নারী ও শিশু নির্যাতন: পরিবর্তনের ভাবনা
এম বি আখতার
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ১২:১৫ এএম, ৩ অক্টোবর ২০১৯ বৃহস্পতিবার
এম বি আখতার
কিছু দিন যাবত দেশের পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে অনেক বেশি আলোচনা, সমালোচনা হচ্ছে। বুঝে না বুঝে আমরা কথা বলছি, ধর্ষণকারীর ফাঁসি চাইছি, কেউ কেউ শিশুর হাতে প্ল্যাকার্ড ধরিয়ে দিয়ে সমাজ পরিবর্তন ও সমাজ সচেতন করার চেষ্টা করছি। বিভিন্ন টেলিভিশনের আলোচনায় সুধিজন, বিশেষজ্ঞ ও সুশীল সমাজ কথা বলছেন, করণীয় বলছেন, কিন্তু কে করবে এবং কী ভাবে করবে তা কিন্তু চিহ্নিত হচ্ছে না। মন্ত্রী মহোদয়গণ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে যে বাণী উপস্থাপন করছেন যা সত্যিই হাস্যকর।
আমাদের দেশে মাঝে মাঝে কিছু বিষয় নিয়ে অনেক আলোচনা হয় আবার তা থেমে যায়, নতুন আলোচনার বিষয় সামনে চলে আসে পুরাতন গুলি স্মৃতি হয়ে যায়। ব্যক্তিগতভাবে সামাজিক গণমাধ্যমে বিল্পব করার চেয়ে জনগণের মাঝে গিয়ে কাজ করাকেই বেশি কার্যকর মনে করেছি এবং করি। আমরাই পারি প্রচারাভিযানের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি পারিবারিক নির্যাতনের মত সংবেদনশীল একটি বিষয়কে নিয়ে জনগণের চিন্তা ও আচরণের পরিবর্তন সম্ভব।
অনেকে বলেছেন এই সংবেদনশীল বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে জনগণ প্রস্তুত নয়। কারণ পারিবারিক নির্যাতনের সাথে বৈবাহিক ধর্ষণ এর মতো আচরণ গুলিও জড়িত। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হচ্ছে জনগণের ব্যক্তি আচরণ ও চিন্তার পরিবর্তনে বিকল্প আচরণ ও চিন্তা করার সুযোগ দিলে পরিবর্তন সম্ভব। ভিন্ন মত ও পথ থাকা সত্বেও যে কোনো বিষয় আলোচনার মাধ্যমে সমাধান আসতে পারে যদি পরিবারে ও সমাজে সেই আলোচনার পরিবেশ তৈরি করতে পারি।
বছরের পর বছর সহিংস পারিবারিক সম্পর্কের চেয়ে সম্পর্কের বিচ্ছেদ শ্রেয়; কিন্তু দেখা যায় এখনও সমাজ পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মর্যাদার বিবেচনায় সহিংসতাকেই গ্রহণ করে। দুটি জীবনকে রক্ষা করার মতো সচেতন চিন্তার সুযোগ বা পরিবেশ আমাদের সমাজ তৈরি করতে পারছে না।
মনে থাকার কথা, প্রায় ২৫ বছর আগে দিনাজপুরে কিশোরী ইয়াসমীন হত্যাকাণ্ডের কথা। সারাদেশ জ্বলে উঠেছিল, সেই স্ফলিঙ্গের তাপ বেইজিং সম্মেলন পর্যন্ত পৌঁছেছিল। সরকার পতনের অবস্থা সৃষ্টি হয়তখন। সেই ঘটনার বিচার হয়েছে, দোষীদের মৃত্যুদণ্ডের সাজাও কার্যকর হয়েছে। যদি ঐ ঘটনার পরের নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনাগুলির তালিক প্রণয়ন করি তাহলে কয়েক হাজার ছাড়িয়ে যাবে। অর্থাৎ শুধুমাত্র আইনের প্রয়োগ যথেষ্ট নয়। প্রতিদিন শত শত ঘটনা ঘটছে এর কয়টি খবরে আসে?
