ঢাকা, মঙ্গলবার ২৬, নভেম্বর ২০২৪ ৫:৩৮:৩০ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

মেঘদূতের বার্তা নিয়ে আবার এলো আষাঢ়

অনন্ত চৌধুরী

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১২:২৬ এএম, ২০ জুন ২০২০ শনিবার

মেঘদূতের বার্তা নিয়ে আবার এলো আষাঢ়

মেঘদূতের বার্তা নিয়ে আবার এলো আষাঢ়

সবুজের সমারোহে নতুন প্রাণের বার্তা নিয়ে এসেছে আষাঢ়। আকাশ ছেয়েছে মেঘের ঘনঘটায়। মেঘদূতের বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছে আষাঢ়। গাছের পাতা, টিনের চাল কিংবা ছাদের রেলিং ছুঁয়ে এবং খোলা আকাশের প্রান্তরজুড়ে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ার দিন।

সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং শিল্পকলার অঙ্গন আষাঢ়বন্দনায় নিবেদিত, উচ্ছ্বসিত। কবির কবিতায়, শিল্পীর সুরে-গানে, চারুশিল্পীর তুলির আঁচড়ে, চলচ্চিত্রের সেলুলয়েডে, নকশিকাঁথার ফোঁড়ে ফোঁড়ে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ ভান্ডারে বর্ষার অপরূপা রূপবর্ণনা, স্থিতি ও ব্যাপ্তি মূর্ত চিরকালীন হয়ে আছে।

আষাঢ় নিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ  লিখেছেন-

 “আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে–

আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে।

এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি

পুলকে দুলিয়া উঠিছে আবার বাজি

নূতন মেঘের ঘনিমার পানে চেয়ে

আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে।”

বর্ষা কবি-সাহিত্যিকদের মাস। বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত এমন কোনো কবি নেই যিনি কি-না বর্ষা নিয়ে এক-দু’লাইন লেখেননি। আষাঢ়-শ্রাবণ, বর্ষা-বৃষ্টি এসব শব্দ কবিদের ভাবের জগতে বুঁদ করে, তাঁদের চোখ চকচক করতে থাকে, হাত নিশপিশ করতে থাকে, আর দেখতে দেখতে দিস্তা দিস্তা কাগজ ভরিয়ে ফেলেন।

তাইতো রবীন্দ্রনাথ তার ‌‘আষাঢ়’ কবিতায় লিখেছেন-

“নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।
     বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর,
     আউশের ক্ষেত জলে ভরভর,
কালি-মাখা মেঘে ও পারে আঁধার ঘনায়েছে দেখ্ চাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।”

মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতায় বর্ষা আবার ধরা দিয়েছে প্রকৃতির অপরূপ শক্তি হিসেবে। তাঁর কবিতায় বর্ষার প্রকৃতি ও মানব প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তার সঙ্গে দেবতারাও ঘোষণা করেছেন একাত্মতা।

‘বর্ষাকাল’ কবিতায় কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বর্ষার রূপকে ভাবনার তুলিতে বর্ণনা করেছেন এভাবে - “গভীর গর্জন করে সদা জলধর উথলিল নদ-নদী ধরনীর উপর/রমণী রমন লয়ে সুখে কেলি করে দানবাদি দেব যক্ষ সুখিত অনন্তরে।”

পল্লীকবি হিসেবে খ্যাত কবি জসীমউদ্দীন বর্ষা নিয়ে অনবদ্য কবিতা সৃষ্টি করেছেন। তার অনবদ্য কবিতাটি হলো 'পল্লী-বর্ষা'। পল্লী-বর্ষা কবিতায় কবি বর্ষার অবিশ্রান্ত বর্ষণে মুখর গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে যে আড্ডার আসর বসে, ফাঁকে ফাঁকে পল্লীবাংলার শ্রমজীবী মানুষের অসমাপ্ত কাজগুলোও যে আড্ডার ছলে সারা হয়ে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে কিচ্ছা-কাহিনী শোনার যে লোকায়ত চিত্র তা তুলে ধরেছেন কবিতায়।

