ঢাকা, মঙ্গলবার ০৩, ডিসেম্বর ২০২৪ ২২:৪৩:২৮ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
বিবিসির ১০০ প্রভাবশালী নারীর তালিকায় বাংলাদেশের রিক্তা অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন সেই তরুণী, বিয়ের চাপ দেওয়ায় খুন করেন প্রেমিক শীতের দাপটে কাঁপছে পঞ্চগড়, বিপর্যস্ত জনজীবন আজ আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস ভারতে হাইকমিশনে হামলার প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ

প্রতিভা বসুর কাজের মূল্যায়ন এখনও হয়নি: দময়ন্তী বসু

অনলাইন ডেস্ক | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৮:৪৭ পিএম, ১০ নভেম্বর ২০২৩ শুক্রবার

সাহিত্যিক প্রতিভা বসু।

সাহিত্যিক প্রতিভা বসু।

প্রতিভা বসু; একজন ভারতীয় বাঙালি ঔপন্যাসিক, ছোটো গল্পকার ও প্রাবন্ধিক। তিনি প্রখ্যাত লেখক বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী। তার সম্পর্কে বলেছেন তারই কন্যা দময়ন্তী বসু সিং। একটি বিদেশী পত্রিকায় দেওয়া এই বিশেষ সাক্ষাৎকারটি উইমেননিউজ২৪.কম-এর পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঋতপ্রভ বন্দ্যোপাধ্যায়।

ঋতপ্রভ বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রতিভা বসু নজরুলের কাছে নজরুলগীতি, দিলীপ রায়ের কাছে দ্বিজেন্দ্রগীতি-অতুলপ্রসাদী এবং পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছেন, তিনি গান ছাড়লেন কেন?

দময়ন্তী বসু সিং: বাড়িতে সর্বদাই গান হত৷ আমার ছোটবেলায়, মা গাইছেন, আমি নাচছি, এ তো নিত্যকার ঘটনা৷ উনি ‘চাইল্ড প্রডিজি’ ছিলেন৷ তবে, ছোট থেকে গান খুব যে সচেতন ভাবে ভালোবেসে করতেন, তা হয়তো নয়৷ আমার দিদিমা-দাদু মেয়ের প্রতিভা বিকাশের জন্য অনেক কিছু করেছেন৷ তারা যদি মেয়ের গুণ যত্ন করে নার্চার না করতেন, তা হলে সে সময়ে তার প্রতিভা বিকশিত হত না৷ সে কালে রীতি বহির্ভূত ভাবে মেয়েকে ছোটবেলাতেই মুসলিম উস্তাদের কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিখিয়েছেন৷ ক্রমশ ঢাকা এবং কলকাতায় রানু সোমের গান বিশেষ সমাদৃত হয়৷ এর মধ্যে চিত্তরঞ্জন দাশ, দিলীপ রায়, সত্যেন বসুর পরিবারও তার গানের প্রতিভার জন্য রানুকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন৷ আর নজরুলের গল্প তো সবাই জানেন৷ ঢাকায় মা-দের বাড়িতে বসে অনেক গান লিখেছিলেন৷ উনি গান লিখতেন, সুর করতেন এবং রানুকে শিখিয়ে বলতেন গানটা করতে৷ সেই গানের খাতা আমার কাছে এখনও রয়েছে৷ পরে রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যও পেয়েছেন৷ এত সব সত্ত্বেও আমরা মায়ের রেকর্ড আমাদের বাড়িতে দেখিনি৷ হতে পারে, দেশভাগের সময়ে অনেক কিছুর সঙ্গে রেকর্ডগুলো হারিয়ে গিয়েছিল৷ উনি বলতেন, ‘আমার গান শোনার যোগ্য নয়৷ আজকালকার মেয়েরা কী সুন্দর গান করে…৷’ অনেকে মনে করেন, বুদ্ধদেব বসু চাইতেন না বলেই প্রতিভা বসু গান করলেন না৷ এ কথাও ভীষণ অসত্য৷ তবে, বুদ্ধদেব তো সে অর্থে গানের কনেসর (Connoisseur) নন, কথার কনেসর৷ যে ভাবে রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী তাকে ছুঁয়ে যেত, নজরুল বা দ্বিজেন্দ্রগীতি তাকে হয়তো সে ভাবে স্পর্শ করত না৷ আরও একটা কথা, বিয়ের পর প্রতিভা এবং বুদ্ধদেব বহুকাল পর্যন্ত দু’কামরার বাড়িতে থাকতেন৷ এক ঘরে লেখকের আড্ডা, পাশাপাশি অন্য ঘরে তানপুরা-তবলা নিয়ে গান হয়তো সম্ভবও হত না বলেই প্রতিভা মনে করেছেন৷ তা ছাড়া সন্তানদের মানুষ করা এবং সংসার তো পাশাপাশি চলেছে৷ তবে বুদ্ধদেব চাইতেন, তাদের কবি-সাহিত্যিকের আড্ডায় স্ত্রীও থাকুন৷ বিয়ের পরে একবার, হিমাংশু দত্তের গান রেকর্ড করেছিলেন যা, ‘প্রতিভা বসু’ নামে প্রকাশিত হয়, রানু সোম নয়৷ খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিভা বসুর সম্ভাবনা বুদ্ধদেব টের পেয়েছিলেন এবং তার আরও বিকাশ চেয়েছিলেন৷ স্বাভাবিকভাবেই গান আর সামনে আসেনি৷

