ঢাকা, শুক্রবার ২২, নভেম্বর ২০২৪ ৪:০৮:৪৫ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
ঠাকুরগাঁওয়ের তিন নারী ফুটবলারকে সংবর্ধনা ডেঙ্গুতে একদিনে নয়জনের প্রাণহানী সেনাকুঞ্জে খালেদা জিয়া, স্বাগত ও ধন্যবাদ জানালেন ড. ইউনূস রাজধানীতে আজও অটোরিকশা চালকদের সড়ক অবরোধ আজ ১২ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায় পঞ্চগড়ে তাপমাত্রা নামল ১৪ ডিগ্রিতে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের সুযোগ কাজে লাগাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সরকার

সম্পর্ক না সন্দেহ

জিনাত আরা হক | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৮:০৯ পিএম, ৩০ মে ২০১৯ বৃহস্পতিবার

জিনাত আরা হক, নির্বাহী সমন্বয়কারী ‘আমরাই পারি’

জিনাত আরা হক, নির্বাহী সমন্বয়কারী ‘আমরাই পারি’

তুমি কার সাথে এতক্ষণ মোবাইলে কথা বললা? আগেতো শুনিনি এ নামে কোনো বন্ধু বা কলিগ আছে?
এতো সাজগোজ করছো কেনো আজকাল?
দু’টি শব্দই ‘স’দিয়ে, সম্পর্ক আর সন্দেহ! এক স’তে সৃষ্টি আর এক স’ ধ্বংস! নারী-পুরষের বৈবাহিক সম্পর্কে সন্দেহ এক মারাত্মক রোগ। যা ক্রমাগত হারে বাড়তে থাকে আর ধ্বংস করে একটা সুস্থ পারিবারিক সম্পর্ক।
কোথা থেকে সূত্রপাত হয় এই  রোগের!
এই যে ধারণা, যে বাইরের জগত পুরুষের, আর ঘরের জগত নারীর, তা ক্রমশই নারীরা একেবারে ভেঙ্গে-চুরে দিচ্ছে। ঘর-বাইরে সব জায়গায়তেই তো নারী দক্ষতা দেখিয়ে যাচ্ছে। বরং পুরুষ ঘরের জগতে এখনো  আনাড়ি।
‘আমি মাঝে মাঝে পানি গরম করি’ পর্যন্ত পুরুষের সাফল্য। পুরুষের এই অবস্থান চ্যুতির অপমানের শোধ সে নেয় সন্দেহ প্রকাশের মাধ্যমে।
আবার নারী যখন ঘরের বাইরেও যাচ্ছে, আয়মূলক কাজে জড়িত হচ্ছে, কাজের সূত্রে পরিবারের গন্ডির বাইরের মানুষদের সাথে মিশছে তখন অনেক স্বামীর মনে বিস্তার হচ্ছে সন্দেহের জাল।
যে পুরুষ শৈশবে-কৈশোরে তাদের মা, খালা, চাচীদের ঘরের গন্ডিতে দেখে অভ্যস্ত তাদের ঘরের বাইরে খুব নিকট আত্মীয় ছাড়া অন্য পুরুষের সাথে মেলামেশা করতে দেখেনি, সে পুরুষ বিয়ের পরে স্ত্রীকে বাইরের জগতের সাথে মেলামেশা করতে দেখলে অস্বস্তি বোধ করে বা নারীর এই আচরণ পুরুষের কাছে কাঙ্খিত নয়। বিষয়টা এতো সরলও নয়। পুরুষ যেহেত সামাজীকিকরণ প্রক্রিয়ায় ক্রমাগত পুরুষ হয়ে ওঠে তাই নারীর আচরণ রীতিমত পুরুষের কাছে বাড়াবাড়ি মনে হয়।
পুরুষ নারীকে যেভাবে নির্মাণ করে, দেখে বা তার মনোজগতে  যে নারীর ছবি, সে নারী তেলাপোকা দেখলে ভয় পায়, ইলেকট্রিক সামগ্রী আর প্রযুক্তিতে রীতিমত আনাড়ি সেই নারী কিনা আজ মোবাইলের মতো প্রযুক্তিতে দক্ষ!  সেই নারী, স্বামী ছাড়াই বাইরের জগতের তথ্য ঠিকঠাক জেনে যাচ্ছে! শুধু জানছেই না বরং জীবনে ব্যবহারও করছে। এতো স্বামীর পুরুষত্বে রীতিমত আঘাত হানে,  যেন তার পুরুষ অনুভূতি ধূলায় মিশে যায়। 
