ঢাকা, মঙ্গলবার ২৬, নভেম্বর ২০২৪ ৪:১৯:০৯ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

জীবনবোধ ও চেতনার কবি আহসান হাবীব

অনন্ত সরকার

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৭:৪৩ পিএম, ১০ জুলাই ২০২০ শুক্রবার

আহসান হাবীব [জন্ম :২ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৭-১০ জুলাই, ১৯৮৫]

আহসান হাবীব [জন্ম :২ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৭-১০ জুলাই, ১৯৮৫]

কবি আহসান হাবীব বাংলা সাহিত্যের এক পুরোধা পুরুষ। এদেশের একজন খ্যাতিমান কবি ও সাহিত্যিক। শিশুদের জন্যেও তিনি লিখেছেন অবিরাম। বাংলা কাব্য সাহিত্যে এক অনিবার্য নাম কবি আহসান হাবীব। বাংলা কবিতায় চল্লিশের দশক নতুন মাত্রায় সমাজ-সম্পৃক্ত এক নতুন দিগন্ত উন্মোচনের কাল। ত্রিশোত্তর বাংলা কবিতার নতুন ধারার কবিদের মধ্যে প্রধান একজন হলেন কবি আহসান হাবীব।

তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। একাধারে কবি, সাংবাদিক এবং খ্যাতিমান সাহিত্য সম্পাদক। কবি আহসান হাবীব কবিতায় নির্মাণ করেছেন স্বদেশলগ্নতা, জীবনঘনিষ্ঠতা, মানবিক বেদনাবোধ, প্রেমানুভবের উৎসারণ, নিজস্ব আত্মজৈবনিক কাব্যশৈলী। নিজেস্ব কাব্যশৈলীর আধুনিকতার সঙ্গে রবীন্দ্র-নজরুল যুগের কাব্যকলার সংমিশ্রণে দেশ ও জীবনবোধের সাহচর্যে নতুন আধুনিক কাব্য আন্দোলনের সূচনাক্রম উদ্ভাসিত হয়েছে আহসান হাবীবের সব রচনাকর্মে। তাইতো আহসান হাবীব শুধু আমাদের প্রকৃত আধুনিক কবি নন, উত্তরাধুনিকতার এক পথ প্রদর্শক। কারণ তিনি কবিতায় তুলে ধরেছেন সমকালীন ইতিহাস, সমাজ, জীবন বাস্তবতা, কাব্য নিরীক্ষা, ঐতিহ্যের নবরূপায়ণ, দার্শনিকতার নতুনবোধ ও শিল্পরীতি।

কবি আহসান হাবীর দীর্ঘদিন দৈনিক বাংলার সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন সূত্রে তিনি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গনে অভিভাবকের ভূমিকা রেখেছেন।

তিনি চল্লিশের দশকের অন্যতম প্রধান আধুনিক কবি। তিরিশের শেষ দিকে লেখা শুরু করা সত্ত্বেও তিরিশ দশকীয় কবিতার আত্মরতি বা নান্দনিকতার প্রভাব তিনি রক্তে ধারণ করেননি। বরং চল্লিশের সমাজচেতনার যুগধর্মকেই আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন। আবহমান বাংলা কবিতার ঐতিহ্য সংলগ্ন থেকেই আহসান হাবীব তার কবিতায় স্বকীয় বৈশিষ্ট্য মুদ্রিত করেছেন। ইউরোপীয় আধুনিকতার প্রভাবে কৃত্রিম নগরযন্ত্রণা জনবিচ্ছিন্নতা আর নিঃসঙ্গতার বিকার তিরিশি কবিদের কবিতাকে হতাশায় আচ্ছন্ন করেছিল, আহসান হাবীব সেই কৃত্রিম যন্ত্রণা থেকে মুক্ত থেকে রাত্রিশেষে ভোরের আলো দেখার আকাঙ্ক্ষায় উজ্জীবিত থেকেছেন।

বাংলা ভাষা সাহিত্যে অবদানের জন্য তাকে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৮ সালে একুশে পদক এবং ১৯৯৪ সালে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে।

আহসান হাবীবের জন্ম ১৯১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পিরোজপুরের শংকরপাশা গ্রামে ৷ তার বাবার নাম হামিজুদ্দীন হাওলাদার। মা জমিলা খাতুন। তার পাঁচ ভাই ও চার বোন ৷ অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল বাবা-মার প্রথম সন্তান তিনি ৷

