ঢাকা, সোমবার ১৮, নভেম্বর ২০২৪ ২:৫০:১৫ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
বাংলাদেশি নারী উদ্যোক্তাদের সহায়তা দেবে যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষেই নির্বাচন: ড. ইউনূস বাহাত্তরেও সুরের জাদু ছড়াচ্ছেন রুনা লায়লা ড. ইউনূসের ভিশনের দিকে তাকিয়ে যুক্তরাজ্য: ক্যাথরিন ওয়েস্ট লাফিয়ে বাড়া স্বর্ণের দামে হঠাৎ পতন, জানা গেল কারণ

গন্তব্য সবুজে ঘেরা সেন্ট্রাল পার্ক

আইরীন নিয়াজী মান্না | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১০:২৩ এএম, ২৮ অক্টোবর ২০২১ বৃহস্পতিবার

সেন্ট্রাল পার্ক

সেন্ট্রাল পার্ক

নিউ ইয়র্কে এখন পাতা ঝরার সময়। সবুজ পাতায় হলুদ রঙ ধরেছে। পথে পথে পড়ে আছে মনোরম সব রঙিন পাতা। বাতাসের ঝিরিঝিরি শব্দ মনে করিয়ে দেয় রিচার্ড গিয়ারের সেই বিখ্যাত মুভি ‘অটাম ইন নিউ ইয়র্ক’-এর কথা। এখানে যদিও এখন শরৎকাল নয়, হেমন্তকাল। শীত আসছে। তারপরও পরিবেশে শরৎকালের ভাব যেন রয়ে গেছে। এ আবহাওয়া আমি বেশ উপভোগ করছি।

যেকোনো দেশে বা শহরে গেলে আমি অন্যান্য সব কিছুর পাশাপাশি সেখানকার পার্কগুলো ঘুরে দেখতে খুব পছন্দ করি। নিউ ইয়র্কে আগেও এসেছি। এ শহরের অনেক পার্ক আমি দেখেছি। তবে আমার মূল আকর্ষণ সেন্ট্রাল পার্ক। বিশাল এ পার্ক দুয়েক দিনে দেখে শেষ করা সম্ভব নয়। তাই যাই বার বার…।

সেন্ট্রাল পার্ক নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনে। পাথুরে মহানগরীর মাঝে এক সুবিশাল সবুজ উদ্যান। উদ্যানটি ম্যানহাটনের আপার ওয়েস্ট সাইড ও আপার ইস্ট সাইড এলাকার একদম মাঝখানে। এই সবুজ-শ্যামল-মনোরম পার্কের আয়তন ৮৪৩ একর।

এ উদ্যানের জন্য ১৮৫৩ সালে প্রথম ভূমি কেনা হয়। ১৮৫৭ সালে পার্ক ৭৭৮ একর (৩১৫ হেক্টর) জমি অধিগ্রহণ করে প্রাথমিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

পরে ‘গ্রিনসওয়ার্ড প্ল্যান’ প্রকল্পের আওতায় পার্কটিকে উন্নত এবং প্রসারিত করার জন্য একটি নকশা প্রতিযোগিতা আহবান করা হয়। এ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হন ভূ-প্রাকৃতিক পরিকল্পনাবিদ ফ্রেডেরিক ল্য ওল্মস্টেড এবং স্থাপত্যবিদ ডিজাইনার ক্যালভার্ট ভক্স।

৮৪৩ একরের একখন্ড ভূমিতে একটি আকর্ষণীয় পার্ক গড়তে তারা তাদের কল্পনা, মেধা এবং অক্লান্ত পরিশ্রম ঢেলে দেন। যার ফলস্বরূপ আজকের জগৎ বিখ্যাত ত্রিমাত্রিক এই পার্ক। এই পার্কের সংস্কার কাজ শুরু হয়েছিল ১৮৫৮ সালে। একই বছর শীতকালে জনসাধারণের জন্য তা খুলে দেয়া হয়।  

সেন্ট্রাল পার্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় নগর উদ্যান। পৃথিবীর বৃহত্তম পার্কের মধ্যে অন্যতম ও আকর্ষণীয় পার্ক। দেশ-বিদেশ থেকে প্রতি বছর এখানে প্রায় ৪ কোটি লোক বেড়াতে আসেন। এখানে বেশ কিছু মার্কিন ও বিদেশী সিনেমার স্যুটিং করা হয়েছে। হাজার হাজার বিখ্যাত বিজ্ঞাপনেরও স্যুটিং করা হয়েছে এই পার্কে।

এই পার্কের পূর্বদিকে ফিফথ অ্যাভিনিউ, পশ্চিমে এইথ অ্যাভিনিউ, দক্ষিণে ফিফটি-নাইনথ স্ট্রিট এবং উত্তরে হানড্রেড অ্যান্ড টেনথ স্ট্রিট। 

