হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ
শান্তা মারিয়া
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০৭:৩৪ পিএম, ১৯ জুলাই ২০২০ রবিবার
হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ
১৯৭১ সাল। গভীর রাত্রি। ভরা জোছনা। বয়ে চলেছে উত্তাল নদী। সেই নদীতে, ঠিক যেন জোছনার রূপ দেখতে দেখতে ভেসে যাচ্ছে একটি মৃতদেহ। একজন শহীদের দেহ। এই দৃশ্যটি সবসময় আলোড়িত করতো হুমায়ূন আহমেদকে। কারণ সেই শহীদ ছিলেন হুমায়ুন আহমেদের বাবা ফয়জুর রহমান। ১৯৭১ সালে পিরোজপুর মহকুমার এসডিপিও হিসেবে কর্মরত থাকার সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে শহীদ হন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হুমায়ূন আহমেদও আটক হয়েছিলেন। তাকে নির্যাতন করা হয় এবং হত্যার জন্য তার দিকে গুলি চালানো হয়। কিন্তু অলৌকিকভাবে বেঁচে যান তিনি।মুক্তিযুদ্ধকে তাই তিনি লালন করতেন চেতনায়|। তার লেখায় ঘুরেফিরে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন প্রসঙ্গ। শুধু লেখায় নয়, টিভি নাটকে ও চলচ্চিত্রে তিনি মুক্তিযুদ্ধকে রূপায়িত করেছেন গতানুগতিক ধারা থেকে সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিকোণে।সেটি ছিল কৃত্রিমতাবর্জিত, সরল, সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকোণ।
বিটিভির ধারাবাহিক নাটক ‘বহুব্রীহি’তে অত্যন্ত শিল্পসার্থকভাবে তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গটি নিয়ে আসেন।এ নাটকেই টিয়া পাখির মুখে ‘তুই রাজাকার’ সংলাপটি ভীষণ জনপ্রিয়তা পায় এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এক সার্থক অভিব্যক্তিতে পরিণত হয়। এ সিরিয়ালে অভিনয় করেছিলেন আবুল হায়াত, আবুল খায়ের, আসাদুজ্জামান নূর, আলী জাকের, লুৎফুন্নাহার লতা, আফজাল শরীফ, আফজাল হোসেন, আলেয়া ফেরদৌসী, দীপা ইসলাম। ধারাবাহিকের শেষ অংশে দেখা যায় আদর্শবাদী সোবহান সাহেব তার জীবনের উদ্দেশ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছেন একটি বিষয়| তিনি বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে ঘুরে শহীদদের নামের তালিকা প্রস্তুতের কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন। এর মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে শহীদের তালিকা প্রণয়নের অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজটি যে অবিলম্বে শুরু হওয়া উচিত সেই দিকে সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তার সহজাত স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে।
১৯৯৪ সালে তিনি প্রথম যে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন সেটিও খুব সঙ্গতভাবেই ছিল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক। ‘আগুনের পরশমণি’ চলচ্চিত্রে হুমায়ূন আহমেদ কোনো ক্লিশে ব্যবহার করেননি।বরং এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অন্যান্য সিনেমা থেকে একেবারে আলাদা ধাঁচের। ঢাকা শহরের এটি মধ্যবিত্ত পরিবারকে ঘিরে গড়ে ওঠে ছবির কাহিনী।
মতিন সাহেব ঢাকা শহরের সাধারণ একজন মধ্যবিত্ত মানুষ। দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে তার সংসার। যুদ্ধকালীন অবরুদ্ধ ঢাকার সঙ্গে দর্শকের পরিচয় ঘটে এই পরিবারের উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ, রেডিওতে বিবিসির অনুষ্ঠান শোনা, ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ মনে পড়ার মধ্য দিয়ে। এই পরিবারে আশ্রয় নেন একজন মুক্তিযোদ্ধা যিনি মতিন সাহেবের বন্ধুর ছেলে। তাকে ঘিরে এগিয়ে যায় গল্প। ছোট ছোট দৃশ্যের মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদ অসাধারণ নৈপুণ্যে তুলে ধরেন একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা, মুক্তিযোদ্ধাদের উপর নির্যাতন, নারীর উপর বিভৎস নির্যাতন, গণমনের ক্ষোভ, গেরিলা যুদ্ধ, রাজাকার আলবদরদের ঘৃণিত কার্যকলাপ। আর এ সবই তিনি করেন চোখে আঙুল দিয়ে নয়, অতি নাটকীয় বা আরোপিতভাবে নয়, সহজ স্বাভাবিক ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে।
