করোনা: সহিংসতায় নিষ্পেষিত নারীজীবন
জান্নাতুন নিসা
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০৩:১৪ পিএম, ৮ জুন ২০২০ সোমবার
করোনা: সহিংসতায় নিষ্পেষিত নারীজীবন
নারী মানেই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের প্রজ্জ্বলিত শিখায় নিক্ষেপিত কোন ধাতুর পিনপতন নিরবতা। নারী মানেই সমাজের চাওয়াতে পূর্ণ-কোন রং কিংবা কোন আলো; জলের ধারার মতো কেবলই তার বহমানতা। যার থাকতে নেই কোন কম্পিত বিষন্নতা কিংবা চলমান কোন প্রলয়ের অস্থিরতা।
আজ একুশ শতকে এসেও এই নারীকে হতে হচ্ছে পারিবারিক কিংবা সামাজিক সহিংসতার স্বীকার; দারিদ্র্য, বেকারত্ব, অশিক্ষা, যৌতুক, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, তালাক, যৌন নিপীড়নসহ নানা সহিংসতার শিকার হয়ে নিষ্পেষিত হচ্ছে নারীজীবন। চলমান বিশ্বে নারীর প্রতি এই সহিংসতা যতটা দুর্বিষহ ঠিক ততটাই ভয়াবহ হয়ে উঠছে করোনাকালীন লকডাউনে।
কারণ মহামারি করোনার থাবায় গোটা বিশ্ব যখন গৃৃহবন্দী, তখন নারীর নিরবতায় যোগ হয়েছে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ এবং অনিরাপদ গর্ভপাত সহ গৃহপোযোগী হাজারও সহিংসতা।
সম্প্রতি জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিষয়ক সংস্থা-ইউএনএফপিএ এবং এভেনার হেলথ, জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় ও অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, 'জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য দেশে গড়ে গত তিন মাসের লকডাউনে পারিবারিক সহিংসতা ২০-৭০ শতাংশ বেড়েছে'।
চলতি বছর বিশ্বে অন্তত দেড় কোটি পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ঘটতে পারে বলেও জানানো হয় ইউএনএফপিএ'র প্রতিবেদনে।
মানুষ মাত্রই ভিন্নমতের অবাধ বিচরণ। আর ভিন্নমতের মানুষগুলোকে একই ছাদের নিচে বসবাস করতে হবে বছরের পর বছর, সৃষ্টির নিয়মই এমন। সেই নিয়মের বেড়াজালে আটকে থাকা মানুষ যখন ঘরবন্দী, তখন জীবন-জীবিকা এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকা মানুষের কাছে অন্যজনের (নারী কিংবা পুরুষ) নেতিবাচক দিকটি বেশি নজরে আসে। আগে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হলেও লকডাউনে দিনের পর দিন এক সঙ্গে থাকায় তা হয়তো সম্ভব হচ্ছে না। যে কারণে ঝগড়া-বিবাদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা বাড়ছে, যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে নারী।
সম্প্রতি ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, 'করোনাভাইরাসের এই প্রাদুর্ভাবের সময় বিশ্বব্যাপী নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতা বেড়ে গেছে বহুগুণ'।
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় প্রতিটি দেশের জাতীয় পরিকল্পনায় পারিবারিক সহিংসতা রোধের বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বানও জানান তিনি।
বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা কিংবা জরিপ এখনও হয়নি। তবে এ নিয়ে মানবাধিকারকর্মী এবং গবেষকরা ইতোমধ্যে ভাবতে শুরু করেছেন। আর মানবাধিকার নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের মতে, লকডাউনের মধ্যে এই প্রবণতা স্বাভাবিকের চাইতে বেড়েছে।
এ প্রসঙ্গে মনরোগবিদ মেখলা সরকার বলেন, 'মানুষ তাদের স্বাস্থ্য নিয়ে, কতদিন এই লকডাউন চলবে তা নিয়ে, অর্থনৈতিক সংকট কীভাবে সামাল দেবে এমন নানা বিষয়ে উদ্বেগে আছে। যার কারণে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। মানুষ স্বভাবত কাছের মানুষের কাছেই তাদের রাগ প্রকাশ করে। মূলত এভাবেই বিবাদ ছড়িয়ে পড়ছে'।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সিনিয়র উপ-পরিচালক নীনা গোস্বামী জানান, 'গত কয়েক দিনে তাদের হেল্পলাইনে ঘরোয়া সহিংসতা সম্পর্কিত ফোন কলের সংখ্যা বেড়েছে'।
লকডাউনে গৃহকর্মীর অবর্তমানে ঘরবন্দী মানুষের প্রত্যেককেই ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকার কথা বলা হচ্ছে বারবার। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবারই উচিত একসাথে গৃহস্থালি কাজগুলো সুসম্পন্ন করা। অনুপ্রাণিত করতে তারকাদের গৃহস্থালি কাজের বিভিন্ন ফুটেজ, বার্তা কিংবা প্রতিবেদনও প্রকাশ হচ্ছে সামাজিক গণমাধ্যম কিংবা প্রচার মাধ্যমে। কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের বিষয়টি সবসময়ই জোড়ালো থাকে। আর এতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে নারী-পুরুষের ভেদাভেদ।