সেন্ট্রাল পার্কে প্রবেশ করার জন্য ২০টি গেইট রয়েছে। প্রবেশ মূল্য ফ্রি। তবে চিড়িয়াখানা, হর্স আ্যন্ড ক্যারেজ, বাইক, ভেশপা, পেডিক্যাব প্রভৃতির জন্য আলাদা আলাদা টিকিট করতে হয়। 
সেন্ট্রাল পার্কের মূল আকর্ষণ ঘোড়ার গাড়ি। ঘোড়ার গাড়িগুলো মনে করিয়ে দেয় আমাদের পুরানো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার গাড়ির কথা। যে কেউ একটু রাজকীয় স্টাইলে পার্কটি ঘুরে দেখতে চাইলে ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করতে পারেন। 

এ ছাড়া সেন্ট্রাল পার্কে গিয়ে আপনি রিক্সায় চড়ার আনন্দও পেতে পারেন। রিক্সাগুলো অনেকটা আমাদের দেশের টয়োটা রিক্সার আদলে তৈরি। সাইকেল ভাড়া করেও, যে কেউ মনের আনন্দে ঘুড়ে বেড়াতে পারবেন পার্কজুড়ে। লেকে নৌবিহারে নেমে যেতে চাইলেও, বাধা নেই।    

পার্কটি কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। পার্কের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন সব ভাস্কর্য। ২৯টি ফাউন্টেনসহ ৪৮টি মনুমেন্ট। আরও রয়েছে পঁচিশ হাজারের বেশি গাছগাছালি। এখানে সেখানে সুবিশাল পাথরের ঢিপিগুলো কয়েকশ বছরের পুরোন বলে মনে করা হয়।

প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করা ছাড়াও সেন্ট্রাল পার্কে সময় কাটানোর নানা রকম ব্যবস্থা আছে। এর মধ্যে রয়েছে পদভ্রমণ, আইস-স্কেটিং, ঘোড়ায় চড়া, বাই-সাইকেল, রোলার ব্লেডিং এবং আরোও অনেক কিছু।

জনসাধারণ ঘুরে বেড়ানোর জন্য উদ্যানটিতে বেশ কিছু নির্মল-শান্ত জায়গা আছে; ইষ্ট গ্রীন, স্ট্রবেরী ফিল্ড, শেক্সপীয়ার গার্ডেন, সীপ মেডো, টার্টেল পন্ড ও কনসার্ভেটরী গার্ডেন। এছাড়াও লেকে মনোমুগ্ধকর নৌকা-বিহার করা যায়। লোয়েব বোটহউস থেকে নৌকা ভাড়া নেওয়ার সুবিধা রয়েছে।

সেন্ট্রাল পার্কে প্রায় ২১টি শিশু উদ্যান ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। শিশুদের বিনোদনের জন্য রয়েছে চিড়িয়াখানা, কেরৌসেল, বেলভেডেয়ার ক্যাস্টেল-এ জল প্রদর্শনী।

এ উদ্যানে বছরব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়। এর মধ্যে আছে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সঙ্গীতানুষ্ঠান, শিক্ষা ভ্রমণ থেকে শুরু করে নানা মৌসুমি কার্যক্রম। উদ্যানটিতে স্থায়ী শেক্সপীয়ার মঞ্চ রয়েছে। এই মঞ্চে জগৎ বিখ্যাত এই নাট্যকার ও লেখকের নাটক ও বিভিন্ন অবদান উপস্থাপন করা হয়। এছাড়াও এ উদ্যানে গ্রীষ্মকালীন মঞ্চে নানা অনুষ্ঠান হয়। নিউ ইয়র্ক অপেরা এখানে প্রদর্শনী করে। বৃটিশ সঙ্গীতশিল্পী স্যার এলটন জন, পল সিম্পশন আরও অনেকে নানা সময় এখানে সঙ্গিত পরিবেশ করেছেন। এ ছাড়া অন্যান্য প্রসিদ্ধ সঙ্গীতবিদদের অনুষ্ঠান হয় নিয়মিত।

শীতকালে সেন্ট্রাল পার্কের আইস-স্কেটিং রিঙ্ক-এ যে কেউ স্কেটিং উপভোগ করতে পারেন। নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করা যায়। উপভোগ করা যায় সঙ্গীত ও গ্ল্যাইডিং।