ঋতপ্রভ বন্দ্যোপাধ্যায়:  ‘গায়িকা’ রানু সোম থেকে ‘সাহিত্যিক’ প্রতিভা বসু-এই রূপান্তর তো আপনার জন্মের সময়…৷

দময়ন্তী বসু সিং: কথাটা এক অর্থে ঠিক আবার এক অর্থে ঠিক নয়ও৷ কারণ, মা নিজে ছোট থেকে লিখতেন, পত্রিকায় লেখা পাঠাতেন৷ বেশিরভাগই কবিতা৷ বুদ্ধদেবের একটা লেখা নাট্যরূপ দিয়ে একবার ঢাকায় মঞ্চস্থও করেছিলেন৷ কিন্তু, বিয়ের পর যে আবহে এলেন, সেখানে কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডা৷ এক সময় জ্যোতিকাকা (জ্যোতির্ময় রায়) মজা করে বললেন, ‘ছোট গল্পের প্রতিযোগিতা হচ্ছে, আপনিও লিখবেন নাকি?’ মা তখনি লিখতে বসে গেলেন৷ ‘মাধবীর জন্য’৷ তখন পুরস্কার পেয়েছিলেন, পরবর্তীকালে সিনেমাও হয়৷ প্রথম উপন্যাস ‘মনোলীনা’ (১৯৪৪) কবিতা ভবন থেকে প্রকাশিত হয়৷ 

আমার জন্মের পরবর্তী কালে অর্থাৎ চারের দশকে এসে সাহিত্যিক হিসেবে কলকাতায় মায়ের আত্মপ্রকাশ৷ উপন্যাসটির বিষয় এবং ভাষার আধুনিকতা লক্ষ করার মতো৷ বাবা বলতেন, ‘তোর মায়ের মতো সংলাপ বাংলা সাহিত্যে কেউ লিখতে পারে না৷’ সুধীন দত্তকেও এ কথা বলতে শুনেছি৷ কিন্তু, সেই ভাবে দেখতে গেলে তেমন পুরস্কার তো পাননি৷

