লিয়াং জুন: চীনের প্রথম নারী ট্রাক্টর চালক ও আইকন
অনলাইন ডেস্ক
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০৩:৩২ পিএম, ১৭ জানুয়ারি ২০২০ শুক্রবার
চীনের এক ইউয়ান (চীনের মুদ্রা) ব্যাংক নোটের গায়ে লিয়াং জুনের ছবি
চীনের প্রথম নারী ট্রাক্টর চালক লিয়াং জুন। চীনা নারীদের সামনে এক অনন্যা আইকন। যিনি জাতীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। ৯০ বছর বয়সে সোমবার তিনি মারা গেছেন। মৃত্যুর আগেও তিনি নিজ দেশে যতটা সম্মান পেয়েছেন মৃত্যুর পরও তাকে ততটা সম্মান করা হয়েছে।
লিয়াং জুনের জন্ম ১৯৩০ সালে চীনের প্রত্যন্ত হেইলংজিয়াং প্রদেশের এক হতদরিদ্র পরিবারে। শুরুতে কৃষিজমিতে সাহায্য করার পাশাপাশি গ্রামের একটি স্কুলে পড়াশোনা করতেন তিনি। ১৯৪৮ সালে লিয়াং জুন যখন ট্রাক্টর চালানো শেখার ক্লাসে যোগ দেন, সেখানে তিনি ছিলেন একমাত্র নারী।
তার এক যুগেরও বেশি সময় পরে, চীনের এক ইউয়ান (চীনের মুদ্রা) ব্যাংক নোটের গায়ে তার ছবি ছাপানো হয়, যেখানে তাকে হাসিমুখে ট্রাক্টর চালাতে দেখা যাচ্ছে।
"কেউই গাড়ি চালাতে পারত না, আমিও না" পরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, "আর সেটা শিখেছিলাম বলে জীবনে আমার কোন আফসোস নেই।"
১৯৪৮ সালে স্থানীয় একটি স্কুলে ট্রাক্টর চালানো প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু হলে তিনি তাতে ভর্তি হয়ে যান। স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, ঐ ক্লাসে ৭০জন প্রশিক্ষণার্থী ছিলেন, যেখানে লিয়াং জুন ছিলেন একমাত্র নারী।
প্রশিক্ষণ শেষে তিনি হন চীনের প্রথম প্রশিক্ষিত নারী ট্রাক্টর চালক। এর এক বছর পরে কমিউনিস্ট নেতা মাও জেদং গণ-প্রজাতান্ত্রিক চীন গঠনের ঘোষণা দেন।
দারিদ্র পীড়িত শৈশব ছাড়িয়ে অনেকটা পথ : এক সময় চীনে কেবল অভিজাত পরিবারের সদস্য, কবি এবং সামরিক নেতাদের কদর ছিল। কিন্তু ১৯৪৯ সালে যখন কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতা গ্রহণ করে, সে সময় সমাজের ভিন্ন ধরণের মানুষ অর্থাৎ বিভিন্ন পেশার কর্মজীবী মানুষদের কদর বাড়ল।
সোভিয়েত ইউনিয়নে ইতিমধ্যে সে মডেলের চর্চা শুরু হয়েছিল। চীনে তখন দরিদ্র, কঠোর পরিশ্রমী মানুষ যারা সমাজতান্ত্রিক দেশটির গঠনে কাজ করছিলেন তাদের কথা বেশি বেশি প্রচার করা হচ্ছিল। লিয়াং জুন ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম প্রথম এবং সর্বাধিক পরিচিত মডেল কর্মী।
দেশটির মুদ্রার ওপর তার হাসিমুখের ছবি দেখে অনেকে এমন কাজে উৎসাহিত হবে ভাবা হত। তিনি কেবল সমাজের শ্রেণিভেদকে ভেঙ্গেছিলেন এমন নয়।
