ঢাকা, রবিবার ২৪, নভেম্বর ২০২৪ ১৭:১৮:৩৪ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
মিরপুরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, নারী-শিশুসহ দগ্ধ ৭ ইসরায়েলি হামলায় গাজায় ৩৮, লেবাননে ৩৩ প্রাণহানী প্রথমবার নির্বাচনে অংশ নিয়েই প্রিয়াঙ্কার বাজিমাত বাংলাদেশ সফরে আসতে পারেন ব্রিটিশ রাজা চার্লস আজ ১০ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায় বাংলাদেশ সফরে আসতে পারেন ব্রিটিশ রাজা চার্লস কুড়িগ্রামে বাড়ছে শীতের প্রকোপ, তাপমাত্রা নামল ১৫.৬ ডিগ্রিতে

ঢাকায় শিশু শ্রমিক বাড়ছে: তবে পরিসংখ্যান নেই

রাতুল মাঝি

আপডেট: ০১:৪৪ পিএম, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ শুক্রবার

যে বয়সে হাতে ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা সে বয়সে রোদে পুড়ে চকলেট বিক্রি করে রহিম। ওর বয়স মাত্র ৯ বছর। বাংলা মটর ট্র্যাফিক সিগনালে চকলেট বিক্রি করে সে। রিক্সাচালক বাবা হঠাৎ অসুস্থ্য হয়ে পরায় বাধ্য হয়েই পথে নামতে হয়েছে তাকে। রহিম প্রায় দুবছর ধরে এ কাজ করছে। প্রতিদিন আয় হয় ৪০ থেকে ৫০ টাকা। এই টাকা দিয়ে ৫ সদস্যের সংসার চালায় সে।

আজিজের বয়স ১২ বছর। গত এক বছর ধরে সে পুরোনো ঢাকার একটি গাড়ি মেরামতের কারখানায় কাজ করছে। মাত্র এক হাজার টাকা বেতন। ভোড় ছয়টা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত কাজ করতে হয় তাকে। অথচ বেতন অনিয়মিত। প্রতি মাসেই দিনাজপুরে নিজ বাড়িতে টাকা পাঠাতে মালিকের কাছে বেতনের জন্য বারবার ধন্না দিতে হয় তাকে।

শুধু রহিম বা আজিজ নয়, এভাবে প্রতিদিন ঢাকা শহরে শ্রম বিক্রি করছে অসংখ্য শিশু। প্রতিদিনই রাজধানীতে বাড়ছে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায় দেশের প্রতি ১০ জন শিশুর মধ্যে একজন শ্রমিক। এসব শিশুরা বিভিন্ন দোকান, হোটেল-রেস্তোরা, ওয়ার্কশপ, কারখানা, ভান্ডারি দোকান, গার্মেন্টস, টেম্পু হেলপান, ও বাসা-বাড়িতে কাজ করছে। অনেকে রাস্তায় রাস্তায় বিভিন্ন ফুল, চকলেট, পত্রিকা, বাদামসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী  ৪ কোটি ২৪ লাখ ( ৪২.৪ মিলিয়ন) শিশুর মধ্যে ২ কোটি ২৭ লাখ (২২.৭ মিলিয়ন) ছেলে এবং  ১ কোটি ৯৭ লাখ (১৯.৭ মিলিয়ন) মেয়ে শিশু। এদের মধ্যে ৭৪ লাখ (৭.৪ মিলিয়ন) শিশু অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত। এদের মধ্যে ছেলে শিশু ৫৪ লাখ ( ৫.৪ মিলিয়ন) এবং মেয়ে শিশু ২০ লাখ (২ মিলিয়ন)। সমীক্ষায় আরো দেখা যায়, আইএলও ঘোষিত বিশ্বমান ও কর্মঘন্টার ভিত্তি অনুযায়ী ৭৪ লাখ শিশুর মধ্যে ৩২ লাখ (৩.২ মিলিয়ন) হচ্ছে শিশু শ্রমিক। এদের মধ্যে ২৫ লাখ (২.৫ মিলিয়ন) ছেলে এবং ৭ লাখ (০.৭ মিলিয়ন) মেয়ে শিশু। এসব শিশুদের মাত্র ৬ দশমিক ৭ ভাগ শিশু প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে এবং ৯৩ দশমিক ৩ ভাগ শিশু অপ্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে শ্রম দিচ্ছে। এছাড়াও দেশের শিশু শ্রমিকদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত রয়েছে ১৩ লাখ শিশু। যার শতকরা হার মোট শিশু শ্রমিকের ৪১ শতাংশ।

জানা গেছে বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের শিশু আইনে ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত একজন মানুষকে শিশু হিসেবে চিহিুত করা হয়েছে। ন্যাশনাল চিল্ড্রেন পলিসি ১৪ বছর পর্যন্ত মানুষকে শিশু হিসেবে চিহিুত করেছে। শিশু শ্রম নিরসনের জন্য ১৯৭৩ সালের জুন মাসে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ৫৮তম অধিবেশনে ন্যূনতম বয়স সংক্রান্ত কনভেনশন ১৩৮ গৃহীত হয়। এই কনভেনশনে ন্যূনতম বয়স ১৫ বছর ঘোষণা করা হয়। যি সব কাজ শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ সেক্ষেত্রে শ্রমে নিয়োগের বয়স কোনো অবস্থাতেই ১৮ বছরের কম হবে না। হালকা ধরনের কাজের ক্ষেত্রে ১৩ থেকে ১৫ বছরের ছেলেমেয়েদের নিয়োগ করা যাবে।