সেন্ট্রাল পার্কের অন্যতম আকর্ষণ এখানকার জলাধারগুলো (লেক)। ছোট-বড় সবমিলিয়ে সাতটি জলাধার রয়েছে এখানে। সবগুলো জলাধারই কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে। সবচেয়ে বড় জলাধার হলো ‘জ্যাকলিন কেনেডি ওনাসিস রিজার্ভর’। আমেরিকার ৩৫ তম প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির স্ত্রী জ্যাকলিন কেনেডির স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে এই জলাধারটির নামকরণ করা হয়। জ্যাকলিন দীর্ঘদিন ফিফথ এভিনিউতে বসবাস করেছেন। আজীবন তিনি প্রাতভ্রমণ করেছেন এই লেকের চারপাশে। জানা মতে, সেন্ট্রাল পার্ক রক্ষনাবেক্ষণেও তার বিশেষ অবদান রয়েছে।

‘জ্যাকলিন কেনেডি ওনাসিস রিজার্ভর’ বা জলাধারটি ১৮৫৮ থেকে ১৮৬২ সালে নির্মান করা হয়। ৮৬তম এবং ৯৬ তম রাস্তার মধ্যে ১০৬ একর (৪৩ হেক্টর) এলাকা জুড়ে রয়েছে এই জলাধার। এর চারদিকে হাঁটার রাস্তায় সারি সারি চেরি গাছ চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। ওখানে গেলেই চোখে পড়ে অনেকেই জগিং করছে; দৌড়াচ্ছে, পানির মাঝখানে একটা দৃষ্টিনন্দন ফোয়ারার পানি উচ্চ বেগে নিচে থেকে উপর দিকে যাচ্ছে। আবার নিচে আঁচড়ে পড়ছে যা সত্যিই মনমুগ্ধ ।

আর একটি সুন্দর জলাধার হলো কনজারভেটিভ ওয়াটার। এর পাশেই এলিস ইন দ্যা ওয়াল্ডল্যান্ডের সেই বিখ্যাত এলিসের মনোমুগ্ধকর একটি ভাস্কর্য। এগারো ফুট উঁচু বোঞ্জের ভাস্কর্য এটি। এলিস ইন দ্যা ওয়াল্ডল্যান্ড ৭৪ স্ট্রিটের পাশেই অবস্থিত। জায়গাটার শান্ত পরিবেশ এবং পানিতে ভেসে বেড়ানো হাঁসের দল সকলকে মুগ্ধ করে।

১৯৬৩ সালে মার্কিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উদ্যানটিকে ‘জাতীয় ঐতিহাসিক স্থাপনা’ ঘোষণা করে। ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলির তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করেছে এই পার্ক। বর্তমানে কনজার্ভেন্সি নামের একটি বেসরকারী-সরকারী যৌথ প্রকল্প উদ্যানটির দেখাশোনা করে। এ কাজে বছরে ৬ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার ব্যয় হয়।

সারা বছর ধরে সেন্ট্রাল পার্ক পরিদর্শনে যেতে পারেন আপনি। তবে যেহেতু মে মাসে এখানকার আবহাওয়া বেশ মনোরম থাকে তাই এই সময় উদ্যানটি পরিদর্শনের সেরা সময়। এছাড়া সামারে প্রচুর লোকের ভিড় হয় এ উদ্যানে। তবে এই জণাকীর্ণতা আপনাকে অসন্তুষ্ট করবে না। বরং বেশ ভালোই লাগবে। কিছু কিছু মানুষ অক্টোবর মাসও এখানে আসার জন্য সেরা বলে মনে করেন। কারণ এসময় দিনের বেলায় উষ্ণ থাকে এবং রাতে শীত অনুভূত হয়। তাছাড়া এসময় গাছের পাতা রঙ পরিবর্তন করে। দেখতে বেশ লাগে। 

পার্কের গেইটগুলো আশেপাশে রয়েছে হরেক রকম খাবারের দোকান। ফুটপাতে রয়েছে, বাহারি পণ্যের পসরা। টং দোকানে সাজিয়ে রাখা পেইন্টিংগুলো দৃষ্টি কেড়ে নেয়।  

শহরের যেকোনো প্রান্ত থেকে বেশ সহজে সেন্ট্রাল পার্কে যাওয়া যায়। এ পার্ককে ঘিরে বেশ কিছু পাতাল রেল স্টপেজ আছে। সুতরাং আপনি ট্রেনে করে সহজেই এ উদ্যানে যেতে পারেন। এছাড়াও পেন স্টেশন বা গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে বাসও ধরতে পারেন।

সেন্ট্রাল পার্ক সারাবছরই দর্শকদের জন্য খোলা থাকে। এটি প্রতিদিন শুধুমাত্র রাত ১টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত পাঁচ ঘন্টা বন্ধ থাকে। সুতরাং যে কোনো সময় আপনি সেন্ট্রাল পার্ক ঘুরতে যেতে পারেন। 

জামাইকা, নিউ ইয়র্ক
২৮.১০.২০২১