কিশোরীদের ঋতুচক্র : নীরবতা ভাঙতে হবে
সোমা দেব
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০৬:৩৯ পিএম, ১৮ নভেম্বর ২০১৯ সোমবার
সোমা দেব: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ছবি: শিমুল শোয়েব
ঋতুচক্রের কথা শুনলেই আমরা অজান্তেই ভ্রুযুগল কুচকে ফেলি। এসব গোপনীয় আলোচনা প্রকাশ্যে কেন? আড়ালে-আবডালে এসব নিয়ে কথা বলা যায় না? এসব ভাবতে থাকি।
একটি শিশু যখন কিশোরী হচ্ছে, হঠাৎ তার মধ্যে শারীরিক বা মানসিক পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। সেই ছোট্ট শিশুটি কীভাবে মানিয়ে নিচ্ছে এত বড় পরিবর্তনের সাথে। আমরা বাবা-মা বা আত্মীয় পরিজন বন্ধুবান্ধবদের যতটুকু পাশে থাকা প্রয়োজন ততটুকু থাকতে পারছি না। পারছি না নাকি কখনও উপলব্ধি করতে করিনি যে, তাদের এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়ে তাকে নতুন বিষয়টির সাথে অভ্যস্ত করে তুলতে সহযোগিতা করা উচিত।
আমি সব পরিবারের কথা বলছি না। হয়ত কোনো কোনো পরিবার এসব করে। আমি তাদের কথাই বলছি, যারা এখনও শারীরিক মানসিক পরিবর্তনগুলোকে লুকিয়ে রাখার বিষয় মনে করেন। ঋতুচক্রের সময় নানা কুসংস্কার চাপিয়ে দেন কিশোরীটির কাঁধে। একে তো হঠাৎ একটা পরিবর্তন, শারীরিক কষ্ট তারপর কুসংস্কারের ভারে ন্যুজ হয়ে পড়ে তার ছোট্ট কাঁধ।
স্কুলে যাওয়া কিশোরীটি কতটা লজ্জায় সংকোচে ভুগতে থাকে ঋতুস্রাবের মতো বিষয়টি নিয়ে। কারণ পরিবার, সমাজ সবাই বিষয়টিকে ট্যাবু বলে ধরে নিয়েছি। প্রতিমাসে একটি কিশোরীর ৫/৭ দিন স্কুল যাওয়া বন্ধ। এভাবেও কিন্তু পিছিয়ে পড়ছে কিশোরীটি।
আর স্কুলে গিয়ে ঋতুস্রাবের মতো ঘটনা ঘটলে স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে চলে আসাটা আরেকটা লজ্জাজনক ব্যাপার। কারণ ক্লাস টিচারের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে আসতে হবে। আমি নিজেও স্কুলে পড়ার সময় দেখেছি, এরকম ঘটনার সম্মুখীন যে হত, তার নাজেহাল অবস্থা দেখতে উপরের ক্লাসের মেয়েরা উঁকিঝুকি দিত। আর পুরুষ টিচাররা মুখ টিপে হাসতেন। আর নারী শিক্ষকরা কেন জানি না বকাবকি করতেন কিশোরীটিকে।
যেহেতু বেশিরভাগ মেয়েদের কাপড় ব্যবহার করতে হত, তাই স্যানিটারি ন্যাপকিন সাথে রাখার কথা ভাবতও না। বিষয়টি কখনও স্বাভাবিকভাবে নেয়া হত না যে, এরকম ঘটনা হতেই পারে। এটা অস্বাভাবিক কোন কিছু নয়।
নারী শিক্ষক ও সহপাঠী সবাই একটা ফিসফিস গুঞ্জন করতেন। নিশ্চয়ই তাদের পরিবারে এটাকে ভয়াবহ ট্যাবু বলেই ভাবতে শিখিয়েছে। আর সবাই একইবৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। এই বৃত্ত থেকে বাইরে আসতে হলে সবার আগে ভাঙতে হবে কুসংস্কারের খোলস।
ঋতুচক্রের সময় ধর্মীয় কোন কাজ তো করতে দেয়াই হয় না। তার সাথে আরও যুক্ত আছে নানা ধরনের কুসংস্কার। যেমন, মেঝেতে ঘুমানো, থালায় না খেতে দিয়ে কলাপাতায় খেতে দেয়া, কাউকে না ছোঁয়া (যেহেতু তাকে অশুচি বলে গণ্য করা হচ্ছে), মাছ-মাংস জাতীয় আমিষ খেতে না দেয়া, টক ফল না খেতে দেয়া ইত্যাদি।
ঋতুস্রাবের সময় যেহেতু তার একটা শারীরিক পরিবর্তন হচ্ছে, তাই তার এই সময় পুষ্টিকর খাবার খাওয়া প্রয়োজন। গ্রামাঞ্চলে অথবা শহুরে সংস্কারাচ্ছন্ন পরিবারে এখনও টিকে আছে এই নিয়ম কানুনগুলো। নিয়ম মেনে চলা খারাপ কিছু নয়। কিন্তু যে নিয়ম শুধুমাত্র একটি মেয়েকে পেছনে ফেলে দেওয়ার জন্য তৈরি হয় সেই নিয়মগুলোর এখন আর কোন প্রয়োজন আছে কি?
