কন্যাশিশুর স্বপ্নভঙ্গ: আমাদের দায়
সোমা দেব
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০২:২৩ পিএম, ৮ নভেম্বর ২০১৯ শুক্রবার
সোমা দেব : সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
শুরুতেই ছোট্ট একটি ঘটনা বলি। গত ১০ আগস্ট আমার গৃহকর্মে সাহায্যকারী মেয়েটি এসে বললো, মেয়ের বিয়ে দিয়ে আসলাম কালকে। আমি আঁতকে উঠে জিজ্ঞাসা করলাম, সেকি! কেন? উত্তর দিল, ভাল ছেলে পাইয়াছি, বিয়ে দিয়ে দিনু।
আমার আঁতকে উঠার কারণ আয়েশার (ছদ্মনাম) বয়স মাত্র তের বছর। ক্লাস এইটে পড়ছে। লেখাপড়ায়ও ভাল। পাশাপাশি নাচ, সেলাই এসবেও পটু। ভাল ছবি আঁকে। একমাত্র মেয়ে হওয়ায় এবং মেয়ের আগ্রহের কারণে অন্যের বাড়ি কাজ করে হলেও মেয়েকে এসব শেখাচ্ছিল সে।
সাহায্যকারী মেয়েটিকে বললাম, বেশ তো এত কিছু শেখাচ্ছিলে, কত ভাল করতো মেয়েটি! সে উত্তর দিল,‘মেয়ের বাপ-চাচা সবাই মিলে বিয়ে দিতে চাইছে, আমি একলা বাধা দিতে পারি? মেয়েও কান্নাকাটি করছিল, বলেছে, মা আমি বাল্যবিয়ে নিয়ে কত বক্তৃতা দিই, আমাকেই বাল্যবিয়ে দিয়ে দিলে?’
ঠিক এই পয়েন্টে এসেই আমার চিন্তাটা আটকে গেল। একটি কন্যাশিশু যার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে মেয়েকে স্বপ্নের পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তার শখ-আহ্লাদ পূরণ করছিলেন, কন্যাটি কেবল স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল, স্বপ্নপূরণের পথে একটি পা হয়তো বাড়িয়েছিল সে, কন্যাশিশুর এগিয়ে যাওয়ার পথে সমাজের বাধাগুলো সম্পর্কে বুঝতে শুরু করেছিল, তার আগেই সে তার নিজের স্বাধীনতা হারাল। এ কথা বলার কারণ আমাদের সমাজ এখনও বিয়ের পরেও নারীর নিজ ইচ্ছায় চলাফেরা থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে তার নিজের স্বাধীনতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছিনিয়ে নিচ্ছে। ওই মেয়েটিরও সমস্ত স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্খা মুথ থুবড়ে পড়ল। কত স্বপ্ন, সামনের দীর্ঘ একটা পথ, কত বড় হওয়ার সম্ভাবনা সব একটি দিনেই শেষ হয়ে গেল!
প্রশ্ন হচ্ছে, বাল্যবিয়ে বিষয়টি নিয়ে অনেক মহলই সচেতন। সমাজে বাল্যবিয়ে কমছেও। বাল্যবিয়ের শিকার শিশু নিজে, তাদের বন্ধু-বান্ধবী, স্কুল টিচার, অভিভাবক, স্থানীয় সরকার প্রশাসনসহ অনেকই বাল্যবিয়ে বন্ধ করছেন। সোচ্চার আছে গণমাধ্যমও। এসব কিছুর পরেও অগোচরে থেকে যায় আনাচে-কানাচে ঘটে যাওয়া অসংখ্য ঘটনা। যার শিকার হয়ত আয়েশার মতো হাজারো মেয়ে।
এর একটি বড় কারণ নারীর ক্ষমতায়ন। শুধু বড় বড় পদে নারীর অধিষ্ঠানই নয়। সর্বক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও নারীর ক্ষমতায়নের একটি বড় অংশ। সেটা পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন কর্মকান্ড পর্যন্ত। আমাদের সমাজে বেশিরভাগ পরিবারেই নারীরা এই সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় কোন ভূমিকাই পালন করতে পারে না। অতি কষ্টদায়ক প্রক্রিয়ায় সন্তান জন্মদান করে আবার সেই সন্তানকে কষ্ট করে বড় করে তোলে যে নারী, অন্যের বাড়িতে কাজ করে মেয়ের পড়াশোনা, শখ-আহ্লাদ পূরণ করছেন যে নারী, মেয়ের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে নিয়ে যাচ্ছেন যে নারী মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার বেলায় তার কোনো ভূমিকা নেই। সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন বাবা আর চাচারা। কারণ তারা পুরুষ। ক্ষমতায়নের এই অংশটিতে যতদিন নারীকে কাঠের পুতুল করে রাখা হবে ততদিন কন্যাশিশুরা তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারবে না।
