স্মরণে প্রভাবতী দেবী সরস্বতী
আইরীন নিয়াজী মান্না
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০২:৩১ এএম, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ শনিবার
প্রভাবতী দেবী সরস্বতী
নিজের সময়ে তিনি ছিলেন দুর্দান্ত জনপ্রিয় সাহিত্যিক। কিন্তু এখন আর কেউ সে ভাবে মনেই করতে পারেন না প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর নাম। বর্তমান প্রজন্ম তাকে একেবারেই চেনে না বললে চলে। কিন্তু চিরদিন বঞ্চিত নারী সমাজের কথাই বলে গেছেন তিনি তার লেখনির মাধ্যমে। সমাজে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় করে গেছেন নানা রকম কাজ। নারী শিক্ষায় তার অবদান অসাধারণ।
১৯০৫ সালের ৫ মার্চ পশ্চিমবঙ্গের গোবরডাঙার খাঁটুরা গ্রামে জন্ম তার। প্রায় মাস তিনেক গলব্লাডারের অসুখে ভুগে কলকাতার পাতিপুকুরের নিজ বাসায় ১৯৭২ সালের ১৪ মে প্রভাবতী দেবী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তার বাবা গোপাল চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন আইনজীবী। প্রভাবতী দেবীর প্রথাগত শিক্ষা না থাকলেও খুব অল্প বয়েসেই পিতার উৎসাহে কীটস, শেলী, বায়রন প্রভৃতি কবির কবিতা পড়ে ফেলেন।
মাত্র ন’বছর বয়সে গৈপুর গ্রামের বিভূতিভূষণ চৌধুরীর সঙ্গে তার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। মায়ের থেকে আলাদা হয়ে যেতে কষ্ট হয়েছিল ছোট্ট প্রভাবতীর। কিন্তু সেই কষ্ট নিয়ে বিরূপ মন্তব্য আসে শ্বশুরবাড়িতে। ন’ বছরের মেয়ে আর দ্বিতীয়বার ভাবেনি। সোজা মাঠঘাট ভেঙে বাপের বাড়িতে ফেরা। চিরতরে সম্পর্ক বিচ্ছেদ। বাবাও আর মেয়েকে ফেরানোর চেষ্টা করেননি।
প্রভাবতী দেবী ব্রাহ্ম গালর্স ট্রেনিং কলেজ থেকে টিচার্স ট্রেনিং সার্টিফিকেট অর্জন করে উত্তর কলকাতার সাবিত্রী স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। পরে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের উদ্যোগে তিনি কলকাতা পুরসভা পরিচালিত বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।
নিজ গ্রাম খাঁটুরার ‘বঙ্গ বালিকা বিদ্যালয়’ যখন বিলুপ্তির পথে তখন প্রভাবতী দেবী নিজের প্রতিভা ও কর্মদক্ষতায় তাকে ‘খাঁটুরা বালিকা বিদ্যালয়’ নামে পুনরুজ্জীবিত করে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
সমাজসেবা, দেশপ্রেম ও নারী প্রগতিতে তিনি বিশেষ ভাবে উৎসাহী ছিলেন। ওই অঞ্চলে সরোজ নলিনী নারী মঙ্গল সমিতির শাখা কেন্দ্রের সভানেত্রী ছিলেনতিনি। ‘বিপ্লবীর স্বপ্ন’ উপন্যাসটি প্রভাবতীর স্বদেশপ্রেমের সাক্ষ্য বহন করে।
মাত্র ১১ বছর বয়সে তার প্রথম কবিতা ‘গুরুবন্দনা’ প্রকাশ পায় তত্ত্বমঞ্জরী পত্রিকায়। প্রথম গল্প ‘টমি’ প্রকাশ পায় অর্চনা পত্রিকায়, ১৯২২ সালে। প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর বলিষ্ঠ লেখনী সেই সময় খুব নাম করেছিল। সামাজিক বিষয় ছিল তার লেখার মূলধন। হিন্দু ধর্মের আদর্শ ও মূল্যবোধও পাওয়া যায় তার লেখায়।