নারীদের অবদমিত করে রাখার যে প্রয়াস প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে, পূর্ণ নারী হয়ে উঠার আগেই তাকে নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজন সেরকম নিয়মের বেড়াজাল ভেঙ্গে বের হয়ে আসার সময় হয়েছে।
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের জনসংখ্যার ২১ দশমিক ৪ শতাংশ কিশোর-কিশোরী। সংখ্যায় এরা ৩ কোটি ৬৩ লাখ ৮০ হাজার। এর অর্ধেক কিশোরী। সে হিসেবে কিশোরীর সংখ্যা ১ কোটি ৮১ লাখ ৯০ হাজার।
কিশোরীদের একটা অংশ বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে (ঝুঁকিতে কিশোরী স্বাস্থ্য-প্রথম আলো অনলাইন সংস্করণ, ১১ জুলাই ২০১৮)। এই ১ কোটি ৮১ লাখ কিশোরীর শারীরিক পরিবর্তন, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সরকার, সমাজ, পরিবার সবারই খুব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ভাবার সময় এসেছে।
শহুরে কিছু কিশোরী হয়ত পরিচ্ছন্ন থাকতে পারছে, তারা তাদের স্বাস্থ্যগত বিষয়গুলো নিয়ে বলতে পারছে। কিন্তু বিপুল সংখ্যক গ্রামীণ কিশোরী বা শহুরে বস্তিবাসী কিশোরী রয়েছে যারা ঋতুস্রাবের মতো বিষয়গুলো নিয়ে জনপরিসর তো দূরস্থান, নিজের পরিবারের মানুষের কাছে কথা বলতেই সঙ্কোচ বোধ করে।
সে হয়ত, দিনের পর দিন অপরিচ্ছন্ন কাপড় ব্যবহার করছে। ঋতুস্রাবের সময়গুলোতে জড়সড় হয়ে থাকছে। আর কুসংস্কারগুলো মানতে যেয়ে আরও কুণ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে। আর এসবের পাশাপাশি অকাল গর্ভধারণ, মাতৃত্ব এসব কারণে পরবর্তীতে জরায়ু ক্যান্সারসহ নানা ভয়াবহ জটিল রোগে ভুগছে।
একজন কিশোরীকে পরিপূর্ণ নারী শুধু নয়, পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠার পূর্বশর্তও তার সুস্থ থাকা। এক্ষেত্রে তার স্বাস্থ্যগত বিষয়টিতে সবার সচেতন হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। কিশোরীটিকে কুসংস্কার নয় বরং পরিচ্ছন্নতা শেখানো উচিত। নিজের স্বাস্থ্যগত সমস্যার কথা নিসংকোচে খুলে বলা শেখানো দরকার। যাতে নিজেকে সে গুরুত্ব দিতে পারে।
শুধু বাবা-স্বামী-সন্তান আর পরিবারের জন্য নয়, তাদের সুখের কথা শুধু ভাবা নয়, সে নিজের জন্যও বাঁচতে শেখে, নিজের সুখের কথা ভাবতে শেখে, নিজের স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দিতে শেখে।
সোমা দেব: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।