ঢাকা, শনিবার ২৩, নভেম্বর ২০২৪ ২২:০৯:৪১ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

নূরজাহান বেগমের স্মৃৃতিতে সুফিয়া কামাল

বনশ্রী ডলি

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১২:১৩ এএম, ২০ জুন ২০২০ শনিবার

সুফিয়া কামাল ও নূরজাহান বেগম।  ফাইল ছবি।

সুফিয়া কামাল ও নূরজাহান বেগম। ফাইল ছবি।

আজ ২০ জুন, কবি সুফিয়া কামালের জন্মদিন। নারী অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার মানসকন্যা সুফিয়া কামাল বাঙালি নারীর আদর্শ, অন্ধকারে বাতিঘর। স্বশিক্ষিত কবি, নারী সংগঠক সুফিয়া কামাল জাতির বিবেক হিসেবে আমাদের চেতনায় জেগে আছেন সবসময়। জাতির মঙ্গলের জন্য প্রতিটি অন্যায়-অবিচার আর অশুভর বিরুদ্ধে লড়েছেন আমৃত্যু। কোমল আর কঠিনের প্রতিমূর্তি নির্লোভ সুফিয়া কামাল আমাদের বড় প্রিয়, বড় অহংকার। আজ তার অনুপস্থিতি থাকলেও রয়েছে তার আদর্শ, তার কর্ম। জননী সাহসীকার জন্মজয়ন্তিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।

২০০৬ সাল। আমি তখন সমকাল-এর নারীস্থান পাতার বিভাগীয় সম্পাদক। সুফিয়া কামালের জন্মদিন উপলক্ষে  লেখাটা একটু অন্যরকম করার ইচ্ছে, তাই সুফিয়া কামালের কথা শুনতে গিয়েছিলাম তারই কাছের জন নূরজাহান বেগমের কাছে। সেইসঙ্গে নূরজাহান বেগমকেও জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি ও শুভেচ্ছা জানাবো, এমনটাই ইচ্ছে। নূরজাহান বেগমের সঙ্গে কথা বলে সেবছরের ২০ জুন নারীস্থান-এ প্রকাশ হয় এই লেখাটা। পরে শ্রদ্ধেয় নূরজাহান বেগমও আমাদের ছেড়ে চলে যান। আজ সবই স্মৃতি।

৪ জুন ছিল নূরজাহান বেগমের জন্মদিন। ১৫ জুন বেগম পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগমকে জন্মদিনের শ্রদ্ধা জানাতে সাংবাদিক নাসিমুন আরা হক এবং দিল মনোয়ারা মনু আপার সঙ্গে পুরানো ঢাকার পাটুয়াটুলির বেগম অফিসে পৌঁছলাম দুপুরে।

নূরজাহান বেগম ভ্যাপসা গরমে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন অনেকটা সময় ধরে। তা দেখে যারপরনাই খুশি হলাম আমরা। তিনজনই একসঙ্গে বলে উঠলাম, ইস! আপনাকে আমরা কষ্ট দিলাম, বসে থাকতে হলো। প্রচন্ড জ্যামে আমরা ভীষণ দেরি করে ফেলেছি।

শুনে অশিতিপর তরুণী নূরজাহান আপা হাসিমুখে বললেন, তা কেন, তোমরাও তো কষ্ট করে এসেছো। আমার তো ভালো লাগছে। বসো বসো, অনেক তো পেয়েছি জীবনে, আর কত! তোমরা ভাল কাজ কর, মা - বোনদের জাগিয়ে তোলো, সাহায্য কর, সহযোগিতা কর-তাহলেই ভালো লাগবে। চোখে একদম দেখতে পাই না।

লেখালেখিও ভাল দেখতে পাচ্ছি না বলে চশমার কাচ মুছে চোখে দিতে দিতে তিনজনের নাম, কুশল জেনে নিলেন। ফুল আর মিষ্টি হাতে দিতেই আবারো হাসি।

কেউ একজনকে ডেকে সিঙাড়া, চা আর পানি দিতে বললেন।

একথা-সেকথা আর তার কাজের কথা এক নাগাড়ে বলতে বলতেই সুফিয়া খালাম্মার (সুফিয়া কামাল) প্রসঙ্গ এলো। বেগম পত্রিকার ষাট বছর পূর্তি এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সুফিয়া কামালের প্রয়োজনীয়তা, গুরুত্ব ও  তাঁর অভাব প্রসঙ্গ নিয়ে আমরা আলোচনায় মেতে উঠলাম।