এ ছবির একটি দৃশ্যে দেখা যায়, গণহত্যার শিকার অসংখ্য বাঙালির মৃতদেহের উপর ঝরে পড়ে বৃষ্টি। অসাধারণ একটি দৃশ্যকল্প এটি। ‘আগুনের পরশমণি’তে প্রধান তিনটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন আবুল হায়াত, আসাদুজ্জামান নূর, বিপাশা হায়াত।‘আগুনের পরশমণি’ সেরা চলচ্চিত্র, সেরা পরিচালনাসহ আটটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। এ ছবির জন্য হুমায়ূন আহমেদ কাহিনীকার, সংলাপ রচয়িতা এবং প্রযোজক হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পান। বলা চলে এ ছবির মাধ্যমেই চলচ্চিত্রকার হিসেবে নিজের জাত চিনিয়ে দেন হুমায়ূন আহমেদ|
২০০৪ সালে হুমায়ূন আহমেদ নির্মাণ করেন মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘শ্যামল ছায়া’। ছবির প্রারম্ভেই দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় আষাঢ়মাসে একদল মানুষ নৌকায় করে মুক্তাঞ্চলের দিকে যাত্রা শুরু করে। যাত্রাপথের টুকরো ঘটনার ছোট ছোট দৃশ্যের মধ্য দিয়ে হুমায়ূন আহমেদ গ্রামবাংলার মানুষের বীরত্ব, অসহায়ত্ব, পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতার চিত্র তুলে ধরেন। বড় নৌকাটিতে যে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে আসা মানুষরা যাত্রী হয় তাদের পারষ্পরিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে হুমায়ূন আহমেদ প্রকৃতপক্ষে বাঙালির সে সময়কার অনুভূতি, অভিন্ন স্বার্থ ও আবেগকেই তুলে ধরেন।নৌকায় বিভিন্ন পরিবারের সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন পীতাম্বর, তার অন্ধ পিতা যাদব ও বৃদ্ধ ঠাকুরমা, করিম সাহেব ও তার পুত্রবধূ রাত্রি, ফুলির মা ও ফুলি, মুন্সি মোসলেম উদ্দীন ও তার স্ত্রী বেগম, গৌরাঙ্গ ও তার স্ত্রী আশালতা ও মা পার্বতী, জহির, মাঝি বজলু ও তার সহকারী কালুসহ কয়েকজন নারী ও শিশু। বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত মুক্তাঞ্চলে পৌছাতে পারে নৌকাটি।পর্দায় দৃশ্যমান হয়ে ওঠে বাংলাদেশের পতাকা। ছবির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন হুমায়ূন ফরিদী, মেহের আফরোজ শাওন, শিমুল, রিয়াজ, স্বাধীন, সৈয়দ আখতার আলি, তানিয়া আহমেদ, আহমেদ রুবেল, ড.এজাজ, শামীমা নাজনীন, জেসমিন পারভেজ। ছবিটি অস্কার পুরস্কারের জন্য সেরা বিদেশিভাষার চলচ্চিত্র শাখায় বাংলাদেশ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎসবেও প্রশংসিত হয় ছবিটি।
এ দুটি চলচ্চিত্রই নির্মিত হয় হুমায়ূন আহমেদের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে।লেখক হিসেবে তিনি যেমন সহজভাষায় মানবমনের গভীরতম অনুভবকে প্রকাশ করতে পারতেন অনায়াস দক্ষতায় তেমনি চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল যে, তিনি খুব সহজ, স্বাভাবিক সংলাপ ও দৃশ্যায়নের মধ্য দিয়ে গভীর ভাবনা তুলে আনতে পারতেন।সাহিত্যের মতো চলচ্চিত্রের ভাষায়ও তিনি ছিলেন একমেবাদ্বিতীয়ম এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
শহীদ পিতার সন্তান হিসেবে মুক্তিযুদ্ধকে তিনি ধারণ করতেন নিজের আত্মায় ও অস্তিত্বে। তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো নিজের লেখা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ অবলম্বনেও চলচ্চিত্র নির্মাণ করতেন।
নন্দিত কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদ চলে গেছেন ২০১২ সালের ১৯ জুলাই। তার মৃত্যু এ দেশের সাহিত্য ও চলচ্চিত্রজগতে যে শূন্যতার সৃষ্টি করেছে তা কখনও পূরণ হওয়ার নয়।তবে মৃত্যুর অন্ধকারজগতে চলে গেলেও তিনি বেঁচে আছেন তার অনবদ্য সৃষ্টিকর্মের মধ্যে, বেঁচে আছেন তার ভক্তদের হৃদয়ে।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক