আমাদের জেন্ডার বাজেট
ফেরদৌস আরা রুমি
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০৪:১৫ পিএম, ৮ আগস্ট ২০১৯ বৃহস্পতিবার
ফেরদৌস আরা রুমি
জেন্ডার বাজেট মানে নারীর জন্য আলাদা কোনো বাজেট নয়, বরং এটি একটি বিশেষ পদ্ধতি যার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় হিসাব-নিকাশের সাহায্যে জাতীয় বাজেটের জেন্ডার-সংবেদনশীলতা বিশ্লেষণ করা যায়। জেন্ডার বাজেটের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের জেন্ডার-সংবেদনশীলতা চিহ্নিত করা যাতে বাজেটে সম্পদের বণ্টনের মাধ্যমে নারী-পুরুষের সমতা বৃদ্ধি বা অসমতা হ্রাস করা যায়।
এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে বর্তমানে ৪৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে জেন্ডার বাজেট অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে নারীর উন্নয়নের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা। চলতি ২০১৯-২০ অর্থ বছরে নারী উন্নয়নে বরাদ্দ করা হয়েছে ১৬১২৪৭ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ৩০.৮২ শতাংশ এবং জিডিপি’র ৫.৫৬ শতাংশ। উল্লেখ্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগসমূহের মধ্যে মহিলা ও শিশু, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ বিভাগ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় এবং পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের মোট বাজেটের একটি বড় অংশ নারী উন্নয়নে ব্যয় হয়ে থাকে। নারীর ক্ষমতায়ন, দক্ষতা বৃদ্ধি ও সরকারি সেবা প্রাপ্তিতে সুযোগ বৃদ্ধি- এই তিনটি মূলভাবকে সামনে রেখে এই বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়।
চলতি বছর জেন্ডার বাজেটের উল্লেখযোগ্য দিক হলো নারীর আয়কর সীমা ৩ লক্ষ টাকা পর্যন্ত করমুক্ত রাখা যা পূর্ববর্তী বছরগুলোর মতো এবং নারী উদ্যোক্তা যদি তার ব্যবসার জন্য দোকান ভাড়া করেন তাহলে তা ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখা। এছাড়া সামগ্রিকভাবে তরুণ উদ্যোক্তাদের একটি বিশেষ বরাদ্দ রাখা হয়েছে যা ইতিবাচক। কারণ দেখা যাচ্ছে এখন তুলনামূলক তরুণ নারীসমাজ ছোট ছোট উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছেন, সেই দিক থেকে তাদের জন্য সেই বরাদ্দ বেশি ব্যয় হওয়া বাঞ্চনীয়। অন্যদিকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ভাতার পরিমাণ ও আওতা বৃদ্ধি করা হয়েছে; বিশেষ করে বিধাব ভাতা, প্রসুতি মাতা, দু:স্থ মাতাদের জন্য জন্য এর আওতা ও বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে।
তবে জেন্ডার বাজেটের অন্যতম দুর্বল দিক হচ্ছে, এর যথাযথ বাস্তবায়ন ও মনিটরিং না থাকা। প্রতিবছর জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদনের নারীর কতটুকু অগ্রগতি হলো তার তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করা হয় না। এছাড়া ৩০ভাগ বাজেট বরাদ্দ আসলেই হয়েছে কিনা বা তার কী কী ভাবে বাস্তবায়িত হবে সেই সম্পর্কে কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বাজেটে উল্লেখ করা হয় না। বাজেট ও প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে তাই দায়সারাভাবে সেগুলো প্রকাশ করা হয়; এমনকি বাজেট বক্তৃতায়ও তা কোনরকমে পাঠ করা হয়।
নারী উন্নয়নের অন্যতম দিক হলো- নারীর নিরাপত্তা, দক্ষতা বৃদ্ধি ও সহিংস্ হ্রাস; যা সিডও এবং নারী উন্নয়ন নীতিমালা বাস্তবায়নের অন্যতম অনুসঙ্গ। কিন্তু বিগত অর্থবছরগুলোতে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সমস্যাগুলো চিহ্নিত থাকলেও তা সমাধানে সুনির্দিষ্ট কী কী পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে এবং বাস্তবায়ন কতটুকু হয়েছে অর্থাৎ কতজন নারীর উন্নয়ন বা সুফলতা পেয়েছে তার কোন প্রতিবেদন প্রদান করা হয় না। এছাড়া বছর বছর বরাদ্দকৃত অর্থ সবটুকু ব্যয় না হওয়ার চিত্রও পাওয়া যায়।
নারীর প্রতি সহিংসতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। যৌতুকের কারণে নির্যাতন, খুন, ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যা এই ধরণের অপরাধগুলো দিন দিন বেড়ে চলেছে। কিন্তু এই অপরাধ নিরসনে সচেতনতা বৃদ্ধিসহ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ বা কাঠামোগত কী কী সুরক্ষা দেওয়া হবে সেবিষয়ে কোন পরিকল্পনার কথা বাজেটে বলা নেই।
অতএব, দায়সারাভাবে বছর বছর জেন্ডার বাজেট না দিয়ে বরং সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে চিহ্নিত সমস্যাগুলো সমাধানে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন ও যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ, নারীর নিরাপত্তা বিধান, নারী বান্ধন পরিবেশ, দক্ষতা বৃদ্ধি, আর্থিকখাতে নারীর অভিগম্যতা বৃদ্ধি, করের বোঝা কমানো, জেন্ডার সংবেদনশীলতা বৃদ্ধিও জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রতিবছর জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদনে নারীর তুলনামূলক অগ্রগতি তথ্য-উপাত্তসহ তুলে ধরতে হবে; যার মাধ্যমে নারীর সত্যিকার উন্নয়নের বিষয়টি সকলের কাছে স্পষ্ট হবে। যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য বাড়াতে হবে নজরদারি, সত্যিকার নিপীড়িত-বঞ্চিত নারীদের জীবনমান-মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য ব্যয় হতে হবে।
# লেখক : সহকারী পরিচালক, কোস্ট ট্রাস্ট