অনেকেই নারীর কাজের প্রতি সহানুভুতিশীলতায় এগিয়ে আসলেও লকডাউনে অধিকাংশ নারীর কাজের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছে অন্তত পঁচাত্তর গুণ। বেশিরভাগ সময়ে গৃহস্থালি বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকার পাশাপাশি যোগ হয়েছে সবার মনোরঞ্জনের জন্য মুখরোচক খাবার তৈরির বাহার।
রান্না করা থেকে শুরু করে ঘর-দোর, পোশাক এবং থালা-বাসন পরিস্কার করা, সন্তান ও পরিবারের সবার যাবতীয় বিষয়ের খেয়াল রাখা সহ বাজারের ঝুঁকিটিও তাকে নিতে হচ্ছে।
এছাড়া এসময় নারীদের গর্ভধারণের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকছে অনেক বেশি। ভবিষ্যৎ সংকটের বিষয়টিও তাকেই ভাবতে হচ্ছে কয়েকধাপ এগিয়ে এসে। অর্থাৎ আগের সমস্ত স্বাভাবিক কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও অনেক নিত্য-নতুন কাজের ঘনঘটা। যার পূর্ণতা হচ্ছে নারীর অসহনীয় নিরবতায়।
নিরবতা মানে কেবলই ভেঙে যাওয়া কিংবা মেনে নেওয়া নয়; নিরবতা মানে কখনও কখনও নিয়ম ভাঙার সর্পিল বিলাসিতা। তাই নিরবতার জাল ছিঁড়ে অনেকেই সাহায্যকারী নাম্বারগুলোতে যোগাযোগ করছে।
ব্রিটেনের পারিবারিক সহিংসতার বিষয়ে সহায়তা দেয়া প্রতিষ্ঠান দ্য ন্যাশনাল ডমেস্টিক অ্যাবিউজ জানায়, 'সম্প্রতি তাদের হেল্পলাইনে সাহায্য চাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে'।
ব্রিটেনের জাতীয় হেল্পলাইনে গত প্রায় দুইমাসে পারিবারিক সহিংসতা সংক্রান্ত কল এসেছে স্বাভাবিকের চাইতে প্রায় ৫০% বেশি। পারিবারিক কলহের জেরে দেশটিতে খুনের সংখ্যাও দ্বিগুণ হয়েছে। ফ্রান্সে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা বেড়েছে ৩৬%, অস্ট্রেলিয়ায় ২০% শতাংশ। ভারতে দ্বিগুণ এবং তিউনিশিয়ায় বেড়েছে ৫ গুণ।
বাংলাদেশে জাতীয় জরুরি হেল্পলাইনেও সহিংসতার বিরুদ্ধে সাহায্য চেয়েছেন অনেকে। অনেক নারী ফোন করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছেন। কিন্তু গণপরিবহন বন্ধ থাকায় তারা সেটা করতে পারছেন না। নির্যাতিত নারীদের আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যবস্থা থাকলেও করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আতঙ্কে নতুন করে কাউকে সেখানে যুক্ত করা হচ্ছে না।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, স্পেন, আর্জেন্টিনা, মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর সহ অনেক দেশে পারিবারিক সহিংসতা বেড়েছে। ঘরে আটকে থাকার ফলে নারীরাই মূলত তাদের আত্মীয়-বন্ধু বা স্বামীর নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। লকডাউনের কারণে বাধ্য হয়ে তাদের ঘরেই থাকতে হচ্ছে। তবে কেউ কেউ নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে লকডাউনের মধ্যেই ঘর ছাড়ছেন। আবার অনেকে বিবাহ বিচ্ছেদের মতো বিষয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয় লকডাউন পরিস্থিতিতে ঝুঁকিতে পড়ছে নারী ও মেয়েশিশুর প্রজননস্বাস্থ্য। কেবল তাই নয়! কোভিড-১৯–এর কারণে নিম্ন-মধ্যম আয়ের ১১৪টি দেশে প্রায় ৪ কোটি ৭০ লাখ নারী আধুনিক পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারবেন না বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ এবং অনিরাপদ গর্ভপাতের হার বাড়বে।
ধারণা করা হচ্ছে, ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে বিভিন্ন দেশের বিদ্যমান লকডাউন ছয় মাস অব্যাহত থাকলে বিশ্বে অতিরিক্ত ৭০ লাখ অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ এবং অতিরিক্ত ৩ কোটি ১০ লাখ সহিংসতার ঘটনা ঘটবে।
বাংলাদেশও এই সহিংসতার হুমকিতে। কালের আবর্তে নারী যেনো পুরুষতন্ত্রের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত সমান্তরাল হাওয়ায় পরিণত না হয়। তাই এখনই যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঠিক পদক্ষেপ জরুরি। তা না হলে করোনা পরবর্তী বিশ্বে শিশু নির্যাতন, নারীর প্রতি সহিংসতা ও বাল্যবিবাহ বেড়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
লেখক : কথাসাহিত্যক, সাংবাদিক ও নারীনেত্রী