এ-কথা ঠিক যে, পুরস্কার হয়তো সব নয়৷ তবে, একটা স্বীকৃতি তো বটেই৷ নারীরা মায়ের লেখার অন্ধ ভক্ত হলেও অনেকে বলতেন, পুরুষ সমাজের কাছে প্রতিভা বসু খুব গ্রহণযোগ্য নন৷ আমার মনে হয়, যখন প্রতিভা বসুর একের পর এক উপন্যাস এবং অন্য লেখা প্রকাশিত হচ্ছে, তারই সঙ্গে পরপর তাঁর কাহিনি চলচ্চিত্রায়িত হচ্ছে, তখন তার স্বীকৃতি অন্যভাবে পেলেন৷ সাগরময় ঘোষ, সন্তোষকুমার ঘোষ, গৌরকিশোর ঘোষ বা অম্লান দত্তের মতো ব্যক্তিত্ব তার লেখার অনুরাগী ছিলেন৷ একটা কথা কী জানো তো, ছোটগল্প আসলে খণ্ডকাব্য, তার শুরু এবং শেষটা খুব ক্রিটিক্যাল৷ প্রতিভা বসুর যে কোনও গল্পেই শুরু এবং শেষ ভীষণ অভিনব৷ উদাহরণ হিসেবে, ‘সুমিত্রার অপমৃত্যু’ ও ‘বিচিত্র হৃদয়’ গল্প দু’টো ধরা যাক৷ আজও পড়লে মনে হয় কত আধুনিক- প্রথম গল্পে হিন্দু-মুসলমানের প্রেম এবং দ্বিতীয় গল্পে দেখি মা এবং মেয়ে একই ব্যক্তির প্রেমে পড়ছে৷ এই রকম থিম তখন কোথায় ছিল? প্রতিভা বসু এই গল্প লিখছেন চারের দশকে৷ এই দশকের শেষে তাঁকে বাইরের জগৎ স্বীকৃতি দিল, যখন বসুমতী থেকে উপন্যাস লিখতে বলা হল৷ সেই উপন্যাস ‘মনের ময়ূর’৷ প্রকাশিত হল ‘নাভানা’ থেকে৷ সে সময় বুদ্ধদেব ‘কবিতা ভবন’ প্রকাশনা ধীরে ধীরে বন্ধ করে দিলেন৷ মাকে প্রতিষ্ঠিত করার কাজটা তিনি তত দিনে সম্পন্ন করে ফেলেছেন৷

ঋতপ্রভ বন্দ্যোপাধ্যায়: ৮২ বছর বয়সে লিখলেন ‘মহাভারতের মহারণ্যে’৷ কিছু বিতর্ক হল৷ শোনা যায়, এই বই হয়ে ওঠার পিছনে আপনার নাকি অবদান ছিল?

দময়ন্তী বসু সিং: হ্যাঁ, ওই লেখার সঙ্গে আমি ভীষণ ভাবে জড়িত৷ শেষের দিকে মা ‘কমিশনড’ না হলে লিখতেন না৷ হয়তো তখন কল্পনার জগতে যেতে পারছেন না, বা নতুন কোনও আইডিয়া আসছে না৷ সেই সময়টায় প্রচুর পড়তেন৷ আমি তখন কানপুর আইআইটিতে৷ শিবনারায়ণ রায়ের ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকার ‘লাইফ মেম্বার’ ছিলাম৷ সেই পত্রিকার একটা সংখ্যায় দেখলাম মায়ের প্রবন্ধ, ‘নায়িকা সত্যবতী’৷ সেটা পড়ে আই ওয়াজ সো এক্সাইটেড অ্যান্ড সো মুভড! দেখলাম, প্রতিভা বসু ভীষণ নতুন কথা বলছেন৷ আমি কলকাতা এসে মাকে বললাম, তুমি অসাধারণ প্রবন্ধ লিখেছ৷ কিন্তু তোমার বক্তব্য এত অল্প কথায় বললে হবে না৷ ২০০০ টাকা মাকে দিয়ে বললাম এটা অগ্রিম, এই বইটি দিয়ে আমি প্রকাশনা শুরু করব৷ তখনও জানি না, আমি আদৌ কখনও কলকাতা ফিরতে পারব কি না, প্রকাশনা করা তো দূরস্থান৷ মা তো তখন হাসলেন, কিন্তু অচিরেই লিখতেও শুরু করলেন৷ বেশ কিছু মাস পর বললেন, ‘আমি তো অনেক পাতা লিখে ফেলেছি, তোকে এডিট করতে হবে৷’ এডিটিং শুরু করলাম৷ বইটা আমাকেই মা উত্সর্গ করেন৷ সত্যিই এই বই দিয়ে আমার প্রকাশনা সংস্থা ‘বিকল্প’ শুরু৷ বই নিয়ে অনেক বিতর্কও আছে৷ তেমনই আবার অম্লান দত্ত, সাগরময় ঘোষ, শিবনারায়ণের মতো মানুষেরা মুগ্ধও হয়েছেন৷

