ময়নামতি : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকদের সমাধি সৌধ
কামাল আতাতুর্ক মিসেল
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০১:১১ পিএম, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ বুধবার
“শুধু মাত্র আজই না, প্রতি দিন নিরবে আমরা স্মরণ করবো” এ রকম অনেক কথা লেখা প্রতিটি সমাধি চিহ্নের উপর। উপরের উক্তিটি এ ই উইলসন নামে ২২ বছর বয়সী ১৯৪১-৪৫ সাল পযর্ন্ত সময়ে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে নিহত এক বৃটিশ সৈনিকের সমাধি সৌধের উপরে লেখা রয়েছে। কুমিল্লা ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে নিহত সৈনিকদের সমাধিক্ষেত্র।
কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসের উত্তর কোল ঘেষে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের পশ্চিম পাশে বুড়িচং উপজেলায় এর অবস্থান। স্থানীয় ও আশপাশের এলাকায় এটি ইংরেজ কবরস্থান নামেই সমধিক পরিচিত। এ সমাধি ক্ষেত্রটি দু’স্তরে বিভক্ত। মূল ফটক পেরিয়ে প্রবেশ করলে দেখা য়ায় দু পাশে সাজানো সমাধি। সামনে সিড়ি বেয়ে কিছুটা উঠলে প্রার্থনা কক্ষ আর মাঝে শ্বেত পাথরের যীশু খৃীষ্টের ক্রুশের চিহ্ন। তার উপরে অর্থাৎ সমাধির পিছনের অংশে নিহত মুসলিম সৈনিকদের কবর। কুমিল্লা শহর থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দূরে এ সমাধিক্ষেত্র। প্রায় সাড়ে চার একরের উচু নীচু টিলাভূমিতে অবস্থিত এ সমাধি সৌধে ৭৩৮ জনকে সমাহিত করা হয়েছিল যুদ্ধকালীন সময়ে। তবে ১৯৬২ সালে এক সমাহিত সৈনিকের দেহাবশেষ আতœীয়-স্বজনরা যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যায়। ফলে বর্তমানে এখানে ৭৩৭টি সমাধিক্ষেত্র রয়েছে। এখানে সমাহিত ১ জন রয়েছেন বেসামরিক ব্যক্তি।
এখানে সবাই এটাকে ইংরেজ কবরস্থান বললেও প্রকৃত পক্ষে এখানে শায়িত রয়েছেন মুসলিম, বৌদ্ধ, হিন্দু, ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী সৈনিকরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কুমিল্লার ময়নামতিতে ছিল মিত্র বাহিনীর চিকিৎসা কেন্দ্র। যুদ্ধে আহতদের চিকিৎসা সেবা দিতে এখানে নিয়ে আসা হতো। চিকিৎসাধীন অনেক সৈনিক নিহত হওয়া ছাড়াও ঢাকা, ফরিদপুর, সিরাজগঞ্জ, সৈয়দপুর প্রভৃতিস্থানে নিহত সৈনিকদের লাশ ও এখানে সমাহিত করা হয়। এখানে সমাহিত হওয়া ৭৩৭টির মধ্যে ১৪ জন সৈনিকের কোন পরিচয় পাত্তয়া য়ায়নি। এ সমাধিতে সাধারণ সৈনিক থেকে ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদার অফিসারদের সমাহিত করা হয়।
প্রতিটি সমাধিতে লেখা আছে নিহত সৈনিকের নাম, বয়স, পদবীসহ মৃত্যুর তারিখ ও জাতীয়তা। এ সমাধিক্ষেত্রটি বর্গাকৃতির। প্রতিটি বাহুর দৈঘ্য প্রায় আড়াইশ ফুট। সমাধিক্ষেত্রটির চারিদিকে প্রতিরক্ষা বেড়া রয়েছে। প্রতিটি সমাধির পাশে অনেক রকম ফুল ও পাতাবাহার গাছ দ্বারা সৌন্ধর্য বর্ধন করা হয়েছে। ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রিতে শুধুমাত্র মিএ বাহিনীর সৈনিকদের সমাহিত করা হয়নি। এখানে জাপানী সৈনিকদের ও সমাহিত করা হয। এ সমাধিক্ষেত্রের ৭৩৭জন সৈনিকের মাঝে যুক্তরাজ্যের ৩৫৭ জন, কানাডার ১২ জন, অষ্ট্রেলিয়ার ১২ জন, নিউজিল্যান্ডের ৪ জন, দক্ষিণ আফ্রিকার ১ জন, বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের ১৭৮ জন, জিম্বাবুয়ের ৩ জন, পূর্ব আফ্রিকার ৫৬ জন, পশ্চিম অফ্রিকার ৮৬ জন, বার্মার ১ জন, বেলজিয়ামের ১ জন, পোলান্ডের ১ জন, এবং জাপানের ২৪ জন যুদ্ধবন্দির কবর। তাছাড়া ১ জন বেসামরিক ব্যক্তিকেও এখানে সমাহিত করা হয়।
কুমিল্লার ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রির সার্বিক তত্ত্বাবধান করেন কমন ওয়েলথ গ্রেভস কমিশন। এর প্রধান কার্যালয় লন্ডনে। কমনত্তয়েলথ ভূক্ত দেশ সমূহের অনুদানে চলে এ সংস্থাটি। সমাধি সৌধটির দেখভালের জন্য গ্রেভস কমিশন ১ জন তত্ত্বাবধায়ক ও ৫জন গার্ডেনার নিয়োগ করেছেন।
সমাধি সৌধটির তত্ত্বাবধায়ক গিয়াস চৌধুরী জানান, বছরে দু ঈদের দিন ছাড়া সপ্তাহের ছয়দিন সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১২টা এবং ১ ঘন্টার মধ্যাহ্ন বিরতি দিয়ে দুপুর ১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এ যুদ্ধ সমাধিস্থল সর্ব সাধারণে জন্য উন্মক্ত থাকে। প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে শত শত ভ্রমণকারী দেখতে আসে এ সমাধি সৌধ।
প্রসঙ্গত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সৈনিকদের স্মরণ করতে প্রতি বছরের নভেম্বর মাসের ১১ তারিখে কমনওয়েলথভুক্ত দেশসমূহের বাংলাদেশে নিযুক্ত হাইকমিশনাররা ছুটে আসেন কুমিল্লার ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রির হলিক্রস পাদদেশে। এখানে হাইকমিশনারগণ বিশেষ প্রার্থনা আর ফুলেল শ্রদ্ধা জানান। সূত্র : বাসস।