লিয়াং জুন চীনের সব নারীর প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন এবং আজকে তাদের যে নানা রকম কাজের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে তারও শুরুটা লিয়াং জুনের হাত ধরেই হয়েছে।
তিনি নিজের সেসব সুযোগের পুরোটাই কাজে লাগিয়েছেন। তিনি পরবর্তীতে একজন প্রকৌশলী এবং রাজনীতিবিদ হয়ে উঠেছিলেন, তার দারিদ্র পীড়িত শৈশবে যা ছিল অকল্পনীয়।
রাজনীতিতে লিয়াং জুন : লিয়াং জুন চীনের কমিউনিস্ট পার্টি সিসিপিতে সদস্য হিসেবে যুক্ত হয়েছিলেন, এবং পরে তাকে বেইজিং এ কৃষি যন্ত্রপাতির ওপর পড়াশোনা করতে পাঠানো হয়েছিল। পড়াশোনা শেষে তিনি হেইলংজিয়াং প্রদেশে ফেরত যান এবং অ্যাগ্রিকালচারাল মেশিনারি রিসার্চ ইন্সটিটিউটে কাজ করেন।
১৯৬২ সালে চীনে ট্রাক্টর চালানো অবস্থায় তার ছবিসহ ব্যাংক নোট ছাপানো শুরু হয়। কমিউনিস্ট পার্টি নারীদের, বিশেষ করে গ্রামীণ নারীদের দেশটির শ্রমবাজারে বেশি করে যুক্ত করতে চেয়েছিল।
আর সেজন্য ভিন্ন ভিন্ন পেশায় নারীদের যুক্ত করার প্রচারণা হিসেবে তারা একজন ট্রাক্টর চালক নারীর প্রতিচ্ছবি উপস্থাপন করতে চেয়েছিল।
এমনকি অক্সফোর্ড হ্যান্ডবুক অব দ্য হিস্টোরি অব কমিউনিজম-এ বলা হয়েছে, 'নারী ট্রাক্টর চালকের চেয়ে বেশি প্রমোট কোন পেশাকে করা হয়নি।'
এক সময় চীনের পাঠ্যবইগুলোতে লিয়াং জুনের জীবনের গল্প উঠে আসে এবং বহু নারী ট্রাক্টর চালাতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। লিয়াং জুন ১৯৯০ সালে হার্বিন মিউনিসিপাল ব্যুরো অব অ্যাগ্রিকালচারাল ম্যাশিনের প্রধান প্রকৌশলীর পদ থেকে অবসরে যান।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লিয়াং জুন নানারকম শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। প্রায়ই তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলতেন এবং অনেকদিন ধরেই শয্যাশায়ী ছিলেন।
তার ছেলে ওয়াং ইয়ানবিং জানিয়েছেন, সোমবার তিনি শান্তিপূর্ণভাবে মারা গেছেন।
ওয়াং ইয়ানবিং বলেন, তিনি শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে গেছেন। আর চীনের প্রথম ট্রাক্টর চালক হিসেবে লোকে যখন তার কথা বলতো তিনি খুবই খুশি হতেন।
সামাজিক মাধ্যমে টপ ট্রেন্ড : দেশটির সামাজিক মাধ্যম ওয়েইবোতে তার মৃত্যুর বিষয়টি এখন টপ ট্রেন্ড এবং সেখানে সবাই তাকে সম্মান জানাচ্ছেন।
একজন লিখেছেন, "তিনি দেখিয়েছেন, একজন পুরুষ যা করতে পারে, নারীর পক্ষেও তা করা সম্ভব।"
নারীপুরুষ সমতা নিয়ে মাও শে তুং-এর বিখ্যাত উক্তি উদ্ধৃত করে আরেকজন লিখেছেন, "চীনের অর্ধেক আকাশ জুড়ে থাকা নারীকে বিদায়।"
আরেকজন লিখেছেন, "নিজের প্রজন্মের হিরোইন হয়ে ওঠার জন্য তিনি কঠোর পরিশ্রম করেছেন। বিদায় লিয়াং জুন, আপনাকে অভিবাদন।"