আমার গণজাগরণ মঞ্চ
রীতা নাহার
প্রকাশিত : ০৫:৩৮ এএম, ১২ নভেম্বর ২০১৩ মঙ্গলবার
কাদের মোল্লার রায়ের দিন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য যেতে হয়েছিল৷ রায় ঘোষণা শুরুর পর থেকেই শেষ পর্যন্ত কি হয় একটা কৌতুহল ছিল, কিন্তু অপেক্ষার উত্তেজনা ছিল না৷ এর আগে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ হওয়ার পর কাদের মোল্ল্লার ফাঁসির আদেশ অবধারিত ধরেই নিয়েছিলাম৷ কারণ যেদিন কাদের মোল্ল্ল্লার যুক্তি-তর্ক শেষ হয়েছিল সেদিনই রাষ্ট্রপক্ষের একাধিক আইনজীবীর কাছে শুনেছিলাম কাদের মোল্লার নির্যাতন আর গণহত্যার প্রত্যক্ষদশর্ী সাক্ষী সবচেয়ে বেশি ছিল৷ একাধিক গণহত্যার জোরালো প্রমাণও আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে৷ রায় ঘোষণা শুরুর কয়েক লাইন পরেই মাননীয় বিচারকের একটি উক্তি কাদের মোল্ল্লার ফাঁসির আদেশের ব্যাপারে আরও নিশ্চিত করেছিল৷ `পৃথিবীর মানবতার ইতিহাসের জঘন্যতম অপরাধের বিচার হচ্ছে৷ মানবতার বিরুদ্ধে এত ভয়ংকর অপরাধের নজির আর আছে কিনা সন্দেহ৷ একের পর এক আদালত কাদের মোল্ল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিবরণ এবং সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে প্রমাণিত হওয়ার কথা পড়ছিলেন, রায়ে৷ শেষে এসে দু`টি অভিযোগের কথা বললেন যেগুলো সন্দেহতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি৷ শেষ পর্যন্ত সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি প্রমাণিত, দু`টি প্রমাণিত নয়৷ যেহেতু পাঁচটি প্রমাণিত, আরও নিশ্চিত হয়ে গেলাম ফাঁসির আদেশই হবে৷ অফিসে ব্রেকিং নিউজ দেওয়ার প্রতিযোগিতায় অফিসের ফোন নম্বর সামনে রেখে সেল ফোনের কল বাটনে আঙুল দিয়ে রেখেছি৷ রায় ঘোষণা হলেই এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে কল চলে যাবে৷ কিন্তু আদালতের শেষ বাক্য `সেন্টেন্স টু কনভিকশন` মুহুর্তেই সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিল৷ প্রায় সাড়ে তিনশ` মানুষ হত্যার বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ার পরও কাদের মোল্ল্লার যাবজ্জীবনের আদেশ, এ যেন কেউই মানতে পারেনি৷ কাদের মোল্ল্লার যাবজ্জীবন আদেশের রায় নিয়ে প্যাকেজ বানানো শেষ৷ নিজের সিটে এসে বসলাম৷ ঠিক সেই মুহুর্তেই খবরটা আসল৷ কাদের মোল্ল্ল্লার যাবজ্জীবন আদেশের রায় প্রত্যাখান করে ্লব্লগারদের একটা সংগঠন শাহবাগে রাস্তায় মিছিল করছে৷ খুব বেশি পাত্তা দিলাম না৷ সমাজের বড় বড় মানুষেরা চুপ৷ বাঘা বাঘা প্রগতিশীল রাজনীতিবিদরা নির্লিপ্ত৷ একটু আগে