ঢাকা, রবিবার ২৪, নভেম্বর ২০২৪ ৮:৩৭:২৮ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

শাড়ি, নারী দিবস ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

টনি মাইকেল

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১২:৩৬ পিএম, ৮ মার্চ ২০২০ রবিবার

টনি মাইকেল

টনি মাইকেল

আমরা যারা বাঙ্গালী তাদের ছেলেবেলা থেকেই সবচেয়ে কাছের পোষাক শাড়ি। কারণ এটা আমার মায়ের পোষাক। এটা আমার মায়ের একমাত্র পোষাক। আমাদের শিশুকাল কাটে শাড়ী ভিজিয়ে – এরপর কৈশর থেকে খাবার পরে মুখতো আমরা ন্যাপকিন দিয়ে মুছিনি কখনো। মা’র শাড়ির আচলই আমাদের ন্যাপকিন – চোখে ব্যাথা পেলে ঐ শাড়ীর আঁচল গোল্লা পাকিয়ে গরম ভাপ মুখে দিয়ে চোখে চেপে দিলেই কোথায় চলে যেতো ব্যাথা! মাধ্যমিক পেরুলে গরমে স্কুল ফিরে মায়ের শাড়ির আঁচলেই মুছেছি সারামুখের লেগে থাকা লবণ মেশানো ঘাম।

শাড়ি তাই আমার কাছে পোষাক নয় – পোষাকী নয়। শাড়ি মানে সুন্দর - সে যেই পড়ুক। আমাদের বাঙ্গালী মেয়েদের বড় হওয়ার একটা বড় ইন্ডিকেটর শাড়ি। প্রথম যেদিন বড়বোন শাড়ি পড়ে তখন থেকেই সে সত্যিকারের বড়দি হয়ে ওঠে। তার আগে সে শুধুই বোন যে আমার চেয়ে একটু বেশি বুঝে। আর এমন করেই শাড়ি কেমন করে যেন বাঙ্গালী নারীর ব্যাক্তিত্বটাকে পাল্টে দেয়।

কলেজের নবীন বরণে যে মেয়েটা সালোয়ার কামিজ পড়ে আসলো সেই মেয়েটাই পরের বছর পহেলা বৈশাখে শাড়ি পড়ে কলেজে আসলে – ধুক্ করে ওঠে বুকের ভেতর! আরে এই মেয়েটা কি সেই মেয়েটা!

প্রেমে পড়ে গেলে যেদিন প্রথম কোন রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া সেদিন সব ছেলেদের দাবি একটাই – পারলে শাড়ি পড়ে এসো প্লিজ। ব্যাস হয়ে গেলো।

এভাবেই শাড়ির ভেতরের মানুষটা হয়ে ওঠে নিজের মানুষ। পুরুষ রোজগার করে – ঘাম ঝড়ায় মাঠে ঘাটে প্রান্তরে আর তার ভালোবাসার মানুষের জন্যে মেলা থেকে – হাটে কিংবা গঞ্জের বাজারে গিয়ে যেটা হুট করে কিনে ফেলে – সেটা আর কিছু নয় - শাড়ি – হয়তো সাথে চুড়ি। বড়ি ফিরে তুলে দেয় সেটা ভালোবাসার মানুষের কাছে। সে যেই হোক – কন্যা – জায়া – অথবা জননী।

আমাদের বাংলা সিনেমার নায়কেরা পরিক্ষায় পাশ করে মা’র জন্যে শাড়ি নিয়ে আসে। বলে মা মা আমি পরিক্ষায় পাস করেছি! প্রথম চাকরী পেয়ে ছোট বোনটার জন্যে যে প্যাকেট নিয়ে আসে তা আর কিছু নয় – একটা সুতির শাড়ি।

বাংলায় শাড়ির বাহারের মতো এতা রং – এত পদ – এত পদ্ধতি আর এতো নাম বোধকরি পৃথিবীর আর কোন পোষাকের নেই। শাড়ির যেমন প্রকার ভেদ তেমনি তার পড়ার ঢং। না না ভাবে একে পড়ার যে কৌশল সেটাই তার ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করে। কুঠি বাড়ির মহিলারা যেভাবে লম্বা হাতার ব্লাউজে শাড়ি পরেছেন তার এক সৌন্দর্য যেটা রবীন্দ্রনাথ নানা সময়ে নানা ভাবে বর্ননা করেছেন। আবার জসিমুদ্দিনের গ্রামের মায়ের আর মেয়ের শাড়ি পড়ায় রয়েছে মাতৃত্ব বাংলার প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়ার বর্ননা।
কালের আবর্তে ব্লাউজ তার আকার – রূপ – ধরন এবং উদারতায় বদলেছে –কিন্তু যেটা বদলায়নি সেটা শাড়ী। আর তাই আমি পৃথিবীর সকল পোষাকের পরিবর্ধন পরিমার্জন অনুমদন করি – শুধু শাড়ীর কোন বিকল্প আমার কাছে গ্রহনযোগ্য নয়। যেখানে বাঙ্গালী নারী তার পূর্ণতা খুজেঁ পায় সেখানে সে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে সেখানে কোন ভাবাদর্শ মতাদর্শ কিংবা ধর্ম আমার কাছে গৌণ।