১৯২৩ সালে তার রচিত প্রথম ধারাবাহিক উপন্যাস ‘বিজিতা’ প্রকাশিত হয় জলধর সেন সম্পাদিত ভারতবর্ষ পত্রিকায়। পরবর্তীকালে এই উপন্যাসটি বাংলা, হিন্দি ও মালয়লম ভাষায় যথাক্রমে ‘ভাঙাগড়া’, ‘ভাবী' ও ‘কুলদেবম্’ নামে চলচ্চিত্রও হয়। বাংলায় ‘ভাঙাগড়া’ ও হিন্দিতে 'ভাবী' চলচ্চিত্রগুলি খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে।
সাবিত্রী দেবী স্কুলে শিক্ষকতা করার সময় তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্য লাভ করেন। কবিগুরু তাকে সাহিত্য রচনাতে যথেষ্ট উৎসাহ দিয়েছেন। শোনা যায়, তার ‘মাটির দেবতা’ উপন্যাসটি লেখার পিছনে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ প্রভাব এবং উৎসাহ ছিল। পরে তিনি নিজের ছোট বোন হাসিরাশি দেবীকেও কবির কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। হাসিরাশিও ভাল লিখতেন, ছবিও আঁকতে পারতেন। রবীন্দ্রনাথ তার নাম দিয়েছিলেন ‘চিত্রলেখা’।
তিনশোরও বেশি বই রয়েছে প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর। উপন্যাস, গল্প, কবিতা, গান, গোয়েন্দা কাহিনি-সমস্ত সাহিত্যিক সংরূপ নিয়েই পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন। বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী গোয়েন্দা চরিত্রের স্রষ্টাও এই প্রভাবতীই। গোয়েন্দা চরিত্র কৃষ্ণা তার অনন্য সৃষ্টি।
কৃষ্ণা সিরিজের কৃষ্ণা নামের একটি মেয়ে ডিটেকটিভের সাহস ও দক্ষতা নিয়ে তিনি অনেকগুলি বই লিখেছিলেন। দূরদৃষ্টিার কারণে সেই সময়ের কৃষ্ণাকে তিনি আজকের যুগের সাহসী ও স্মাট নারীর আদলে সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন।
সেই সময় তার ‘ইন্টারন্যাশনাল সার্কাস’ ছোটদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। তার উপন্যাস পথের শেষে 'বাংলার মেয়ে' নামে নাটক হয়েছে এবং সাফল্যের সাথে মঞ্চস্থ হয়েছে।
তিনি বাঁশরী, সারথি, উপাসনা, উদ্বোধন, সম্মিলনী, মোহাম্মদী ইত্যাদি পত্রিকায় লেখালিখি করতেন।
প্রভাবতী দেবীর নামের সঙ্গে ‘সরস্বতী’ যুক্ত ছিলো না। তার অসাধারণ সাহিত্য প্রতিভার স্বীকৃতি হিসেবে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে নবদ্বীপের পণ্ডিতসমাজ তাকে ‘সরস্বতী’ উপাধি দেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ‘লীলা পুরস্কার’ পান।
নারী স্বাধীনতা, তাদের জীবন সংগ্রাম, শিক্ষাসহ নানা বিষয় নিয়ে তিনি অমৃত্যু কাজ করে গেছেন। তার লেখায় বার বার নারীর অবস্থাই উঠে এসেছে। ‘পল্লীসখা’ পত্রিকায় এক প্রবন্ধে প্রভাবতী লিখছেন— “মেয়েদের শাসন আমাদের দেশে বড়ই কড়া। তাহাদের অতি শিশুকাল হইতেই কঠোর শাসনের তলে থাকিতে হয়। যে সময়টা বিকাশের, সে সময়টা তাহাকে বন্ধ করিয়া রাখা হয়। ...অন্য দেশে যে সময়টা বালিকাকাল বলিয়া গণ্য হইয়া থাকে, আমাদের দেশের মেয়েরা সেই সময়ে গৃহের বধূ, অনেক সময়ে সন্তানের মা।” নিজের ছোটবেলার জন্য কি বারবার আক্ষেপ হত প্রভাবতীর!!
# আইরীন নিয়াজী মান্না, লেখক ও সাংবাদিক। সম্পাদক : উইমেননিউজ২৪.কম