অ্যাসিড হামলার শিকার অর্নিকার ঘুরে দাড়ানোর গল্প
অনলাইন ডেস্ক
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০১:৫৯ পিএম, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ মঙ্গলবার
নানা প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে এখন চাকরি করছেন অর্নিকা মাহরীন
মাত্র ১৩ বছর বয়সে অ্যাসিড হামলার শিকার হয়েছিলেন ঢাকার ধামরাইয়ের মেয়ে অর্নিকা মাহরীন, এরপর শিকার হয়েছেন সামাজিক হয়রানির। তবে আজ সবকিছু পেছনে ফেলে তিনি একটি ভালো চাকরি করছেন।
অর্নিকা মাহরীনের বয়স যখন মাত্র তের বছর, তখন তার একজন দূর সম্পর্কের মামা তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। তিনি তাতে রাজি হননি।
কয়েকদিন পরে অর্নিকা যখন বাসা থেকে বের হচ্ছেন তখন সেই আত্মীয় তার মুখে অ্যাসিড ছুড়ে মারে।
অর্নিকা মাহরীন।বলেন, 'আমার মনে হচ্ছিল মুখের মাংস যেন গলে গলে পড়ে যাচ্ছে, সেখানে যেন বলকানি উঠছে। আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। যখন জ্ঞান ফিরে পেলাম, তখন দেখতে পেলাম যে আমাকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
এরপর দীর্ঘদিন হাসপাতালে থেকে তাকে চিকিৎসা নিতে হয়। সুস্থ হলেও তার ঠোঁট ও নাকের অংশ, মুখে চামড়া অ্যাসিডে গলে গিয়েছিল।
সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে আসার পরে তাকে পড়তে হয় নতুন সমস্যায়। যদিও পরিবারের সদস্যরা তাকে সব রকম সহায়তা দিয়েছেন, কিন্তু স্কুলে তিনি বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন।
অর্নিকা মাহরীন বলেন, 'অনেকে আমার সাথে কথা বলতো না। অনেকে আমাকে দেখে ভয় পেতো। রাস্তায় বাচ্চারা থাকলে আমি বের হলে তারা চিৎকার দিয়ে চলে যেতো। তখন প্রতিবেশীরা বলতো, তোমার এই চেহারা দেখে আমাদের বাচ্চারা ভয় পায়, তুমি বের হয়ো না।
'তিনি বলেন,স্কুলে যেতাম, সেখানে এক সময় যারা আমার ভালো বন্ধু ছিল, তারা আমাকে দেখে ভয় পেতো। তারা আমার সাথে একই বেঞ্চে বসতো না। অনেকগুলো বছর এভাবে মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। তবে পরিবারের সদস্যরা সবসময়ে পাশে ছিলেন।
চিকিৎসার সূত্রে তার সঙ্গে পরিচয় হয় নাসরীন পারভিন হকের সঙ্গে। তিনি অর্নিকাকে নারীপক্ষ নামে মেয়েদের একটি সংগঠনে নিয়ে আসেন।
অর্নিকা মাহরীন বলেন, আমার জীবনে তাঁর অবদান অনেক বেশি। তিনিই আমাকে মানসিকভাবে সাহস যুগিয়েছেন, সাথে রেখে চলতে শিখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তুমি লজ্জা পাবে কেন, তুমি প্রকাশ্যে চলাফেরা করবে। তুমি তো কোন অন্যায় করোনি।
অর্নিকা বলেন, তখন আমি তো একদম কালো বোরকা, কালো চশমা, হাতমোজা পড়ে বাইরে বের হতাম। তার সমর্থনে আমি বোরকা ছাড়া বাইরে বের হতে শুরু করলাম। তিনি বললেন, তুমি তো বেঁচে আছো, তোমার চেয়েও অনেকে খারাপ অবস্থায় আছে। তোমরা গুটিয়ে থাকলে তাদের আমরা কেমন করে বোঝাবো?
এরপর আস্তে আস্তে পড়াশোনা শেষ করেন অর্নিকা মাহরীন। পড়াশোনার পাশাপাশি অ্যাকশনএইড বাংলাদেশে চাকরি হয় অর্নিকার। সেই চাকরির মাধ্যমে সারাদেশ ঘুরে অ্যাসিড হামলার শিকার ভুক্তভোগীদের নিয়ে কাজ করতে হতো।
তিনি বলেন, তখন আমি বুঝেছি, সারা দেশে কত মানুষ এরকম ভুক্তভোগী আছে। আমার চেয়েও কতজন খারাপ অবস্থায় আছে। আমি তাদের বুঝিয়েছি।
এখন তিনি বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। পাশাপাশি প্রতিবন্ধীদের সেবায় গঠিত একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন।
অর্নিকা মাহরীন বলছেন, কোন মেয়ে যখন অ্যাসিড হামলার শিকার হন, তখন তার সবচেয়ে বেশি দরকার পরিবারের সমর্থন।
'তিনি বলেন, যখন সমাজের প্রত্যেকটা মানুষ আমাকে অবহেলা করেছে, আমাকে দেখে ভয় পেয়েছে, তখন আমি পরিবার থেকে সম্পূর্ণ সমর্থন পেয়েছি। তারা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, তোমার ওপরের চামড়াটা পুড়ে গেছে, কিন্তু তোমার মন পোড়েনি, তোমার যোগ্যতা পোড়েনি।
অর্নিকা বলেন, এই যে একটা সাহস, সেটাই কিন্তু আমার পরবর্তী জীবনে সামনে এগিয়ে আসার জন্য অনেক বেশি কাজ করেছে। সেই সঙ্গে নিজের ওপর বিশ্বাস রাখাটা খুব জরুরি বলে তিনি মনে করেন।
তিনি জানান, অ্যাসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশনের সহায়তায় অর্নিকা মাহরীনের মুখে ১৩টি অস্ত্রোপচার করা হয়। নাকের মাংস, ঠোটের ওপরের অংশ, চোখের পাতা - বিনা পয়সায় এসব অস্ত্রোপচার করে অনেকটা ঠিক করে দেয় সংস্থাটি।
তিনি আরও জানান, যে দূর সম্পর্কের আত্মীয় অর্নিকা মাহরীনের ওপর অ্যাসিড হামলা করেছিল পরবর্তীতে বিচারে তার ৩১ বছরের কারাদণ্ড হয়। কিন্তু দশ বছর কারাভোগ করে পরে সে বিশেষ ক্ষমায় বেরিয়ে আসে। তবে ওই ব্যক্তি এবং তার পরিবার তাদের গ্রাম থেকে অন্যত্র চলে গেছে।
বাংলাদেশে অ্যাসিড হামলার শিকারদের নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান অ্যাসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশন বলছে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশে অ্যাসিড সন্ত্রাসের ঘটনা নাটকীয়ভাবে কমে গেছে। তবে বেড়েছে নারীর উপর অন্যান্য ধরণের সহিংসতা।
সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক সেলিনা আহমেদ এনা বলেন, সরকারি পর্যায়ে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দুটি কঠিন আইন প্রণয়ন করায় এই অপরাধ কমেছে। গণমাধ্যমও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এই অপরাধ দমনে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা অনলাইন