নারীকে বর্ণনা করতে গিয়ে কবি সাহিত্যিকেরা তার চেহার পাশাপাশি যেটা বর্ণনা  করেছেন সেটা তার শাড়ির। কেমন লাগছে তাকে সেই শাড়িতে – আর সেই কেমন লাগা পাঠকের সামনে দাঁড় করিয়েছে সেই চরিত্র টিকে। হুমায়ূন আহমেদ লিখতেন – রাণুর আজ মন খারাপ। তাই সে শাড়ি পড়েছে। মা’র আলমারী থেকে আগেই সরিয়ে রেখেছিলো। মাড় ভাঙ্গা শাড়ি। হালকা নীল রং। হালকা নীল রঙে রানুকে মায়বতী লাগে। মিসির আলী দেখলেন মেয়েটি মায়াবতী – বরই মায়াবতী। ব্যস্ হয়ে গেলো। আপনি চোখের সামনে আস্ত রানুকে দেখতে শুরু করলেন!

এভাবেই এপার বাংলার হিমুর রূপা থেকে ওপারের সুভংকরের নন্দিনীরা সবাই শাড়ি পড়তো। সাহিত্যে কবিতায় শাড়ি তাই নারীর প্রতিকৃতি – নারীর প্রতিনিধিত্ব করেছে।

আবহমান বাংলার রীতিতে শাড়ির রং রূপের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে নারীর অবস্থান। যেমন সামাজিক কৃষ্টি আর আচার অনুষ্ঠানে শাড়ির ব্যবহার নির্দিষ্ট করেছে নারীর ব্যক্তি পরিচয়। যেমন বিয়ের আসরে বেনারসি শাড়ি নারীকে করেছে বধু।

সেই বধু এক সময় শশুর বাড়ি গিয়ে দেখেছে শাশুড়ির আঁচলে বাঁধা সংসারের স্বাধীনতা আর ক্ষমতায়নের প্রতিকৃতি সংসারের চাবি কালের আবর্তে বাড়ির বউ এর কাছে এসেছে সেই সংসারের চাবি ওজন শাড়ির আঁচলে ওঠার সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে পরিবারে তার অবস্থান ক্ষমতায়ন দায়িত্ববোধ।

সংসার সামলানোর এই পথচলায় পুরুষের সাথে চলতে চলতে কখনো ক্লান্ত হয়নি নারী। আর সেই পুরুষ যদি বিধাতার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যায় ওপারে - নারীর শাড়ির রং যায় বদলে।

সাদা শাড়ি তখন হয়েছে নারীর একমাত্র বসন। এ যেন নারীর জীবনের সব রং পুরুষের সাথে কবরে চলে যাওয়া। বেঁচে থাকে নারী – না বেঁচে থাকা নিয়ে।

সভ্যতার এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে যেমন সতীদাহ প্রথা উঠে গেছে যেমন - তেমনি বিধবার পড়নের শাড়িতে লেগেছে উৎসবের রঙ। আমরা আমাদের মায়েদের প্রতি উদার হয়েছি। স্বামী গেলেও সন্তানদের ভালোবাসার রঙে বিধবার সাদা শাড়ি এখন শুধুই অতীত মাত্র।

কিন্তু মনের ভেতরের আবহমান যে পুরুষতান্ত্রিক চোখ সে চোখ এত আলো সইতে পারছে না। আর তাই শাড়ি আজ কয় হাত লম্বা কতটুকু খোলামেলা আর কতটুকু উত্তেজক সেই নিয়ে আমাদের গবেষণা। বারো হাত শাড়িতে আজ তাই নারীর শরীর ঢেকে রাখা কঠিন পুরুষের চোখ থেকে।