যে কন্যাশিশুটিকে মাত্র তের বছর বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হলো সেও ভবিষ্যতে কখনও তার নিজের মেয়ের স্বপ্নভঙ্গের বেলায় একটি কথাও বলতে পারবে না। পারবে না তার নিজের মেয়ের বেলায় কোন সিদ্ধান্ত নিতে। এভাবে একের পর এক বৃত্তবলয়ে কন্যাশিশুরা তথা নারীরা আটকা পড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে-খাবে। এই গোলকধাঁধা থেকে বের হবার পথ বন্ধ করে রেখেছি আমরা-এই সমাজ।
এই গোলকধাঁধা থেকে বের হওয়ার উপায় কি কেউ কখনও বাতলেছেন? নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও, কখনও না কখনও সভায়, সেমিনারে, বক্তৃতায়, আলোচনায়, বৈঠকে, প্রবন্ধ-গল্প-কবিতায়, গবেষণায়, পরিবারে, রাষ্ট্রে কন্যাশিশুদের মেয়েমানুষ নয়, শুধু মানুষে পরিণত হওয়ার নানা উপায়, নানা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেসবের বাস্তবায়ন কোথায়? সারাদিন ঘরে-বাইরে, অফিসে, মিটিংয়ে, বড় বড় সভা, সেমিনারে কন্যাশিশুর পক্ষে, নারীকে মানুষে পরিণত করার নানা তরিকা বাতলে যে পরিবারে ফেরা হয়, সেই পরিবার থেকেই কি কেউ শুরু করতে পারছেন? হয়ত পারছেন। এদের সংখ্যায় খুব নগণ্য। বেশি সংখ্যক অংশই থাকছেন যারা এতসব ভাবনার আড়ালে থেকে যাচ্ছেন। কন্যা আর পুত্রকে আলাদাভাবে বড় করছেন। যতসব ভাল তার সবকিছুই পুত্রের। আর বাকিটা কন্যার। পরিবার থেকে যদি একটি শিশু, সে কন্যাই হোক বা পুত্র হোক, সঠিক শিক্ষাটা না পায়, বড় হয়ে সে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করবে। সমাজে যে ইতিবাচক পরিবর্তনগুলো করার তার একটিও অর্জিত হবে না। যে কারণে আমরা এখনও নারীকে ‘মেয়েমানুষ’, ‘মেয়েছেলে’ আখ্যা দিয়ে তার উপর নানা ফতোয়া আরোপ করছি। মানুষ বলে ভাবতে পারছিনা। সুস্থ পরিবেশে বড় করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর উপযুক্ত পরিবেশ দিতে পারছি না।
এই যে কন্যাশিশুর জন্য দরকার উপযুক্ত নিরাপদ পরিবেশ, তা কতদিনে, কবে অর্জিত হবে আমরা জানি কি? সাম্প্রতিক সময় দেশে কন্যাশিশু ধর্ষণ, নির্যাতনের ঘটনা অতি মাত্রায় বেড়ে যাওয়ার পর বন্ধুমহলের অনেককেই কন্যাশিশুর বাবা অথবা মা হিসেবে উদ্বিগ্ন হতে দেখছি। হয়তো আমরা সবাই উদ্বিগ্ন। সবাই এসব নিয়ে ভাবছি। অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে গিয়ে বিদেশে স্থায়ী আবাস গড়ার চিন্তা করছেন। কিন্তু এটা তো কার্যকরী, স্থায়ী সমাধান নয়। যারা এই পরিবেশের মধ্যেই থাকছি, বেঁচে থাকব তারা কীভাবে কন্যাশিশুদের জন্য একটা সুস্থ ভবিষ্যত গড়তে পারব, নির্বিঘ্ন পরিবেশ তৈরি করতে পারব সেই ভাবনাটাই অতি গুরুত্বপূর্ণ।
এখানেও বলব, এর জন্য চাই সমন্বিত উদ্যোগ। সেটা শুরু করতে হবে পরিবার থেকেই। শুধু কন্যাশিশুর বাবা-মায়েরাই চিন্তা করবেন, উদ্বিগ্ন হবেন বিষয়টা নিশ্চয়ইিএমন নয়। আরও বেশি উদ্বিগ্ন হওয়া প্রয়োজন যাদের এক বা একাধিক পুত্রশিশু রয়েছে। সেই পুত্রটিকে আমরা কন্যা-নারীদের কোন চোখে, কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে শেখাচ্ছি, নিরাপদ পরিবেশের ভিত্তিটাই সেখানে গ্রোথিত।
গত ঈদের কয়েক দিন আগে স্থানীয় একটি মার্কেটের গেটে রিক্সা থেকে নামছি, পাশ দিয়ে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া কয়েকটি ছেলে হেঁটে যাচ্ছিল কিছু একটা নিয়ে কথা বলতে বলতে। কয়েকটি বাক্য আমার কানে এল, এর মধ্যে একটি ছিল ‘ঈদের আগে মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে ভাল লাগে, সুন্দরী সুন্দরী সব মেয়েরা আসে... .. .. ..’ । লোভাতুর চোখগুলো একজন নারীর সৌন্দর্য গিলে খায় চোখের ক্ষুধা মেটাতে। এই মানসিকতার বাইরে বেরোতে না পারলে কন্যাশিশুর উপযুক্ত নিরাপদ পরিবেশ আমরা কোথায় পাব?
