গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। অনেক দেশই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আইন-কানুনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তাদের দেশের নিজস্ব আইনে জেন্ডার সমতা নিশ্চিত করার অনুকূলে বিভিন্ন ধারা-উপধারায় পরিবর্তন-পরিবর্ধন সাধন করেছে। বাংলাদেশ সরকারও এমন অনেক প্রতিশ্রুতির সমান অংশীদার। এখনই সময় সেসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে যথাযথ ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়ার। 

তবে একথা ভুললে চলবে না, সরকারের একার পক্ষে এই পরিবর্তন সাধন করা সম্ভব নয়। এজন্যে সরকারের পাশাপাশি যে বেসরকারি উদ্যোগগুলো রয়েছে তাদেরও ভূমিকা আরো জোরালো হতে হবে। পাশাপাশি, ব্যক্তি ও পরিবার থেকেই এই পরিবর্তন শুরুর মূল ভূমিকাটি পালন করতে হবে। দেশের গণমাধ্যমগুলোরও উচিত হবে বিশেষ করে কন্যাশিশুসহ সব শিশুর অধিকার সংরক্ষণ এবং সার্বিক বিকাশ নিশ্চিত করার মতো শিশুবান্ধব একটি সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা; এ লক্ষ্যে প্রয়োজনে সবগুলো গণমাধ্যমে শিশুবিষয়ক আলাদা ‘বিট’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টাই পারে কন্যাশিশুসহ সব শিশুর ভবিষ্যত পথ সুন্দর ও মসৃণ করতে। আমাদের সবার কাম্য সেই সমাজের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে অচিরেই। সে প্রত্যাশাই রইলো!

 

লেখক: সজীব সরকার, সহকারি অধ্যাপক; জার্নালিজম, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ; স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।

ইমেইল : [email protected]