অথচ আইএলও’র সাম্প্রতিক এক তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশের শিশু শ্রমিকরা প্রায় ৩শ ৪৭ ধরণের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে ৪৭ ধরণের কাজকে ঝুঁকিপূর্ণ এবং ১৩ ধরনের কাজকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হিসেবে চিহিুত করা হয়েছে।

অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজের মধ্যে রয়েছে ব্যাটারিসহ বিভিন্ন বিষাক্ত রাষায়নিক কারখানায় শিশুশ্রম, ট্যানারি শিল্প, যৌন কর্ম, বিড়ি ও তামাক ফ্যাক্টরি, পরিবহন খাত, ময়লা আবর্জনা সংগ্রহ করা, গ্লাস ফ্যাক্টরি, লেদ মেশিন ও ওয়েল্ডিংয়ের কাজ, অটোমোবাইল কারখানা, লবন কারখানা, রিক্সা ও ভ্যান চালক, কাঠ মিস্ত্রির কাজ, জুয়েলারী শিল্পে কারিগরের কাজ, চাল ও মসলার কারখানার কাজ, ম্যানুফ্যাকচারীং কারখানার কাজ, মাদক দ্রব্য বিক্রি ও অস্ত্র বহন, চোরাচালানি ইত্যাদি।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন দারিদ্র, অশিক্ষা, পারিবারিক বিচ্ছেদ, পিতার বহু বিবাহ, জন সংখ্যা বৃদ্ধি এবং  নদী ভাঙ্গনসহ নানা রকম প্রাকৃতিক দূর্যোগের ফলে সৃষ্ট দূরবস্থায় কারণে দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এছাড়াও পিতা বা উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যু, ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা, অনাকর্ষনীয় শিক্ষা ব্যবস্থা, শহরে বস্তির বিস্তার, বড় পরিবার ইত্যাদি কারণেও শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে বলে জানা গেছে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন পারিবারিক ও আর্থসামাজিক বিভিন্ন কারণে ৬ থেকে ৭ বছর বয়সেই বাংলাদেশের শিশুরা জীবন ধারণের জন্য শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। দারিদ্যের কষাঘাতে স্বাস্থ্য, পুষ্টি, বাসস্থান, শিক্ষা, বিনোদন ও নিরাপত্তা লাভের মৌলিক অধিকার থেকে এসব শিশুরা বঞ্চিত।

তারা মনে করছেন, রাত জেগে কাজ করা, অত্যাধিক কাজের চাপ, অবহেলা, পর্যাপ্ত আলো বাতাসের অভাব, প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পানীয় জলের অভাব, আগুণের ব্যাহার, ময়লা, নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর কাজের পরিবেশ, ধারালো যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার, কম মজুরি, মালিকের দূর্ব্যবহার, পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাব এবং দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করার ফলে শারীরীক ও মানসিকভাবে অসুস্থ্য হয়ে পড়ছে এসব শিশুরা। কেটে যাওয়া, ক্ষত, আগুনে পোড়াসহ নানা রকম ইনজুরি ও ইনফেকশন, চর্ম রোগ, চোখের সমস্যা, শ্রবণ সমস্যা, শ্বাস কষ্ট, পেটের পিড়া, অম্ল ও মাথা ব্যাথাসহ নানা রকম জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. নূরে আলম বলেন, অপরিচ্ছন্ন-অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, বয়সের তুলনায় অনেক বেশি পরিশ্রম এবং প্রয়োজনীয় খাবারের অভাবে এসব শিশুরা দ্রুত নানা রকম রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। অনেকে মানসিকভাবে অসুস্থ্য হয়ে যাচ্ছে। ফলে দেখা যাচ্ছে অল্প বয়সেই ওরা বুড়িয়ে যাচ্ছে। অনেকে মারা যাচ্ছে অথবা দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থ্যতায় ভুগছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন আইনের অপব্যবহার ও আইন অমান্য করা, সরকারের পর্যপ্ত মনিটরিংয়ের অভাব এবং সস্তা ও বিনা পারিশ্রমিকে শিশু শ্রমিক পাওয়ার কারণে দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

জানা গেছে ১৯৮৯ সালের নভেম্বরে শিশু অধিকার সনদ জাতি সংঘের সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে আন্তর্জাতিক আইনের একটি অংশে পরিণত হয়। প্রথমে যে কয়েকটি দেশ এ চুক্তি স্বাক্ষর ও অনুমোদন করে বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। কিন্ত তার পরও দেশ থেকে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা হ্রাস করা সম্ভব হচ্ছে না।