কবিতাটির কিছু অংশ “গাঁয়ের চাষীরা মিলিয়াছে আসি মোড়লের দলিজায়,-/গল্পে গানে কি জাগাইতে চাহে আজিকার দিনটায়!/কেউ বসে বসে কাখারী চাঁচিছে, কেউ পাকাইছে রসি; কেউবা নতুন দোয়াড়ীর গায়ে চাকা বাঁধে কসি কসি।/মাঝখানে বসে গাঁয়ের বৃদ্ধ, করুণ ভাটীর সুরে/আমির সাধুর কাহিনী কহিছে সারাটি দলিজা জুড়ে।/বাহিরে নাচিছে ঝর ঝর জল, গুরু গুরু মেঘ ডাকে, /এসবের মাঝে রূপ-কথা যেন আর রূপ-কথা আঁকে।”

বর্ষার ভারি বর্ষণে শরীর ধুয়ে নেয় প্রকৃতি। পরিচ্ছন্ন হয়। নতুন করে জেগে ওঠে। বেলি, বকুল, জুঁই, দোলনচাঁপা, গন্ধরাজ, হাসনাহেনার ঘ্রাণে ভরে ওঠে চারপাশ। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে এ মাসের তাৎপর্য কিছুটা ভিন্ন।

আষাঢ় মানেই যেন মেঘবতী জলের মৌসুম। বর্ষার বাদল দিনের প্রথম কদম ফুলের হাসি তো ভুবন ভোলানো! কী গ্রাম, কী নগর সর্বত্রই বর্ষার আগমনী বার্তা জানান দেয় কদম। যেন একই কথার জানান দিতে পেখম মেলে ময়ূর। বৃষ্টির জল গায়ে নিয়ে নৃত্য করে।’

কবি আল মাহমুদ বর্ষাকে দেখেছেন অন্য এক দৃষ্টিতে। তাঁর কবিতায় বর্ষা-প্রকৃতি অন্যমাত্রার এক কথা বলে। ‘আষাঢ়ের রাত্রে’ তিনি ব্যক্ত করেছেন :

‘শুধু দিগন্ত বিস্তৃত বৃষ্টি ঝরে যায়, শেওলা পিছল
আমাদের গরিয়ান গ্রহটির গায়।’’

এদিকে কবি শামসুর রাহমানের কবিতায় শুধু যুদ্ধ, স্বাধীনতা, বিজয়, প্রেমই আসেনি, বর্ষাও এসেছে। বৃষ্টির জন্য কবি অপেক্ষায় থেকেছেন যেমন মানবহৃদয় অপেক্ষায় থাকে প্রেমিকার জন্য। বর্ষাকে কবি দেখতে চেয়েছেন সবকিছু ছেড়ে ভালোলাগার স্পর্শ করে। তাই তো চাষির মতোই তিনিও বর্ষাকে প্রার্থনা করেছেন :

  “টেবিলে রয়েছি ঝুঁকে, আমিও চাষীর মতো বড়
ব্যগ্র হয়ে চেয়ে আছি খাতার পাতায়, যদি জড়ো
হয় মেঘ, যদি ঝরে ফুল, বৃষ্টি। অলস পেন্সিল
হাতে, বকমার্কা। পাতা জোড়া আকাশের খাঁ খাঁ নীল।’ (কবিতা : অনাবৃষ্টি)

রোমান্টিক কবি নির্মলেন্দু গুণের অবিস্কারটিও চমৎকার। তিনি বলেছেন বর্ষাই একমাত্র নারী, একমাত্র রমনী।

চিরকালই কবিদের বর্ষাবন্দনায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে বর্ষার মোহিনী রূপ। ব্যক্ত হয়েছে অনেক- অব্যক্ত রয়ে গেছে আরো বেশি। গহন বর্ষার সজল কালো মেঘবৃষ্টি ভেজা ভুঁইচাপা, কামিনী আর দোলনচাঁপার গন্ধ মনে যে অনির্বচনীয় আনন্দ সঞ্চারণ করে-ভাষার সাধ্য কি পৌঁছায় সেখানে! মেঘমেদুর বর্ষার রং রূপ রস গন্ধ মানুষ ভালোবেসেছে অনন্ত কাল। আর যুগে যুগে কবিরা সে ভালোবাসার চিহ্ন রেখে গেছেন তাঁদের কবিতায়; বর্ষা বন্দনায়।