আমার এক বন্ধুর সঙ্গে কথা হয়েছিল ফোনে৷ ও একটি জাতীয় দৈনিকে কাজ করে৷ তার কথায় হতাশা আরও বেড়েছিল৷ তার কাছে জানলাম মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সেরা সাহিত্য রচয়িতাদের একজন এ রায় মেনে নেওয়ার কথা জানিয়েছেন তার প্রতিক্রিয়ায়৷ আর এক জন প্রবীণ শিক্ষাবিদ বিচার বিভাগের বিষয় নিয়ে মন্তব্য করা সমীচীন নয় বলে এড়িয়ে গেছেন৷ এই যখন অবস্থা তখন কয়েকজন নিতান্তই তরুণ ব্লগার আর কি করতে পারে! রাস্তায় নেমেছে, কিছুক্ষণ শ্লোগান দেবে, মিছিল করবে, এইতো! রাতে বাসায় ফেরার সময় শাহবাগ থেকে ঘুরে আসা একজন সহকমর্ী জানালেন মানুষে মানুষে ভরে গেছে শাহবাগ৷ একসঙ্গে এত মানুষ আর কখনও সে নাকি দেখেনি৷ বিশ্বাস হল না৷ হয়ত বাড়িয়ে বলছে, এমনটা ভেবে নিয়ে গুরুত্ব না দিয়ে বাসায় চলে গেলাম৷ বাসায় টিভি খুলে তো রীতিমত অবাক হলাম৷ মধ্যরাতের খবরে লিড প্যাকেজ শাহবাগ! প্যাকেজের শুরু হল প্যান শট দিয়ে৷ প্রায় ২৫ সেকেন্ডের শট, শুধু মানুষ আর মানুষ দেখা যাচ্ছে৷ এটা কি সত্যি, না কল্পনা! পরের দিনও হাইকোর্টে আস্যাইন্টমেন্ট৷ যাওয়ার পথে শাহবাগ হয়ে যাব ভাবলাম৷ কিন্তু বাংলামটর পার হতেই যানজট৷ ধীরে ধীরে এগিয়ে শেরাটনের মোড়ে আসতেই চোখে পড়ল অভূতপূর্ব দৃশ্য৷ জাতীয় সম্প্রচার কতর্ৃপক্ষের সামনে থেকেই মানুষ মানুষ আর মানুষ৷ একবার কাছে না যেয়ে কোর্টে যেতে কিছুতেই মন সায় দিল না৷ শেরাটনের মোড়ে গাড়ি রেখে হেঁটে চলে এলাম শাহবাগের মোড়ে৷ আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে শ্ল্ল্লোগান উঠছে `ক তে কাদের মোল্ল্লা, তুই রাজাকার তুই রাজাকার` `ফাঁসি ছাড়া অন্য রায় মানি না মানব না`৷ কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ না হওয়ার পর থেকে বুকের ভেতরে চেপে যাওয়া কষ্ট যেন কিছুটা লাঘব হল৷ কখন যে শ্ল্ল্লোগানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শ্ল্লোগান দিচ্ছি নিজেও বুঝতে পারিনি৷ সত্যিই এত মানুষ, এত পতাকা একসঙ্গে দেখিনি৷ শ্লোগানের এমন শিহরণ, চেতনার এমন আলোড়ন আগে কখনও অনুভব করিনি৷ ভেতর থেকে জেগে উঠলাম যেন৷ মনে হল এত দিন এমন একটি চত্বরই খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম, যেখান থেকে একাত্তরকে খুব কাছ থেকে স্পর্শ করা যায়৷ এই প্রাণের শাহাবাগই দেশপ্রেমী জনতার কাছে হয়ে উঠলো প্রজন্ম চত্বর৷ প্রজন্ম চত্বরে প্রায়ই অ্যাসাইন্টমেন্ট পড়ছে, সারাদিন থাকছি পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য৷ কিন্তু এই দায়িত্বপালন আর সব দায়িত্ব পালনের মত নয়৷ এখানে দায়িত্ব পালনে ক্লান্তি আসেনা, কোন কিছুতে বিরক্তি আসে না, খুব নিজের, খুব আপন মনে হয় প্রজন্ম চত্বর৷ যে প্রিয় লেখক প্রথম দিনের প্রতিক্রিয়ায় রায় মেনে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনিও প্রজন্ম চত্বরে এসে ঘোষণা দিলেন সব যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায় না হওয়া পর্যন্ত তিনিও রাজপথে থাকবেন তরুণদের সঙ্গে৷ সত্যিই এই তরুণরা প্রবল ঝাাঁকি দিয়ে আধমরাদেরও হারিয়ে যাওয়া তারুণ্যও ফিরিয়ে দিয়েছে স্বমহিমায়৷
এর মধ্যেই প্রজন্ম চত্বর নিয়ে কত শত গুজব, মিথ্যাচারের ডালপালা৷ বিশেষ করে মেয়েদের অংশগ্রহণ, রাতে থেকে মিছিল করা নিয়ে জঘন্য মিথ্যাচার শুরু হল৷ পুরুষতান্ত্রিক ক্লেদাক্ত সমাজে নারীঘটিত কেলেঙ্কারীর গুজব দ্রুত ছড়ায়৷ পুরুষতন্ত্র আর ধর্মান্ধ মন নারী নিয়ে গুজবে কানও দেয় বেশি৷ তাই হলও৷ এই নোংরা মানসিকতাদের ডিজিটাল এবং প্রিন্ট ভার্সন মুখপত্র আছে, সেখানে অবর্ণনীয় কুত্সিত সব খবরও প্রকাশ হতে থাকল৷ শেষ পর্যন্ত ব্ল্লগার রাজীব হায়দারের নির্মম হত্যাকান্ডের পর গুজবের মোড় ঘুরে গেল রাজীবের দিকে৷ সেখানেও নারী৷ জামায়াত-শিবিরের ব্ল্লগে এবং তাদের মুখপত্র সংবাদ মাধ্যমগুলোতে অশ্লীল ভাষায় রাজীবকে জড়িয়ে নারীঘটিত নানা বিষয় নিয়ে খবর প্রকাশ হল দু`দিন৷ এর পর শুরু হল রাজীবকে নাস্তিক বানানোর চেষ্টা৷ সব গুজবের অবসান হল রাজীবের উচ্চবিত্ত খুনীরা ধরা পড়ার পর৷ এই খুনীদের ধরা পড়ার মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়েছে নষ্ট রাজনীতির জামায়াত-শিবির তৈরির কারখানা কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে৷ কি নির্লজ্জ জামায়াত-শিবিরের মুখপত্রগুলো, সত্যের কাছে হেরে গিয়েও একবারও বোধদয় হল না৷ জামায়াত-শিবিরের যেমন কোন কিছুতেই বোধদয় হয় না, তাদের মিত্র-সুহৃদ, মুখপত্রদেরও হয় না৷ এদের সবার আর একটা খুব বড় মিল আছে৷ এরা প্রচন্ড নারী বিদ্বেষী এবং নারীঘটিত বিষয় নিয়ে নোংরা আলাপে খুবই উত্সাহী৷ সব অপপ্রচার প্রজন্ম চত্বরের কাছে হেরে গেছে৷ প্রজন্ম চত্বর বেঁচে আছে৷ প্রজন্ম চত্বর আমাদের সাহস দিয়েছে৷ অনেক রকম ভয় তুচ্ছ করে এখন জোর গলায় বলতে পারি৷ গণজাগরণ মঞ্চ শক্ত করে দাঁড়াতে শিখিয়েছে৷
এখন রাজাকারকে আঙুল তুলে বলতে পারি, `তুই রাজাকার`৷ রাজাকারের পক্ষ নিলে তাকে নির্ধিদ্বায় বলতে পারি, `নব্য রাজাকার`৷ এখন চোখ তুলে তাকাতে পারি, আঙুল উঁচিয়ে বলতে পারি৷ মাথা উঁচু করে বাঁচার মন্ত্র দিয়েছে `আমার গণজাগরণ মঞ্চ`৷ লেখক:সিনিয়র রিপোর্টার-বৈশাখী টেলিভিশন ১২ নভেম্বর`২০১৩