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, নারী বা শিশু নির্যাতনের ঘটনার মাত্র দুই ভাগ মানুষ জানতে পারে,
আর পত্রিকায় আসে তার চেয়েও কম। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম এর পরিসংখ্যানে দেখিয়েছে যে, গত জানুয়ারি-অক্টোবর ২০১৭ সালে মোট ৫০১ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে তাদের ১৮ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এই পরিসংখ্যান পত্রিকা থেকে নেওয়া। ঘরের ভেতর নিকটজন দ্বারা এমনকি বাবা বা বাবা-মা সম্পর্কীয় আত্মীয় দ্বারা শিশুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে; তা কিন্তু পরিবারের মর্যাদা ও বাবা-মায়ের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার স্বার্থে প্রকাশ করা হয় না। সব ঘটনা সায়মা, রিফাত বা ইয়াসমীনের মতো দেশব্যাপী আলোড়িত হয় না।
সেই কারণে সমাজে ও রাষ্ট্রে বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে এবং নির্যাতনের শিকার নারী, শিশুর পরিবার বিচার ব্যবস্থায় আশানুরূপ আস্থা রাখতে পারছে না। আজ সায়মার মর্মান্তিক মৃত্যু আমাদের মনকে নাড়া দিয়েছে। শিশুটির বাবার কথায় আমরা নিজেদের সচেতন হওয়ার কথা বলছি। সায়মা কিন্তু প্রথম ভিকটিম না, এর আগেও শত শত ঘটনা ঘটেছে এবং এর পরেও ঘটবে না এমনটি চ্যালেঞ্জ করা দুষ্কর।
এইতো কিছু দিন আগে আট মাসের শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে, চার বছরের তানহাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। আমরা বলেছি ধর্ষণকারী মানুষ নয় পশু, এটুক বলাই যথেষ্ট? গাইবান্ধার তৃষাকে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে, নির্যাতনকারীরা এখন স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে, পরিবারে বসবাস করছে। দিনাজপুরের পুস্পিতাকে ধর্ষণ করা সেই নির্যাতনকারীর জামিনের প্রক্রিয়া চলছে। এই নির্যাতনকারীরা একসময় ক্ষমতার প্রভাবে ও আইনের সরু গলি দিয়ে বের হয়ে সমাজে বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করে বা করছে। বাবা-মা বা আত্মীয়-স্বজন ও সমাজ নির্যাতনকারীদের পারিবারিক অথবা সামাজিকভাবে বয়কট বা ঘৃণা করছে না।
জাতিসংঘ গত ২০১০- ২০১৩ সালের মধ্যবর্তী সময়টাতে পুরুষ এবং সহিংসতা বিষয়ক বহুদেশীয় এক সমীক্ষা পরিচালনা করে। সমীক্ষায় বাংলাদেশের গ্রামীণ ও শহরেরে এক হাজার ২৫২ জন পুরুষের মধ্যে এই সমীক্ষা পরিচালিত হয়। তাদের জিজ্ঞাসা করা হয়, তারা কখনও কোনো নারীর উপর বলপূর্বক যৌন আচরণ করেছেন কিনা? সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ১০ শতাংশ পুরুষের উত্তর ছিলো হ্যাঁ। এতে দেখা যায়, এক হাজার ২৫২ পুরুষের মধ্যে ১২৫ জন পুরুষ দ্বারা নারী যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, সবাই কি তার কৃতকর্ম স্বীকার করেন? যদি জানেন ঘটনাগুলি ফৌজদারী অপরাধ তাহলে অবশ্যই না। সমীক্ষায় এটাও দেখা যায় যে, প্রায় অর্ধেক ধর্ষণকারী একাধিকবার নারীকে ধর্ষণ করেছেন। বেশিরভাগ ধর্ষণকারী তার কৃতকর্মকে অপরাধ মনে করেন না। ভাবনার বিষয় হচ্ছে ৯৫ শতাংশ ধর্ষণকারী কোন প্রকার আইনগত সমস্যায় পড়েনি। তাদের বিরুদ্ধে কোনো নালিশ বা মামলাও হয়নি। কারণ অনুমেয়, সমাজ ধর্ষণকারীর চেয়ে ধর্ষণের শিকার নারীকেই খারাপ ভাবে মূল্যায়ন করে।