এই যে কন্যা বা নারী সম্পর্কে গৎবাঁধা ধারণা এটা কিন্তু পরিবার থেকেই তৈরি হচ্ছে। পুত্রশিশুকে আমরা একভাবে আর কন্যাশিশুকে অন্যভাবে বড় করছি। ভাল খাবার, ভাল পড়াশোনার সুযোগ- এইসব পুত্রের জন্যই তোলা থাকে। পুত্র সন্তানটি ছোটবেলা থেকেই দেখছে, ঘরের কাজ করা, তার জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখা, তার নোংরা করা জামাকাপড় ধোয়া, তার খাবার রান্না করে এগিয়ে দেয়া, খাবারের পর এঁটো প্লেট-বাসন পরিস্কার করা, তার নিজের এলোমেলো জামাকাপড় গুছিয়ে রাখা সবকিছু মা অথবা বোন অথবা কোন না কোন নারী করে দিচ্ছে। তার কাজ হচ্ছে সবকিছু এলোমেলো আর নোংরা করা। তার প্রয়োজনীয় সবকিছু তার হাতের কাছে এগিয়ে ধরবে নারী। নারীর কাজে তার কোন সহযোগিতার প্রশ্নই নেই। এই গৎবাঁধা ধ্যান ধারণাই একজন পুত্র তথা পুরুষের মনে নারীকে অবদমিত করে রাখার মানসিকতা উৎপাদন করে।
শুধু গণমাধ্যমে প্রচারিত-প্রকাশিত বিজ্ঞাপনগুলোর দিকে যদি একটু নজর দিই তাহলে দেখব দিনের পর দিন নারীদের ভূমিকা একটি গৎবাঁধা ধারণায় ঘুরপাক খাচ্ছে। নারী মানেই চেহারার, ত্বকের, দেহের, চুলের সৌন্দর্য্যের পেছনে ছুটবে, নয়ত রান্না-বান্না করে স্বামীকে-পরিবারকে খাইয়ে এবং নিজে না খেয়ে তৃপ্ত থাকবে। না হয় সন্তানকে বড় করতে ব্যস্ত থাকবে, আর তা না হলে স্বামীর কাপড় আর টয়লেট পরিস্কার রাখার চিন্তায় মত্ত থাকবে নারী। এর বাইরে তো কিছু নয়। তার মহাচিন্তা ত্বক, চুল, চেহারা কীভাবে ঠিক রাখা যায়, চেহারা মলিন হয়ে গেলে তো মহাসমস্যা! আর স্বামী-শ্বশুরবাড়িকে কীভাবে কোন গুড়ামশলা দিয়ে রান্না করে খাইয়ে সংসারটা ঠিক রাখা যায়! প্রকাশিত-প্রচারিত ফেয়ারনেস ক্রীম, সাবান, হেয়ার অয়েল, শ্যাম্পু, গুঁড়া মশলা, হেল্থ ড্রিঙ্ক, টুথপেস্ট, ওয়াশিং পাউডার, কাপড় কাচার সাবান, ফ্লোর ও টয়লেট ক্লিনারের বিজ্ঞাপনের আধিক্য এবং নারীর ভূমিকা বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক শেখ মাহমুদা সুলতানার বক্তব্য এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ‘আক্ষরিক অর্থেই নারীদের বিজ্ঞাপনে মেঝে বা বাথরুম পরিস্কারের মধ্যেই আটকে রাখা হচ্ছে। নারী মডেলদের বেশিরভাগ অংশই দর্শকদের সামনে শারীরিকভাবে একদমই বাথরুমে অবস্থান করেন।’’ (নারীদের বেশিরভাগ বিজ্ঞাপনে বাথরুমেই আটকে রাখা হচ্ছে, www.bbc.com/bengali/news/2016, ৮ মার্চ, ২০১৬) ।
টেলিভিশন বিজ্ঞাপন শিশুদের মননে একটি বড় ভূমিকা রাখে। তাই গণমাধ্যম কন্যাশিশু ও পুত্রশিশুদের মাঝে বিজ্ঞাপনের নামে যদি এধরনের বার্তা পৌঁছে দেয় তাহলে শিশুদের মনে গতানুগতিক ধারণা বদ্ধমূল হতে বাধ্য। এই মানসিকতা পরিবর্তন করতে হলে গণমাধ্যমকে অবশ্যই গৎবাঁধা ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তা না হলে পুরুষ ভাববে নারী সে তো আমার সম্পদ-সম্পত্তি, তার নিজের আবার অধিকার কী?
