ঢাকা, মঙ্গলবার ২৬, নভেম্বর ২০২৪ ৮:৪৯:৩০ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

পুরাণ : শস্যদেবী দিমিতির

শান্তা মারিয়া

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৯:৩৪ পিএম, ৫ অক্টোবর ২০১৯ শনিবার

গ্রিক পুরাণে শস্য ও উর্বরতার দেবী হলেন দিমিতির। রোমান পুরাণেও তিনি মাতৃদেবী। রোমে তার নাম সিরিস। দিমিতির ছিলেন স্বর্গের অধিপতি ক্রনাস ও তার রানি রিয়ার সন্তান। তার ভাই-বোনরা হলেন জিউস, হেরা, পোসাইডন, হেডিস, হেস্টিয়া। দিমিতির হলেন কৃষিক্ষেত্রের দেবী। তিনি মানুষের জন্য মঙ্গলময়ী। বিখ্যাত ভাই-বোন থাকা সত্ত্বেও অলিম্পাসের দেবদেবীদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে দুঃখী। দিমিতির ও তার মেয়ে পার্সিফোন গ্রিক পুরাণের বিখ্যাত চরিত্র। জিউস ও দিমিতিরের ছিল এক মেয়ে তার নাম পার্সিফোন। দিমিতির তার মেয়েকে ভালোবাসতেন সবচেয়ে বেশি।

মৃতদের রাজ্য পাতালপুরীর রাজা হেডিস ছিলেন সদা বিষন্ন। হেডিসের বিষন্নতা দূর করার জন্য জিউস পার্সিফোনের সঙ্গে হেডিসের বিয়ের ষড়যন্ত্র করেন। পার্সিফোন একদিন সবুজ ফুলে ভরা মাঠে তার সহচরীদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন ও বুনো ফুল তুলছিলেন। সেই সময় কালো ঘোড়ায় টানা রথে চড়ে পাতাল থেকে হঠাৎ উঠে আসেন হেডিস। ভূমির এক বিশাল ফাটল দিয়ে উঠে আসেন তিনি। পার্সিফোনকে অপহরণ করে তিনি নিয়ে যান পাতালপুরীর অন্ধকারে। পার্সিফোন চিৎকার করে মাকে ডাকেন। মেয়ের চিৎকারে ছুটে আসেন দিমিতির। কিন্তু ততোক্ষণে হারিয়ে গেছেন পার্সিফোন।

প্রিয় সন্তানকে হারিয়ে দুঃখে ভেঙে পড়েন দিমিতির। বন্ধ হয়ে যায় শস্যের ফলন। সবকিছু হয়ে যায় বিবর্ণ ধূসর। সাধারণ এক বৃদ্ধার বেশে দেশে দেশে মেয়ের খোঁজে ঘুরে বেড়ান দিমিতির। ইলিউসিস রাজ্যে এসে হাজির হন তিনি। দেবীকে চিনতে না পারলেও করুণাবশে তাকে আশ্রয় দেন রাজা সেলিউস। সেলিউসের দুই শিশু সন্তান ডিমোফোন ও ট্রিপ্টোলেমাস। নবজাত ডিমোফোনের ধাত্রী করা হয় দিমিতিরকে। রাজার প্রতি কৃতজ্ঞ দেবী স্থির করেন ডিমোফোনকে অমরত্ব দেবেন। তিনি শিশুটির গায়ে গোপনে অ্যামব্রোজিয়া বা অমৃত মেখে দিলেন এবং প্রতি রাত্রে গোপনে তাকে অগ্নিকুণ্ডের ওপর ধরে রাখতেন। কিন্তু একদিন রানি মেটানাইরা শিশুকে আগুনের ওপর দেখে ভয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠেন ও শিশুকে কেড়ে নেন। দেবী তখন নিজের পরিচয় প্রকাশ করেন। তার উদ্দেশ্যের কথা খুলে বলেন। বলেন রানির জন্য শিশুটিকে অমরত্ব দেওয়া গেল না। ডিমোফোন আর অমরত্ব পায়না। তবে ট্রিপ্টোলেমাসকে তিনি কৃষিবিদ্যা শেখান। ফলে মানব সমাজে কৃষিবিদ্যার জনক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন ট্রিপ্টোলেমাস। একটি কাহিনিতে আছে ডিমোফোনের তৎক্ষণাত মৃত্যু হয়। আবার কোনো কাহিনিতে বলা হয় ডিমোফোনই ট্রিপ্টোলেমাস নামে খ্যাত হন।

পার্সিফোনের সন্ধানে দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়ান দিমিতির। অবশেষে সূর্যদেবতা হেলিওস তাকে পার্সিফোনের সন্ধান দেন। দিমিতির বুঝতে পারেন জিউসের চক্রান্তেই এটা ঘটেছে। জিউসের ওপর অভিমানে তিনি ফসল ফলানো বন্ধ করে দেন। সব শস্য ক্ষেত শুকিয়ে যায়। সব তৃণভূমি হয়ে যায় ঊষর। পার্সিফোনের শোকে দিমিতির সব ফসল উত্পাদন বন্ধ করে দিলে পৃথিবীতে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। চারিদিকে হাহাকার পড়ে যায়। না খেয়ে মরতে থাকে মানুষ ও পশু।

