ঢাকা, মঙ্গলবার ১৯, নভেম্বর ২০২৪ ২০:২৭:৫২ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
পদত্যাগ করেছেন হাইকোর্টের তিন বিচারপতি রাজধানীতে তিনদিনের মধ্যে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের নির্দেশ যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্টের কারণে সবকিছু বদলে যাবে না ডেঙ্গুরোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, রক্ষা পাবেন যেভাবে শুষ্ক মৌসুমেও পানিবন্দি ৩ উপজেলায় লাখো পরিবার বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনে নতুন চেয়ারম্যান সায়েমা শাহীন

রঙ ঝলমলে পাখি হুদ্হুদ্

আইরীন নিয়াজী মান্না | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৩:৪২ পিএম, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৯ বৃহস্পতিবার

রঙ ঝলমলে পাখি হুদ্হুদ্

রঙ ঝলমলে পাখি হুদ্হুদ্

আমি প্রথম পাখিটি দেখি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে। বেশ কয়েক বছর আগে এই হলের সবুজ মাঠে এই সুদর্শন পাখিটিকে প্রথম দেখতে পাই। এর আগে আর কখনোই এই অপরুপ পাখিটি আমি দেখিনি। পাখিটি এতোই সুন্দর যে, আমি তাৎক্ষণিক পাখিটির নামকরণ করি হেমাঙ্গিনী। অথাৎ সুন্দর দেহের অধিকারী। এরপর বহুবার রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আমি ওকে দেখেছি।

বাংলাদেশের সুন্দর পাখিগুলোর মধ্যে এই পাখি অন্যতম। পাখি বিশেষজ্ঞরা পাখিটির বাংলা নাম দিয়েছেন হুদ্হুদ্। হু-পো হু-পো শব্দে ওরা ডাকে। এই শব্দই নামকরণের কারণ কিনা তা অবশ্য জানা যায়নি। মাথার সুন্দর ঝুঁটিটির কারণে আবার কেউ কেউ ওকে মোহনচূড়া বলে ডাকে। পাখিটির নামকরণ `মোহনচূড়া` দিয়েছেন কথাসাহিত্যিক বনফুল।  কেউ কেউ ডাকে হুপো নামে। এশিয়া ও ইউরোপে এটি প্রচুর দেখা যায় এবং এরা বিলুপ্তির শংকামুক্ত। এদের অনেকগুলো উপপ্রজাতি রয়েছে। সেইন্ট হেলেনা প্রজাতিটি সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়েছে।

হুদ্হুদ্ বা হেমাঙ্গিনীর ইংরেজি নামও হুপো (HOOPOE)। বৈজ্ঞানিক নাম Upupa epops এবং শ্রেণী UPUPIDEA। পর্ব- কর্ডাটা, বর্গ- Coraciiformes, পরিবার- Upupidae, Leach, 1820, গণ- Upupa, প্রজাতি- ইউ. এপপস্, দ্বিপদী নাম- উপুপা এপপস্। ওরা নন-প্যাসেরাইন বা অগায়ক পরিবারভুক্ত পাখি।

হুদ্হুদ্ পাখি ২৫ থেকে ৩২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। ওদের গায়ের পালকের রঙ লালচে বাদামি। সঙ্গে হালকা গোলাপি আভা আছে। লেজ এবং পাখায়  জেব্রার মতো সাদার ওপর কালোর ডোরা কাটা। বুকে ডোরা কাটা নেই। বুক, গলা ও পায়ের ওপরের অংশের পালক বাদামি। পা মাঝারি আকারের।

হুদ্হুদ্ বা হেমাঙ্গিনী পাখির দল যখন দল বেঁধে মাঠের সবুজ ঘাসের বুকে ঘুরে বেড়ায় তখন দূর থেকে দেখে মনে হয় যেন কোনো শিল্পীর রঙ তুলিতে আঁকা চিত্রকর্ম। পাখিটির শরীরের রঙের চাকচিক্য কারো দৃষ্টি এড়ায় না।

হুদ্হুদ্ আকারে ময়না পাখির সমান। মাথার ওপর মস্ত বড় দৃষ্টিনন্দন একটি ঝুঁটি আছে। এই ঝুঁটিটি হেমাঙ্গিনীর রুপকে যেন আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। লম্বা ও সরু হয়ে ঝুঁটিটি মাথার পেছন দিকে হেলে গেছে। ঝুঁটির আগার পালক সাদা-কালো। হুদ্হুদ্ বা হেমাঙ্গিনীর মাথার ঝুঁটিটি বেশির ভাগ সময়ই গুটানো থাকে। তবে মাঝে মাঝে পাখিটি উত্তেজিত হলে ঝুঁটির পালকগুলো হাত পাখার মতো ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় পালকের সাদা-কালো অংশ দেখা যায়। ওদের চঞ্চু খুব লম্বা এবং সরু, রঙ কালো। চঞ্চুটি নিচের দিকে বাঁকানো। এই লম্বা চঞ্চু মাঠের সবুজ ঘাসের ভেতর ঢুকিয়ে ওরা খাবার খুঁজে খায়।