আমাদের সমাজে স্বামী পুরুষরা মনে করে (অথবা সমাজ তাকে মনে করায়) সে তার স্ত্রীর কর্তা। স্বামী হিসেবে তার স্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, শাসন করতে হবে। নিয়ন্ত্রণ করতে তো কিছু অস্ত্র-সস্ত্র প্রয়োজন হয়। যেমন স্ত্রীকে স্বামীর ওপর নির্ভরশীল থাকতে হবে, বাইরের জগত সম্পর্কে স্ত্রীর কম জানাশোনা থাকা চাই, একটু পরগাছার ধরনের হতে হবে স্ত্রীকে। কিন্তু আজকাল তো নারী আয় রোজগারে, লোকজনের সাথে মেলামেশায়, হিসাব-নিকাশেও তুখোড়। তাহলে আর বাকি থাকলো কি, নিয়ন্ত্রণটা করবে কী দিয়ে? 
হ্যাঁ, অস্ত্র আছে, তাহলো নারীর চরিত্র! এক চরিত্রের তকমা দিয়েই নারীকে পুরা সিধা করে দেয়া সম্ভব।
কীভাবে নারী এতো তুখোড় হয়ে উঠলো, নিশ্চয়ই কোন পুরুষ তাকে সাহায্য করেছে!  কেমন করে স্বামী ছাড়াই বাইরের জগৎ স্ত্রী সামলে নিলো, এর পেছনে নিশ্চয়ই কোন পুরুষ ছিলো! শ্বশুর বাড়ি-বাপের বাড়ি (মা বা শ্বাশুড়ির বাড়ি না কিন্তু) সবাই হাজারো যন্ত্রণায় রাখে নারীকে,তারপরেও হাসিমুখ কেনো! নিশ্চয়ই অন্য কোন পুরুষ, সেই নারীর মনে বিরাজমান!
নারী যে একা চলতে পারে, হাসতে পারে, পুরো জগত সামলে নিতে পারে এটা পুরুষদের ভাবনায় আসে না। তাই স্ত্রীর সাথে একজন পুরুষকে যুক্ত করে স্বামী তৈরী করে এক ছায়াশত্রু। শুরু হয় ছায়াশত্রুর সাথে লড়াই। সমাজের প্রশ্রয়ে স্বামী স্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণ করে সন্দেহের বেড়াজালে। স্ত্রী চাকরি করবে-প্রয়োজন স্বামীর অনুমতি, স্ত্রী কাজ করবে-প্রয়োজন স্বামীর পছন্দনীয় কর্মক্ষেত্রে, স্বামীই নির্ধারণ করবে কোন সহকর্মীর সাথে মিশতে হবে, বাসায় ফিরে সব কথা স্বামীকে বলতে হবে; যদি স্ত্রীকে বাইরের জগতের মানুষেরা পছন্দ করে তবে তো এর পেছনে কোন কারণ আছে এমনই ভাবনা পুরুষের, তারা ভাবে নারী তার বুদ্ধি দিয়ে নয় বরং তার শরীরের আকর্ষণ দিয়েই বাইরের জগতে সফল। নারীর চরিত্রের সার্টিফিকেট তো স্বামীর কাছেই থাকে। কাজেই ইচ্ছেমতো তা ব্যবহারে বাধা নেই।
সন্দেহের মাত্রা এমন যে সংসার রক্ষা করতে গিয়ে অনেক নারী চাকরি ছেড়ে দেয়, অনেকে বেতনের টাকাটা স্বামীর হাতে তুলে দেয়, কেউ হিজাব আর বোরখার স্তর বাড়িয়ে দেয়। অনেক নারী আছে ঘন্টায় ঘন্টায় স্বামীকে জানায় সে এখন অফিসে কি করছে, অনেকে স্বামীকে সাথে নিয়ে বাইরের কাজ সারে, তাতেও কি সন্দেহের অবসান ঘটে?