দেবতা ও মানুষের প্রার্থনায় কাতর জিউস তখন তার বার্তাবাহক দেবতা হার্মিসকে বলেন পাতালে গিয়ে হেডিসকে বলতে যেন পার্সিফোনকে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। হার্মিসের কথা শুনে আনন্দে লাফিয়ে ওঠেন পার্সিফোন। হেডিস জানতেন পার্সিফোনকে ফিরিয়ে দিতে হবে। তাই যাতে সে মৃত্যুপুরীতে ফিরে আসতে বাধ্য হয় সেজন্য খুব অনুনয় করে তাকে খাইয়ে দেন ডালিমের বীজ। পার্সিফোন চারটি বীজ মুখে দেন। জিউস তখন বিধান দেন পার্সিফোন বছরে আটমাস থাকবে মায়ের কাছে আর চারমাস থাকবে মৃতদের রাজ্যে হেডিসের কাছে। দিমিতির ও পার্সিফোনের কাহিনি গ্রিক পুরাণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। যে আট মাস দিমিতির তার মেয়েকে কাছে পান সে আট মাস তিনি ফসলে আর তৃণে ভরিয়ে দেন ক্ষেত্র। পৃথিবী তখন হয়ে ওঠে সজীব। আর যখন মেয়ে চলে যায় মৃত্যুপুরীতে তখন শীতের আগমনে সবকিছু হয়ে যায় ধূসর আর মৃত। দুঃখী দিমিতির মেয়ের শোকে ধরণীকে করে তোলেন শস্যহীন।

দিমিতিরের আরেক সন্তানের নাম প্লুটোস। এক কাহিনিতে রয়েছে পার্থিব মানব আয়াজিয়নের প্রেমে পড়েন দিমিতির। ক্রিট দ্বীপের এক কর্ষিত কৃষি ক্ষেত্রে আয়াজিয়নের সঙ্গে মিলিত হন দেবী। এই মিলনের ফলে জন্ম নেন প্লুটোস। তিনি মাটির নিচের ধন সম্পদের দেবতা। ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে আয়াজিয়ন বা ইজিয়নকে বজ্র ছুঁড়ে হত্যা করেন জিউস।

দক্ষিণ গ্রিসের আর্কেডিয়াতে দিমিতিরের আরেকটি কাহিনি প্রচলিত ছিল। সমুদ্রদেবতা পোসাইডন দিমিতিরের সঙ্গে মিলিত হতে চেয়েছিলেন। দিমিতির একটি ঘোড়ার রূপ ধরে তার কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু পোসাইডনও একটি ঘোড়ার রূপ ধরে তার পিছু ধাওয়া করেন। দিমিতির আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। এই মিলনের ফলে জন্ম নেন ঘোড়ার আকৃতির এক কন্যা ডেসপয়না এবং এরাইয়ন নামে একটি ঘোড়া-পুত্র।

আর্কেডিয়াতে ঘোটকীরূপেই দিমিতিরের পূজা করা হতো।
দিমিতিরের প্রতীক হলো লাল রঙের পপি ফুল। বার্লি ক্ষেতের মাঝখানে যা জন্মায়। প্রাচীন গ্রিসের ইলিউসিসে ছিল তার মন্দির। দিমিতিরের উপাসনা ও উত্সব  হতো বছরের দুটি সময়। অক্টোবরে ফসল তোলার সময় হতো একটি রহস্যময় উৎসব। এতে অংশ নিত মূলত নারীরা। আরেকটি উৎসবে নারী পুরুষ সকলেই অংশ নিতে পারতো।

দিমিতিরের পূজায় কী কী আচার অনুষ্ঠান পালন ও মন্ত্রপাঠ করা হতো সে সম্পর্কে পূজারীরা মন্ত্রগুপ্তির শপথ নিতেন। দিমিতির ও পার্সিফোনেকে একসঙ্গেও কল্পনা করা হতো কখনও কখনও। তারা ছিলেন জীবনের বৃত্ত, মৃত্যু ও জীবনের প্রতীক।  তাকে সিবিলি নামেও পূজা করা হতো।

বেশকিছু কাল্ট ছিল দিমিতিরকে ঘিরে। এর মধ্যে মৃত্যুর পর আবার বেঁচে ওঠা কিংবা পুনর্জন্মের কাল্ট ছিল। কখনও কখনও প্রাচীন কেলটিক শস্যদেবীকেও এক করে ফেলা হয় দিমিতিরের সঙ্গে। রাশিচক্রে দিমিতির অনেক সময় কন্যা রাশির প্রতীক হয়েছেন। যদিও কন্যা রাশির প্রতীক সাধারণত অ্যাস্ট্রাইয়া দেবীকে ধরা হয়।  

দিমিতিরের নাম  মাদার, মাতৃ, মেটার শব্দের সঙ্গেও সাদৃশ্যপূর্ণ। তিনি প্রাচীন মাতৃদেবী হিসেবে পূজিত হয়েছেন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ও এশিয়ার প্রাচীন সভ্যতাগুলোতে।দিমিতিরের পূজার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় মাইসিনিয়াতে ১৪০০-১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে।

আর্কেডিয়াতে দিমিতিরকে কল্পনা করা হতো মাথায় চুলের বদলে সাপ এবং হাতে ঘুঘু ও ডলফিন ধরা অবস্থায়। তার মানে মাটির তলার সম্পদের দেবী। মাটির নিচে পুতে রাখা বীজ থেকে নতুন গাছ জন্মায়, তেমনি মৃতদেহ থেকে নতুন জীবনের সূত্রপাত হবে এমন এক কাল্ট জড়িত ছিল দিমিতিরের পূজার সঙ্গে। লাল রঙের পপি ফুল দিমিতিরের প্রতীক হওয়ার কারণ লাল রঙ পুনর্জন্ম বা নতুন জীবন পাওয়াকে নির্দেশ করে।