আমি বলছি কম, শ্রোতা হয়ে মাঝে মাঝে টুকে নিচ্ছি তাদের কিছু কথা। কারণ ২০ জুন সুফিয়া কামালের জন্মদিন।

কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গেই বললেন তিনি, খালাম্মা বেঁচে নেই, আজ তাঁর অভাব যেনো ভীষণভাবে অনুভব করছি। তা না হলে দেশ এতো সংকটে, মেয়েরা এতো বিপদে পড়ছে, রাস্তায় মার খাচ্ছে, রাজনীতিতে হেরে যাচ্ছে। সুফিয়া কামালের মতো কেউ কোনো প্রতিবাদ করছে না, কথা বলছে না। তাঁর মতো নেতৃত্ব কেন কেউ দিতে পারছে না। আমরা কি সবাই তাঁকে ভুলে যাচ্ছি?

সুফিয়া কামাল সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে বলা মাত্রই আবেগে উদ্বেল হলেন। বললেন, স্মৃতিচারণ নয়, তিনি আমার জীবন জুড়েই আছেন। সাড়ে তিন বছর বয়সে কলকাতায় প্রথম তার দেখা পাই। এরপর থেকে তার স্নেহ, শিক্ষা, পরামর্শ পেয়েছি। তার আদশের্র দীক্ষা পেয়েছি। তার মৃত্যু পর্যন্ত তার স্নেহধন্য ছিলাম। যতদিন বাঁচবো ততোদিন সুফিয়া খালাম্মা আমার প্রতিদিনের প্রেরণা আর চেতনায় থাকবেন- এটুকু বলতে পারি।

নূরজাহান বেগম আরও বললেন, আর তোমাদের বলি, বড় হলঘরে তাঁর জন্মদিন, মৃত্যুদিনে, তার নামে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে কী হবে! তার আদর্শ, ইচ্ছাগুলো সবাই মনে রেখে কাজ কর, তাহলেই তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে। আমি তো তার মেয়েদের (টুলু ও লুলু) সবসময় বলি, সবজায়গায় মায়ের কথা বেশি করে বলবে। কারণ সুফিয়া কামাল খুব কঠিন সময়ে কঠোর সমাজ ব্যবস্থায়ও পশ্চাৎপদ অবহেলিত দরিদ্র মেয়েদের জন্য কাজ করেছেন, পথে নেমেছেন। বেগম রোকেয়ার আদর্শকে ধারণ করে তিনি নিজেও যেমন সুশিক্ষিত হয়েছেন, তেমনি অন্য মেয়েদেরও পথ দেখিয়েছেন। কখনোই কোনো অন্যায় দাবিকে  মেনে নেননি, এটাই তার জীবনের সবচেয়ে বড় পরিচয়। আমি বৃদ্ধ বয়সেও তার প্রথম জীবনের কাজের উৎসাহ, স্নেহভরা কথা আর পারিবারিক আরঅপচারিতা, আন্তরিকতা মনে করে কাজ করি, আনন্দ পাই। এ তো আমার জীবনের বড় পাওয়া।

তিনি বলেন, এখন যারা সমাজের জন্য, মেয়েদের জন্য কিছু করতে চাও তারা সুফিয়া কামালের আদর্শকে মনে রেখে কাজ করতে হবে। তাকে শ্রদ্ধা জানাতে হলে তিনি যেখানে থাকতেন, যেখানে বসে ভাবতেন, লিখতেন, কথা বলতেন, কাজ করতেন, সেখানে মাঝে মাঝে যাওয়া এবং সামনের দিনে করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েও কাজ করা উচিত। তাহলে তাঁর প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানো হবে। এটা আজ বড় প্রয়োজন।

কথাগুলো বলতে বলতে তার দুচোখ থেকে উপচে পড়া জলের ধারা জামদানির আঁচলে মুছতে লাগলেন আর বারবার বলতে লাগলেন, আমাদের এখন এত দুঃসময় যাচ্ছে অথচ খালাম্মা নেই যে দৌঁড়ে তাঁর কাছে যাব, জিজ্ঞেস করব, এখন কী করবো খালাম্মা, আপনি পরামর্শ দিন।