ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২১, নভেম্বর ২০২৪ ১৬:১৫:৫৯ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

শামসুন নাহার মাহমুদ : ছড়িয়েছেন জ্ঞানের আলো

প্রকাশিত : ০১:২৪ পিএম, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৩ বুধবার

‘আমি আশা করি সেদিন দূরে নয় যেদিন আমাদের সমাজের মেয়েরা শুধু বিএ পাশ করে সংবর্ধনা পাবেন না, সংবর্ধনা পেতে হলে তাঁদের আরো বড় কাজ করতে হবে।’ বিএ পাস উপলক্ষে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ ১৯৩২ সালে কথাগুলো বলেছিলেন। সেবছর কলকাতার সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুলে বেগম শামসুন নাহারের বিএ পাশ উপলক্ষ্যে এই বিরাট সংবর্ধনা সভাটির আয়োজন করা হয়। বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ নারী শিক্ষা এবং নারীদের ভোটাধিকারের আন্দোলনসহ মৌলিক কিছু কাজের জন্যে এদেশের নারী সমাজের কাছে খুবই আপন ও প্রিয়জন।

এদেশের নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে, নারী জাগরণের প্রচার ও প্রসারে বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ অনন্য কীর্তি ও অবদান রেখে গেছেন। শামসুন নাহার যখন জন্মেছিলেন তখন মেয়েদের লেখাপড়া শেখা বা স্কুলে যাওয়া নিষেধ ছিল। রক্ষণশীল সমাজের শাসনে মেয়েদের পর্দার অন্তরালে এক রকম বন্দী জীবন যাপন করতে হতো। এমনি অবস্থায় শামসুন নাহার রক্ষণশীল সমাজের সকল ভ্রুকুটি ও শাসন উপেক্ষা করে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন এবং সমাজের অসহায় ও দুর্গত নারীদের জাগরণের ব্রত নিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন। শুধু তাই নয় বেগম শামসুন নাহারের লেখা পড়ে বাংলার নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া তাঁকে একটি চিঠি লেখেন।

তাতে তিনি লিখেন, ‘তোমাকে চিঠি লিখিতে বসিয়া আজ অনেকদিন আগের একটা কথা মনে পড়িয়া গেল। একবার রাত্রি বেলায় আমরা বিহারের এক নদী পথে নৌকাযোগে যাইতেছিলাম। বাইরের অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। শুধু নদীতীরের অন্ধকার বনভূমি হইতে কেয়া ফুলের মৃদু সুরভি ভাসিয়া আসিতেছিল। ঠিক তেমনি তোমাকে কখনও দেখি নাই, কিন্তু তোমার সৌরভটুকু জানি।’ বেগম রোকেয়ার সঙ্গে শামসুন নাহারের পরিচয় হয় লেখালেখির মাধ্যমে। অল্প বয়সে শামসুন নাহারের প্রথম লেখা একটি কবিতা প্রকাশিত হয় কিশোরদের পত্রিকা ‘আঙুর’ পত্রিকায়। এরপর ‘নওরাজ’ এবং ‘সওগাত’সহ অন্যান্য পত্রিকায় তাঁর বেশ কিছু লেখা ছাপা হয়।