অন্যদিকে মানুষ হয়ে উঠা তো পরের ব্যাপার, নারী হয়ে উঠার আগে কন্যাশিশুকে নানা রকমের বাধা, নিষেধ, বিধি, প্রতিবন্ধকতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। সেটা পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, আইন তার উপর আরোপ করে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। খুব সাধারণ একটা ধারণা হচ্ছে, নারী মানেই ভোগ্যবস্তু। সেই প্রাচীনকাল থেকেই চলতে থাকা ধারণাটি আজও বদলায়নি। বরং এখন এটাই প্রথা হয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। সব ক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা আমাদের আজ এমন অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। কন্যাশিশু ধর্ষণের খবরে আমরা এখন আর আঁতকে উঠিনা। প্রতিদিন খবরের কাগজে কন্যাশিশু ধর্ষণের খবর যেন স্ট্যান্ডিং ম্যাটার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী ২০১৯ সালের প্রথম ছয়মাসে মোট ধর্ষণের ঘটনা ছিল ৬৩০টি। এদের সিংহভাগেরই বয়স ১৮ বছর বা তার নিচে। ধর্ষণের শিকার সবচেয়ে বেশি হয়েছে ৭ থেকে ১২ বছর বয়সের শিশুরা। আসক-এর হিসাবে এ বছর প্রথম ছয়মাসে শিশুধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২৫৮টি। আর ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার কারণে শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে ২১টি। পাঁচ বছরে ধর্ষণ, ধর্ষণ চেষ্টা আর ধর্ষণজনিত হত্যার ভুক্তভোগীদের ৮৬ ভাগ শিশু-কিশোরী।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের হিসাবে, এই বছরের প্রথম ছয় মাসে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে মাসে গড়ে প্রায় ৮৩টি (শিশুর প্রতি হিংস্রতা বাড়ছেই, প্রথম আলো, প্রথম পৃষ্ঠা, ১০ জুলাই ২০১৯)।
এতো গেল গণমাধ্যমে প্রচারিত বা প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে তৈরি প্রতিবেদন অনুযায়ী একটি হিসেব। কিন্তু এর বাইরেও হয়তো ধর্ষণ নিপীড়নের আরও ঘটনা ঘটে বা ঘটে চলেছে যার হিসেব আমাদের অজানা। আবার অনেকে লোকলজ্জার ভয়ে পুলিশ পর্যন্ত যাচ্ছে না, মামলা করছে না। অন্যদিকে ভয়ে, ধর্ষক বা প্রভাবশালীদের চাপে মামলা করছে না অনেকে। অনেকে লোকলজ্জার কারণে চেপে যাচ্ছে ধর্ষণের ঘটনা। শিশু ধর্ষণের মতো বিকৃত যৌন আচরণ সমাজে অহরহ ঘটে চলেছে যার প্রতিকারে আমরা কেউ কিছু করতে পারছি না। কন্যাশিশুদের নিয়ে ভয়াবহ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে অভিভাবকরা।
আমি মনে করি, প্রথমত কন্যাশিশুদের অভিভাবকদের তুলনায় পুত্রশিশুদের অভিভাবকদের সচেতন হওয়াটা বেশি জরুরী। পুত্রটি কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, কী করছে, তার মধ্যে কোন মানসিকতা তৈরি হচ্ছে তা লক্ষ্য করা জরুরী। যতদিন না সমাজে পুত্র এবং কন্যাকে দ্বিমুখী মানসিকতায় দেখার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাবে ততদিন আমরা একই চক্রে ঘুরপাক খেতে থাকব।
কন্যাশিশুর স্বপ্ন ভঙ্গের পেছনে এই যে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, তার পেছনে পরিবারের, সমাজের যে দায় তা যেমন আমরা এড়িয়ে যেতে পারিনা। তার চলার পথটা বাধামুক্ত করার পেছনে যেমন পরিবারের, সমাজের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে তেমনি গণমাধ্যমের দায়িত্ববোধকেও আমরা এড়িয়ে যেতে পারিনা। এক্ষেত্রে ধর্ষণসহ শিশু নির্যাতনের ঘটনাগুলো গণমাধ্যমে গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করতে হবে। ধর্ষণ যে শাস্তিযোগ্য অপরাধ, এই অপরাধের কী শাস্তি হতে পারে সে বিষয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সংবাদ প্রচার করতে হবে।
দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি সংবাদে দেখা যায়, পুলিশ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে সারা দেশে শিশু ধর্ষণের মামলা হয়েছে ৩০০-’এর কিছু বেশি। গত পাঁচ বছরে মোট শিশু ধর্ষণ মামলার সংখ্যা ছিল ৩ হাজারের কিছু বেশি। (শিশুর প্রতি হিংস্রতা বাড়ছেই, প্রথম পৃষ্ঠা, দৈনিক প্রথম আলো, ১০ জুলাই ২০১৯ )
প্রথম আলো ঢাকা জেলার পাঁচটি নারী নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে গত প্রায় ১৫ বছরে (২০০২-১৬) আসা ধর্ষণসংক্রান্ত পাঁচ হাজারের মতো মামলার পরিস্থিতি অনুসন্ধান করে দেখতে পেয়েছে, নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলোর মাত্র ৩ শতাংশের সাজা হয়েছে (সূত্র: প্রাগুক্ত)। বাকি ৯৭ শতাংশের সাজা হয়নি, তারা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে, স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। অথচ একজন ধর্ষিতা তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পেরেছে কি? নাকি অগোচরে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে সে খবর আমরা কেউ রাখিনি। প্রয়োজনও মনে করিনি। বাকি ৯৭ শতাংশকেও আইন-বিচারের আওতায় আনার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের বড় একটি দায়িত্ব রয়েছে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্ষণের খবর প্রকাশের পর পরবর্তীতে ধর্ষকের গ্রেফতার হওয়া, এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা, ধর্ষকের সাজা পাওয়া, কোথাও মামলা করতে গিয়ে বা মামলা তুলে নিতে হুমকির সম্মখীন হচ্ছে কি না, গ্রেফতার হলেও পরবর্তীতে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে কি না, প্রকৃত শাস্তি হলো কি না এসব নিয়ে প্রতিবেদন গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয় না। প্রতিটি ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষককে খুঁজে বের করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে গণমাধ্যম। বাল্যবিবাহ, ইভটিজিং, ধর্ষণ একজন কন্যাশিশুর ভবিষ্যত স্বপ্নপূরণের পথে অন্তরায় যেসব বিষয় রয়েছে তা নিয়ে অনুসন্ধানী, ব্যাখ্যামূলক প্রতিবেদন, ফিচার তৈরি করা এবং অবশ্যই ফলোআপ প্রতিবেদন প্রচার-প্রকাশ করা জরুরি। এসব অপরাধের কী শাস্তি হতে পারে, এরকম অপরাধ করে কেউ পার পাবে না-এমন একটি বার্তা যাতে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া যায়। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে। যাতে এ ধরনের অপরাধের সাথে জড়িত শতভাগ অপরাধীরই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হয়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, প্রতিটি অভিভাবককে নিজের সন্তানকে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। এজন্য ছেলে-মেয়ে কোথায় যাচ্ছে, কী করছে সেদিকে নজর রাখা প্রয়োজন। অন্যকে সম্মান দেয়ার শিক্ষাটা যেমন দেওয়া জরুরি, পাশাপাশি সন্তানকে বাবা-মায়ের সময়ও দিতে হবে। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে সন্তানের সাথে। এসব নিশ্চিত হলেই আমরা কন্যাশিশুদের আগামীর স্বপ্নপূরণের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবো।
সোমা দেব : সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।