পারিবারিকভাবে আহসান হাবীব সাহিত্য সংস্কৃতির আবহের মধ্যে বড় হয়েছেন। সেই সূত্রে বাল্যকাল থেকেই লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। সেইসময় তার বাড়িতে ছিল আধুনিক সাহিত্যের বইপত্র ও কিছু পুঁথি। আনোয়ারা, মনোয়ারা, মিলন মন্দির প্রভৃতি তিনি বাড়িতেই পেয়েছেন ৷ এসব পড়তে পড়তে একসময় নিজেই কিছু লেখার তাগিদ অনুভব করেন। সাহিত্যের অনুকূল পরিবেশ নিয়ে পিরোজপুর গভর্নমেন্ট স্কুল থেকে ১৯৩৫ সালে প্রবেশিকা  পাস করেন। এরপর তিনি চলে আসেন বরিশালে৷ ভর্তি হন বিখ্যাত বিএম কলেজে৷ কিন্তু অর্থনৈতিক সংকটের কারণে কলেজের পড়াশোনার পাঠ শেষ পর্যন্ত অসমাপ্ত রাখতে হয় তাকে। বিএম কলেজে দেড় বছর পড়ার পর ১৯৩৬ সালের শেষার্ধে কাজের খোঁজে তিনি রাজধানী কলকাতায় পাড়ি জমান৷ এভাবেই কবি আহসান হাবীবের বরিশাল থেকে তৎকালীন রাজধানী কলকাতায় পা রাখেন।

আহসান হাবীব ১৯৪৭ সালের ২১ জুন বিয়ে করেন বগুড়া শহরের কাটনারপাড়া নিবাসী মহসীন আলী মিয়ার কন্যা সুফিয়া খাতুনকে। আহসান হাবীবের দুই কন্যা কেয়া চৌধুরী ও জোহরা নাসরীন এবং দুই ছেলে মঈনুল আহসান সাবের ও মনজুরুল আহসান জাবের। কবির ছেলে মঈনুল আহসান সাবের একজন স্বনামখ্যাত বাংলা ঔপন্যাসিক।

১৯৩৩ সালে কিশোর বয়সে আহসান হাবীবের প্রথম প্রবন্ধ ‘ধরম’ স্কুল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় ৷ ১৯৩৪ সালে তার প্রথম কবিতা মায়ের কবর পাড়ে পিরোজপুর গভর্নমেন্ট স্কুল ম্যাগাজিনে ছাপা হয় ৷ পরে ছাত্রাবস্থায় কলকাতার কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হলে নিজের সম্পর্কে আস্থা বেড়ে যায় কবির।

স্কুলে পড়াকালীন তিনি প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার বিষয়বস্তুকে কবিতায় উপস্থাপিত করে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। ততদিনে অবশ্য দেশ, মোহাম্মদী, বিচিত্রার মতো নামি দামী পত্রপত্রিকায় তার বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হয়ে গেছে ৷

কলকাতা গিয়ে শুরু হয় আহসান হাবীবের সংগ্রামমুখর জীবনের পথচলা৷ তিনি কলকাতায় এসে ১৯৩৭ সালে দৈনিক তকবির পত্রিকার সহ-সম্পাদক পদে যোগ দেন। বেতন মাত্র ১৭ টাকা৷ পরে তিনি ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত কলকাতার বুলবুল পত্রিকা ও ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত মাসিক সওগাত পত্রিকায় কাজ করেন ৷ এছাড়া তিনি আকাশবাণীতে কলকাতা কেন্দ্রের স্টাফ আর্টিস্ট পদে ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কাজ করেন ৷

মৃত্যু : ১৯৮৫ সালের ১০ জুলাই আহসান হাবীব মৃত্যুবরণ করেন।

রচনাবলি : কাব্যগ্রন্থ, বড়দের উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, ছোটদের ছড়া ও কবিতার বই সব মিলিয়ে আহসান হাবীবের বইয়ের সংখ্যা ২৫টি।


কাব্যগ্রন্থ :

    রাত্রিশেষ (১৯৪৭)
    ছায়াহরিণ (১৯৬২)
    সারা দুপুর (১৯৬৪)
    আশায় বসতি (১৯৭৪)
    মেঘ বলে চৈত্রে যাবো (১৯৭৬)
    দু'হাতে দুই আদিম পাথর (১৯৮০)
    প্রেমের কবিতা (১৯৮১)
    বিদীর্ণ দর্পণে মুখ (১৯৮৫)

উপন্যাস :

    রাণী খালের সাঁকো (১৯৬৫)
    আরণ্য নীলিমা (১৯৬২)
    জাফরানী রং পায়রা

শিশু সাহিত্য :

    জোছনা রাতের গল্প
    ছুটির দিন দুপুরে
    বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর
    ছুটির দিন দুপুরে
    রেলগাড়ি ঝমামমে
    রাণীখালের সাঁকো
    জোৎসনা রাতের গল্প
    ছোট মামা দি গ্রেট
    পাখিরা ফিরে আসে
    রত্নদ্বীপ (ট্রেজার আইল্যান্ডর সংক্ষিপ্ত অনুবাদ)
    হাজীবাবা
    প্রবাল দ্বীপে অভিযান (কোরাল আইল্যান্ডর সংক্ষিপ্ত অনুবাদ)

সম্পাদিত গ্রন্থ :

    কাব্যলোক
    বিদেশের সেরা গল্প

পুরস্কার :

    ইউনেস্কো সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬১)
    বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬১)
    আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৪)
    নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৭৭)
    একুশে পদক (১৯৭৮)
    আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮০)
    আবুল কালাম স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৪)
    স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯৪)।