চিন্তিত মানুষেরা আজ তাই গবেষণা করতে বসেছেন অধর্মের আর অপকর্মের ব্যাখ্যায় শাড়ির অবস্থান কতটুকু। এ যেন শাড়ি নিয়ে না নারী নিয়েই গবেষণা। শাড়ির পেছনের মানুষটিকে সম্মান দেয়া আর না দেয়ার উছিলা খোঁজা মাত্র।

কিন্তু সাধারণ মানুষ এত কিছুর ধার ধারে না তারা পহেলা বৈশাখে ফাল্গুনে নারীকে শাড়ি পরায় দেখতে চায় বিয়ে বাড়ির গায়ে হলুদের হলুদ শাড়ি তাই আয়োজনকে উৎসবে পরিণত করে। নারী বারবার প্রকাশিত হয় তার আপন মহিমায়।

৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই বাংলায় তাই এখনও পুরুষ শাড়ি বিক্রি করে। যে লোকটি শাড়ির দোকানে বসে থাকে তার মত আদর্শ পুরুষ আর কে হতে পারে। যে পুরুষ তার সকল কাজ ফেলে তার প্রিয় মানুষকে নিয়ে শাড়ির দোকানে যায় তার মত সুন্দর পুরুষ আর কে হতে পারে?

যে শাড়ি কিনতে পুরুষের লাগবে ১০ মিনিট সেই একই শাড়ি কিনতে নারী হয়তো গোটা দশটা দোকান ঘুরে ফেলবে – আর এতে ক্লান্তি নেই যে পুরুষের সেই তো প্রকৃত পুরুষ। যে পুরুষটি এই ধৈর্য আর ভালোবাসা নিয়ে দোকানে দোকানে ঘুরতে পারে সেইতো নারীর সঙ্গে পথ চলতে পারে।

যে পুরুষ শাড়ির দোকানে বসে সকাল থেকে রাত অবধি - দিদি,বৌদি খালাম্মা, আন্টি ভাবি আর চাচির কাছে হাসতে হাসতে গল্প করতে করতে শাড়ি বিক্রি করে সে পুরুষ কি নারী নির্যাতন করতে পারে?

যে মানুষটি খোলাবাজারে শাড়ির দোকানে নিজের গায়ে শাড়ি জড়িয়ে পড়তে পারে সে পুরুষ কি হ্যাচকা টানে কোন নারীকে করতে পারে বিবস্ত্র? কই আমি তো শুনিনি কখনো কোন ধর্ষক শাড়ির দোকানে শাড়ি বিক্রি করেছে?

নারীর পড়নের বস্ত্র শাড়ি – যেমন পুরুষের শিল্প কারুকার্জে অনিন্দ হয়ে ওঠে – তেমন নারীর সন্মান – সম্ভ্রম – আত্মমর্জাদা এর কোনটিই নারী একার নয়। আর এটি নিশ্চিত করার দায়িত্বও নারীর একলার নয়। যে নারী কন্যা – জায়া – জননী সে তা হয়ে ওঠে তখনই যখন পুরুষ হয়ে উঠতে পারে সত্যিকারের পুত্র – স্বামী কিংবা পিতা।

আর তাই যতদিন পুরুষ শুধুই একজন পুরুষ – যতদিন এই রাষ্ট্র এই দেশ একটি পুরুষ তান্ত্রিক রাষ্ট্র যতদিন শাড়িতে নয় বোরখায় আমাদের মা মেয়েদের সম্ভ্রম নিশ্চিত করতে হবে ঠিক ততদিন, দেশের প্রতিটি ধর্ষিতা বোনের শাড়িই হবে আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।

আব্দুল্লাহ আবু সায়িদ স্যারকে কৃতজ্ঞতা – কেননা উনি না লিখলে – আমার শাড়ি নিয়ে লেখা হতো না।
আমি অপেক্ষায় ছিলাম স্যারের লেখার পরে আরো কেউ শাড়ি নিয়ে লিখবে অন্য একটা লেখা – কেউ লেখেন নি। কোন পুরুষবাদী কিংবা নারীবাদী সময় পাননি দু লাইন লেখার।

আজ বিশ্ব নারী দিবসকে উপলক্ষ্য করে তাই আমি লিখলাম। সকল নারীকে বিশ্ব নারী দিবসের শুভেচ্ছা।


লেখক :  টনি মাইকেল, আন্তর্জাতিক  উন্নয়ন সংস্থায় ডিরেক্টর  টেকনিক্যাল প্রোগ্রাম হিসেবে কর্মরত। [email protected]