আন্তর্জাতিক অন্য এক সমীক্ষায় দেখা যায়, পৃথিবীর ২১টি উচ্চ ও মধ্যম আয়ের দেশে ৭.৩৬ শতাংশ নারী ও ৩.২৯ শতাংশ পুরুষ শিশুকালে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বিষয়টি ভয়াবহ। কিন্তু এ বিষয় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র কতটা সচেতন ও প্রতিরোধে কতটা সক্রিয়।
সমাজের রীতি, নীতি ও মূল্যবোধ তৈরিতে পুরুষের ভূমিকা অনেক বেশি। এবং বেশিরভাগ পুরুষ মনে করেন, নারী যদি শারীরিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে তাহলে পুরুষের পক্ষে ধর্ষণ করা সম্ভব নয়। সমাজের কাছে প্রশ্ন, একজন শিশু কীভাবে প্রতিরোধ তৈরি করবে! সে তো জানে না তার সাথে কি হতে যাচ্ছে বা কি হচ্ছে। মেয়ে বা নারীর অথবা বিবাহিত স্ত্রীর ক্ষেত্রে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ইতিবাচক ইচ্ছা থাকতে হবে সেটিও তো পুরুষদের বিশ্বাসে নেই। দুদিনের সম্পর্ক হলেই নারী দেহ ভোগের অধিকারী হতে চায় বেশিরভাগ পুরুষ। অনেক ক্ষেত্রে এমন কিছু মানসিক, সামাজিক বা অর্থনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নেওয়া হয় যেখানে নারীর পক্ষে প্রতিরোধ সম্ভব হয় না পাশবিক হিংস্রতার কাছে নিজেকে সমর্পন করতে বাধ্য হয়।
প্রাণীদের নিয়ে কোন এক টিভি চ্যানেলে দেখেছিলাম, কুমির যখন নদীতে শিশু হরিণকে আক্রমণ করতে যাচ্ছে ঠিক সেই সময় মা হরিণ মাঝে চলে আসে। কুমিরের আক্রমণ থেকে নিজ সন্তানের জীবন রক্ষা করে। এমন ঘটনা কি মানব সমাজে হচ্ছে না? কয়েক দিন আগে পত্রিকায় এলো নারায়ণগঞ্জে একজন শিক্ষক তার ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে এবং সেই ধর্ষণের ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়েছে ছাত্রীকে। ওই ছাত্রীর মাকেও ধর্ষণ করেছে সে। এখানে মাÕর পক্ষে প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল? হয়তো না, কারণ মেয়ের জীবনে এমন ঘটনা হয়েছে তা কি আমাদের সমাজ সহজভাবে নেবে?
সে জন্য এমন ঘটনাগুলিকে দুর্ঘটনা হিসেবে নেওয়ার পরিবেশ তৈরি করতে হবে সমাজে, ধর্ষণকারীকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা, সামাজিকভাবে ঘৃণা করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। নারীদের ভাবতে হবে, মুখ বুজে সহ্য করার চেয়ে প্রতিবাদ করে নির্যাতনকারীদের চিহ্নিত করতে পারলে একসময় সমাজ বদলাবে। নারীর প্রতিবাদকে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র ইতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করবে।
শিশুর প্রতি যৌন আচরণ, নির্যাতন শুধুমাত্র আমাদের দেশে হচ্ছে এমন নয়। বিষয়টি বিভিন্ন দেশে সংগঠিত হয়। তবে উন্নত দেশগুলোতে বিষয়টিকে সরকারিভাবে স্বীকার করে প্রতিরোধের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