আজকের পুরুষ বড় বিভ্রান্ত, জানে না আসলে কী চায় সে। এখনো পুরুষ চায় আর্থিকভাবে যদি না হয় না হোক অন্তত সামাজিক বা মানসিকভাবে নির্ভরশীল নারী, যার ওপর সে কর্তৃত্ব ফলাতে পারবে, কর্তৃত্বের মধ্যে দিয়ে পুরুষ আবার ভালবাসাও চায়। কিন্তু হায়! স্বামীর সন্দেহের তোপে পড়া নারীতো আর স্বামীকে ভালবাসতে পারেনা, সে তো থাকে জেলখানায়। কয়েদির সাথে তো জেলারের কোন প্রণয় হয় না। কাগুজে সম্পর্ক হয়। দু’জন মানুষ সে নারী হোক আর পুরুষই হোক- পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটাবে বাইরের জগতে, তার প্রতিফলন থাকবে ঘরেও। স্ত্রী যদি স্বামীর অবস্থানে গর্ববোধ করে তবে স্বামীরও স্ত্রীর অবস্থানে গর্ববোধ করাটাই বাঞ্ছনীয়।
ভালবাসায় জোরজবরদস্তি চলে না। আর মনকে শেকল দিয়ে বাঁধাও যায় না। বিয়ে হয়েছে দেখে নারী বা পুরুষের আর কাউকে ভাল লাগবে না, এ বড় অন্যায় চাওয়া হয়ে যায়, ভাল লাগা মানেই যৌনসম্পর্ক নয়, ভালবাসা মানেই সংসার বাধাঁর অঙ্গীকার করে ফেলা না। এই মানসিক বোধটা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের শিখতে হবে। স্ত্রী বা স্বামীর যদি বিপরীত লিঙ্গের কাউকে ভালো লাগে সেখানে একটা সুন্দর সম্পর্কও তৈরি হতে পারে। সেক্ষেত্রে বাধা বা জোরজবরদস্তি নতুন সম্পর্কটিকে যেমন কলুষিত করে, সম্পর্কটি দুর্ণিবারও হয়ে উঠতে পারে। দুর্ণিবার সম্পর্কটির কারণে স্বামী বা স্ত্রী তাদের পারিবারিক সম্পর্কের দায়িত্ববোধ পর্যন্ত ভুলে যায়। যে সম্পর্ক সন্দেহের পিলারে গড়া তা একদিন ভাঙ্গবেই। আর যদি নাও ভাঙ্গে তবে সারাজীবন নড়বড়েই হয়েই থাকবে। 
অনেকেই হয়তো বলবেন, স্ত্রীরাও তো স্বামীকে সন্দেহ করে তা নিয়ে কিছু বলছি না কেনো? নারীর সন্দেহের কারণ একটু ভিন্ন। নারী স্ত্রী হিসেবে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। কারণ এ সমাজে পুরুষের বহুবিবাহের প্রচলন আছে। বিয়ের বাইরে অন্য নারীর সাথে সম্পর্কেও সমর্থন ও সুযোগ আছে। তাই স্বামীকে চোখে চোখে রেখে নারীসঙ্গ নিয়ন্ত্রণের একটা প্রচেষ্টা থাকে নারীদের। তবে সজাগ থেকেও যে স্ত্রীরা খুব একটা স্বামীর অন্য নারীর প্রতি আগ্রহ কমাতে পারেন তা  মনে হয় না। ওই যে আগেই বলেছি, যেখানে বাধা সেখানে আগ্রহও বেশি।
তার চেয়ে বরং সম্পর্ককে মুক্ত পাখির মতো মেনে নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। দু’জন মানুষ দু’জনকে ভালবাসলে, মর্যাদার চোখে দেখলে, অন্য কাউকে কে ভালবাসলো তা নিয়ে এতো উদ্বিগ্ন হবার কিছু থাকে না। সম্পর্কে আধিপত্যশীলতা, অতিরিক্ত পরনির্ভরশীলতা, নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা একটা দমবন্ধ সম্পর্ক তৈরি করে। নারী-পুরুষ যখন স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে জড়ায় তখন প্রয়োজন পারস্পরিক আস্থা ও সম্মান। সন্দেহের মতো আচরণ দিয়ে আমরা অনেক সময় নিচু মানসিকতার পরিচয় দেই। তাই সন্দেহ নয়, সম্পর্ক গড়ে উঠুক নিঃস্বার্থ ভালাবাসায়। দু’জন আত্মবিশ্বাসী মানুষের ভালবাসাই পারে নারী-পুরুষের সকল সম্পর্ককে প্রাণবন্ত রাখতে, নির্যাতনমুক্ত রাখতে।
৥ লেখক: জিনাত আরা হক, নির্বাহী সমন্বয়কারী ‘আমরাই পারি’