ভ্যাট : নারীশিক্ষায় নতুন প্রতিবন্ধকতা কেন?
সজীব সরকার
প্রকাশিত : ০৬:৫৫ পিএম, ১৭ আগস্ট ২০১৫ সোমবার
সমাজের অর্ধেক ও অপরিহার্য অংশ হওয়া সত্বেও নারীদের আমরা পিছিয়ে রেখেছি নানা কায়দায়; ব্যক্তি ও সমাজজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কর্তৃক আরোপিত হাজারো বাধা ঠেলে অল্প অল্প করে এগিয়ে যাচ্ছে বটে, তবে তাদের সেই অর্জনের স্বীকৃতিটুকু ঠিকভাবে মিলছে না।
সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে শিক্ষার মতো একটি মৌলিক অনুঘটক বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে এখনও অনেক পরিবারের সাধ্যের বাইরে - বিশেষ করে যদি সেটি মেয়েদের জন্যে হয়। বিনামূল্যে পড়ালেখার ব্যবস্থা থাকলেও অনেক দরিদ্র পরিবার তাদের মেয়েসন্তানকে স্কুলে পাঠাতে চায় না; এ পরিস্থিতিতে উচ্চশিক্ষায় ভ্যাট আরোপ বিশেষ করে নারীশিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনকে একেবারেই ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছে।
বাংলাদেশের অনেক পরিবারের অভিভাবকদের মনোজগতে সন্তানের শিক্ষাব্যয় তার পেছনে এক ধরনের ‘ইনভেস্টমেন্ট’; তারা ছেলেসন্তানদের শিক্ষার জন্যে অর্থ ব্যয়কে লাভজনক মনে করেন এই অর্থে যে ভবিষ্যতে সে বুড়ো মা-বাবার দেখাশোনা করবে। আর মেয়েসন্তান ভবিষ্যতে বিয়ে-থা করে অন্য পরিবারে চলে যাবে বলে তার পেছনে অর্থ ব্যয়কে তারা স্বাভাবিকভাবেই অপচয় মনে করেন। বেশ ক’বছর শিক্ষকতা পেশায় থাকার বদৌলতে এমন কয়েকজন নারী শিক্ষার্থীর কষ্টের অভিজ্ঞতা আমার জানার সুযোগ হয়েছে যারা বিভিন্ন সময় এসে জানিয়েছে পরীক্ষার সময় টাকা দিতে পারছে না বা অনেকে টিউশন ফি-তে ছাড়ের অনুরোধ নিয়ে এসেছে - না হলে তাদের আর পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়াই হবে না; এর পেছনে কারণ হিসেবে তারা বলেছে, তাদের ভাইদের পড়াশোনার খরচ দিতে বাবার কষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তাই তাদেরকে আর পড়াতে চাইছে না; অর্থাৎ ছেলেটিকে কষ্ট করে হলেও পড়াতে প্রস্তুত কিন্তু মেয়েটির পড়ার খরচের ‘বোঝা’ টানতে অনেক অভিভাবকই নারাজ।
বাংলাদেশে শিক্ষা ও শিক্ষিতের হার বাড়ছে - এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু সরকারের ছোট্ট একটি ভুল সিদ্ধান্ত এই অর্জন ও এর বড় প্রাপ্তিকে অর্থহীন করে তুলবে; প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিকে বিশেষ করে মেয়েদের অন্তর্ভুক্তির হার ক্রমশ কমে আসে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এটি আরও নিম্নগামী; দারিদ্র্য, অশিক্ষা-কুশিক্ষা বা কুসংস্কার, বাল্যবিবাহের প্রবণতা ইত্যাদি কারণে নারীর শিক্ষা গ্রহণের পথ এরই মধ্যে যথেষ্ট বন্ধুর; এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে ভ্যাট আরোপ করা হলে এটি নারীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে পাহাড়সম প্রতিকূলতাই তৈরি করবে। মাননীয় অর্থমন্ত্রী অনুধাবন করেছেন, প্রচুর টাকা খরচ করে যারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারে তারা ৭.৫ শতাংশ ভ্যাটও দিতে পারবে; মন্ত্রীবরসহ সংশ্লিষ্ট সবার কাছে একটু ভেবে দেখার অনুরোধ রইলো, সব বেসরকারি বিশ্বদ্যিালয়ে কাড়ি কাড়ি টাকা দিয়ে পড়তে হয় না; আর সবাই একই রকম ধনী পরিবার থেকে আসে না।
অনেক ছেলে-মেয়ে গত্যন্তর না থাকায় নিতান্ত বাধ্য হয়েই এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসে। এদের অনেকেই টিউশন ফি-তে নানা ধরনের ছাড় যোগাড় করে, টিউশনি বা পার্টটাইম চাকুরি করে পড়ালেখার খরচ চালায়। কাজেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়মাত্রেই বিলাসবহুল গুটিকয়ের সাথে মিলিয়ে চিন্তা করাটা বাস্তবসম্মত বা শিক্ষার্থীবান্ধব হবে না। মাননীয় অর্থমন্ত্রীসহ সরকারের কাছে অনুরোধ রইলো, আপনাদের শুভবুদ্ধি জাগ্রত হোক, আর বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিতে বিবেচনা করে দ্রুত এই ভ্যাট তুলে নিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে নারীবান্ধব- সর্বোপরি - শিক্ষার্থীবান্ধব করা হোক।
সজীব সরকার : শিক্ষক, লেখক ও গবেষক, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ ইমেইল : [email protected]