প্রশ্ন হচ্ছে এই ধরনের ঘটনা আগেও ঘটেছে বলে এখনও ঘটবে, অন্য দেশে হচ্ছে বলে আমাদের দেশে তা চলমান থাকবে; প্রতিবাদ প্রতিরোধ হবে না এবং সমাজ মেনে নিবে, নিশ্চয়ই এমনটা হতে পারে না।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার হিসেব অনুসারে, শিশু ও যুব বয়সের জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তাই অগ্রহণযোগ্য ও বলপ্রয়োগে যৌন সম্পর্ক, নারীর মর্যাদা, শিশুর সাথে আচরণ সম্পর্কিত বিষয়ে পরিবার, সমাজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনতে হবে। খোলামেলাভাবে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে হবে, ছেলে সন্তানকে ১৪ বছর বয়স থেকেই শিক্ষা দিতে হবে যৌন আচরণ কি, যৌনতা কি এবং যৌন সম্পর্কে ইচ্ছা বা অনিচ্ছার অর্থ কি, যৌন সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া কি এবং কিভাবে নিজের যৌন আকাংখাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ইত্যাদি। পুরুষ সমাজে প্রচলিত মিথ হচ্ছে একজন মেয়ের সাথে বন্ধুত্বর সম্পর্ক হলে, মেয়ে বন্ধু হেসে কথা বললেই তার শরীর স্পর্শ করা যাবে। কিশোর বয়সের ছেলে সন্তানরা এটি খুব তাড়াতাড়ি রপ্ত করে ফেলে এবং ব্যক্তি আচরণে এক ধরনের আগ্রাসী মনোভাব তৈরি হয়, যা তাদের ধর্ষক হিসেবে আচরণ করতে সহায়তা করে।
আমাদের দেশের আইন বলছে ১৬ বছর (যদিও এই বয়সটি ১৮ হওয়া উচিৎ ছিলো) বয়সের আগে কোন মেয়ে শারীরিক সম্পর্কের ইচ্ছা প্রকাশ করলেও তা আইনের চোখে গ্রহণযোগ্য নয়। বাবা হিসেবে সন্তানের সাথে এই কথা গুলি আলোচনা হওয়া প্রয়োজন, এই কথা গুলি নিশ্চয়ই অপবিত্র নয়। সমাজে নারী-পুরুষের যৌন আচরণ, যৌন আকাংখা ও যৌনতা নিয়ে কথা বলাকে অপবিত্রতার সাথে তুলনা করা হয়।
পাশাপাশি কন্যা শিশুদের আচরণ পাঁচ থেকে ছয় বছর বয়স থেকেই শিক্ষা দেয়া প্রয়োজন তার শরীরের কোন কোন অংশে মা ছাড়া অন্য কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। যদি করে তাহলে সে যেন তার মাকে যত শীঘ্রই জানায়| মায়ের উচিৎ হবে বড়দের সাথে আলোচনা করা, কেন মেয়েদের সব জায়গায় আদারের ছলে স্পর্শ করতে নেই। এই আলোচনাগুলি পরিবারের মধ্যে হওয়া প্রয়োজন এ কারলে যে, শিশু ও মেয়েরা সবচেয়ে বেশি যৌন নির্যাতন ও যৌন হয়রানির শিকার হয় পরিবারে পরিচিত জনদের দ্বারা, যা কাউকে বলা যায় না বা বিশ্বাসযোগ্য হয় না। মেয়েকে যৌন নির্যাতন ও হেনস্তা থেকে মুক্তির জন্য সমাজে তথাকথিত ভাবধারা, মূল্যবোধ, নিয়মনীতি, ইচ্ছা অনিচ্ছার ও চলাফেরায় নিয়ন্ত্রণ করে শুধুমাত্র মেয়েদের ওপর এক ধরনের বেষ্টনী তৈরি করে সমস্যার সমাধান হবে না। কিশোর, যুব বা বয়স্ক পুরুষ হিসেবে আচরণে ও দৃষ্টিভঙ্গীতে পরিবর্তন নিশ্চিত করে নারীর বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে প্রমান রাখতে পারলে নারী ও শিশু নিজ অধিকার উপভোগ করার সুযোগ পাবে।
লেখক: কো-চেয়ার, আমরাই পারি পারিবারিক নির্য়াতন প্রতিরোধ জোট, বাংলাদেশ ও উন্নয়নকর্মী।