হেমাঙ্গিনী অর্থাৎ এই হুদ্হুদ্ সাধারণ পতঙ্গভুঁক পাখি। কিট-পতঙ্গ এবং এদের ডিম হুদ্হুদের প্রিয় খাবার। তবে ওরা পিঁপড়া খেতেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের মাঠে বসে আমি এবং আমার বন্ধু হুমায়রা দিনের পর দিন এই পাখির আচরণ পর্যবেক্ষণ করেছি। খাবার হিসেবে ওদের আমরা পাউরুটি, বিস্কুট এবং বাদাম ছিটিয়ে দিয়ে দেখেছি। আবাসিক পাখির মতো ওরা আমাদের আশপাশে এসে এসব খাবার খেয়েছে।

গ্রামের কৃষকের কাছে এই হুদ্হুদ্ বন্ধুর মতো পাখি। কারণ ফসলের জমি থেকে পোকা বা শুয়ো পোকা খুঁজে খুঁজে খেয়ে ফসলকে রক্ষা করে ওরা। কাঠ ঠোকরা পাখির সাথে শারীরিক গড়নের মিল থাকায় অনেক সময় গ্রামের মানুষ ওদেরকে কাঠ ঠোকরা মনে করে ভুল করে ।

আমাদের দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই হুদ্হুদ্ পাখি দেখা যায়। গ্রাম থেকে শুরু করে শহরের সবুজবেষ্টিত উদ্যানে ওদের অবাধ চলাচল। খোলামেলা জায়গায় ওদের বিচরণ বেশি।

ঢাকা শহরের কোলাহলের মধ্যেও একটু লক্ষ্য করলেই এই সুন্দর পাখিটিকে দেখা খুব কষ্টকর কিছু নয়। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, রমনা পার্ক, হাই কোর্ট চত্বর, ইডেন কলেজ প্রাঙ্গণে এই পাখিটি বেশ নজরে পড়ে। রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় গত দশ বছরে আমি বহুবার এই পাখিটিকে দেখেছি।

হেমাঙ্গিনী গভীর অরণ্য সাধারণত এড়িয়ে চলে। বনের ফাঁকা জায়গায় মাঝে মাঝে ওদের দেখা গেলেও জনবসতিবহুল এলাকাই ওদের বেশি পছন্দ। কারণ ওরা মানুষের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে।

হুদ্হুদ্ বা হেমাঙ্গিনী একাকী বা জোড়ায় জোড়ায় মাঠে, খোলা প্রান্তরে বা সড়কের ধারের খোলা ভূমিতে মনের সুখে ঘুরে বেড়ায়। রোকেয়া হলের মাঠে আমি একাধিকবার পাঁচ-ছয়টিকে একসঙ্গে ঘুরে বেড়াতে দেখেছি।

হুদ্হুদ্ বা হেমাঙ্গিনীর প্রজনন ঋতু গ্রীষ্মকাল। এ সময় গাছের ফোকরে বা পরিত্যাক্ত বাড়ি ঘরের দেয়ালের ফাটলে ওরা ঘাস. খড়-কুটা, আবর্জনা, ন্যাকড়া ইত্যাদি দিয়ে বাসা তৈরি করে। এই বাসায় স্ত্রী পাখি ৫ থেকে ৬টি সাদা রঙের ডিম পাড়ে। ডিমের রঙ সাদা। এতো সুন্দর পাখিটির বাসা কিন্তু সুন্দর-পরিপাটি নয়। কেমন যেন এলোমেলো।

হুদ্হুদ্ আমাদের স্থানীয় পাখি। সারা বছর দেখা গেলেও শীতকালেই ওদের বেশি নজরে পড়ে।

মানব সভ্যতার বিভিন্ন যুগের সংস্কৃতিতে এই পাখির সম্পৃক্ততা রয়েছে। প্রাচীন মিসরে একে পবিত্র জ্ঞান করা হত।

কোরআনে ও বাইবেলে এই পাখির উল্লেখ আছে। কোরআনের সূরা নামলের ২০-২২নং আয়াতে এই পাখির কথা বলা হয়েছে। একটি হুদহুদ পাখি নবী হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর পোষা ছিল এবং এর কাজ ছিল বিভিন্ন স্থান থেকে খবরাখবর সংগ্রহ করে নবীকে জানানো।

প্রাচীন পারস্যে এই পাখিকে সততার প্রতীক হিসেবে দেখা হত। কিন্তু ইউরোপে একে চোর হিসেবে গণ্য করা হত। অন্যদিকে এস্তোনিয়ায় এই পাখিকে মৃত্যুর প্রতীকরূপে দেখা হয়।

লেখক : আহবায়ক, বাংলাদেশ বার্ড ওয়াচার সোসাইটি।