ঋতপ্রভ বন্দ্যোপাধ্যায়: তার লেখায় চরিত্র হিসেবে মেয়েরা অনেক বেশি শক্তিশালী৷ এই সব কাহিনি যখন তিনি লিখছেন, তখন এখানে ‘মানবীবিদ্যা চর্চা’ বলে কোনও শাখা আসেনি৷ প্রতিভা বসুকে নারীবাদী লেখক বলা চলে?

দময়ন্তী বসু সিং: এ কথা সত্যি যে, প্রতিভা বসু যে সময় লেখা শুরু করেছেন, তখন পড়াশোনার বিষয় হিসেবে আলাদা করে ‘ফেমিনিজম’ বা ‘উওমেন স্টাডিজ’ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও সে ভাবে আসেনি৷ পরবর্তী কালে আমাদেরও মাকে ‘নারীবাদী’ বলেই মনে হয়েছে৷ মজা করে মাকে বলতাম, ‘তোমার মতো ফেমিনিস্ট খুব কম দেখা যায়!’ আসলে, জীবনটাও তো একটা আয়না৷ প্রতিভা বসুর লেখা পড়লে দেখা যায়, তিনি নারীদের সব সময় জিতিয়ে দিয়েছেন৷ তার মানে পুরুষকে তিনি হেয় করেননি৷ তাঁর মেয়ে চরিত্ররা উদ্ধত নয়৷ ‘ফেমিনিজম’ বা ‘নারীবাদ’ কথাটার মধ্যে যে ‘ঔদ্ধত্য’ রয়েছে, সেই বিষয়টা মায়ের লেখা বা স্বভাবের মধ্যে ছিল না৷ ঔদ্ধত্য বলতে আমি বোঝাতে চাইছি, এমন কথা- ‘আমি নারী, আমি জন্ম দিতে পারি৷ সুতরাং আমার আর কারওকে দরকার নেই… ইত্যাদি৷’ এ সব তিনি বিশ্বাসও করতেন না৷ ব্যক্তি জীবনে ছিলেন খুবই স্নেহশীল৷ সংসারের সব দায়িত্ব তার৷ সে গয়না বিক্রি করে আমাদের স্কুলে ভর্তি করা হোক বা দোকানের দেনা মেটানো৷ আমার মনে হয়, প্রতিভা বসুর প্রথম দিকের উপন্যাস, ছোটগল্প খুব উচ্চতারে বাঁধা৷ প্রতিভা বসু নারীবাদী কি না, তার থেকেও তাই আমার কাছে বড় কথা, তার গল্প বলার ক্ষমতা, ভাষার ব্যবহার, সংলাপ লেখার দক্ষতা এবং থিম্যাটিক ভ্যারিয়েশন৷ তাঁর গল্প-উপন্যাসে ‘মহিলা’ ব্যাপারটা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতটা বিষয়৷ আশপূর্ণা দেবীর পর প্রতিভা বসুর উত্থানটা ‘উত্থান’ হিসেবে দেখা উচিত ছিল৷ প্রতিভা বসুর প্রতি যে অবিচার হয়েছে, তা তো আর ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না৷ বুদ্ধদেবকে যে ভাবে বারবার আঘাত করা হয়েছে, তা এখন মনে পড়লে যেমন কষ্ট পাই, তেমন সাহিত্যের বৃহত্ পরিসর থেকে প্রতিভা বসুকে সরিয়ে রাখা হয়েছিল ভাবলেও খারাপ লাগে৷ মনে হয়, তাঁর অনেক বেশি প্রাপ্য ছিল৷ প্রতিভা বসুর কাজের বিচক্ষণ মূল্যায়ন এখনও হয়নি৷