১৯০৮ সালের ১৯ অক্টোবর তিনি তৎকালীন ফেনী মহকুমার গুতুমা গ্রামে, মুন্সীবাড়িতে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মৌলভী মুহাম্মদ নুরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন মুন্সেফ এবং মা আছিয়া খাতুন চৌধুরী ছিলেন গৃহিনী। দুই ভাই বোনের মধ্যে বেগম শামসুর নাহার ছোট। বড় ভাই হাবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী ছিলেন সাহিত্যমনা ব্যক্তিত্ব। শিক্ষা ছিল তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্য। শামসুন নাহারের বয়স যখন ৬ মাস তখন তাঁর বাবা হঠাৎ মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর মা শিশুকন্যা নাহার ও ৩ বৎসরের পুত্র বাহারকে নিয়ে চট্টগ্রামে বাবার বাড়িতে চলে আসেন। তাঁর নানা আবদুল আজিজ ছিলেন চট্টগ্রামে ডিভিশনাল ইন্সপেক্টর অব স্কুল। তিনি শুধু উচ্চশিক্ষিতই ছিলেন না-ছিলেন উদারমনা শিক্ষাবিদ। নাহারকে ভর্তি করা হলো চট্টগ্রাম ডক্টর খাস্তগীর গার্লস হাই স্কুলে। পড়াশুনায় অত্যন্ত আগ্রহী ও নিষ্ঠাবান ছিলেন তিনি। সামাজিক বাধার কারণে উচ্চশিক্ষার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও শামসুন নাহার স্কুলের পড়া সম্পূর্ণ করতে পারলেন না। সমাজ আত্মীয়-স্বজনের নিন্দার ভয়ে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর তাঁকে স্কুল ছাড়তে হয়। কিন্তু ঘরে বন্দি থেকেও নাহার উচ্চশিক্ষার জন্য ব্যস্ত হয়ে পরেন। তাই তাঁর নানা একজন বৃদ্ধ হিন্দু শিক্ষক নিযুক্ত করেন নাতনিকে পড়াবার জন্য। নিয়মিত লেখাপড়া চলল এবং তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিলেন। ফল বের হলে দেখা গেল চারটি লেটারসহ প্রথম বিভাগে শতকরা আশির কাছাকাছি নম্বর পেয়ে পাশ করেছেন তিনি। ১৯২৬ সালে ডা. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদের সাথে বিয়ের পর শামসুর নাহার কলকাতায় যান। ডা. ওয়াহিদ মাহমুদ ছিলেন মুক্তমনা ও উদার। তাঁর অনুপ্রেরণায় পরীক্ষার প্রায় ৪/৫ মাস পর নাহার ভর্তি হলেন কলকাতার ডায়োসেশান কলেজে। ১৯২৮ সালে শামসুন নাহার আইএ পরীক্ষায় বিংশতিতম স্থান অধিকার  করেন। পরে ১৯৩২ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে ডিগ্রি পাশ করলেন ডিস্টিংশন নিয়ে।

এরপর বেশ কয়েক বছর তিনি সমাজসেবা, সাহিত্য সাধনা ও শিক্ষকতা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। দীর্ঘ ১০ বছর পর ১৯৪২ সালে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে এমএ পাশ করেন। ১৯২৬ সালে ডায়োসিসন কলেজে পড়ার সময় থেকে ১৯৩২ সালে বেগম রোকেয়ার মৃত্যু পর্যন্ত প্রায় সাত বছর বেগম শামসুন নাহার শুধু তাঁর ঘনিষ্ট সান্নিধ্য লাভের সুযোগই পাননি তাঁর সহকর্মী হিসেবে কাজ করার সুযোগও পেয়েছেন। সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুলে শিক্ষিকার অভাব পড়লেই অবৈতনিক শিক্ষয়িত্রীর কাজ করতেন তিনি। পরবর্তীকালে তিনি বেগম রোকেয়ার নারীশিক্ষা ও নারীমুক্তি আন্দোলনের অংশীদার হন।  বেগম রোকেয়া বহু আগেই ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ বা ‘নিখিল বঙ্গ’ মুসলিম মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শামসুন নাহার এই সমিতির সম্পাদিকার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ নানা ধরনের কাজ করে সুনাম অর্জন করেছে। এই কৃতিত্ব প্রধানত শামসুন নাহারের অদম্য উৎসাহ ও কর্ম প্রচেষ্টার ফল। ১৯৩২ সালে বেগম রোকেয়ার মৃত্যুর পর কলকাতার অ্যালবার্ট হলে একটি শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় শামসুন নাহার বেগম রোকেয়া সম্পর্কে খুব সুন্দর ও মর্মস্পর্শী বক্তৃতা করেন। ১৯৩৯ সালে বাংলার মুসলিম নারী সমাজের দাবিতে মেয়েদের উচ্চশিক্ষার জন্য তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ.কে ফজলুল হক প্রতিষ্ঠা করেন সরকারি কলেজ। বাংলাদেশের গভর্নরের স্ত্রীর নামানুসারে কলেজের নাম হল ‘লেডী ব্রাবোর্ন কলেজ’।

ফজলুল হক নিজেই বেগম শামসুন নাহার মাহমুদকে ঐ কলেজে অধ্যাপনার জন্য আহবান জানান। এমএ পাশ না করায় প্রথমে এ প্রস্তাবে তিনি রাজি হননি। কিন্তু পরে তাদের অনুরোধে রাজি হন এবং লেডী ব্রাবোর্ন কলেজে বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপিকা পদে যোগ দেন। তবে কথা রইল তিন বছরের মধ্যে এমএ পাশ করতে হবে। এ সময় ‘নিখিল ভারত মহিলা সম্মেলন’ এর কলকাতা শাখায় তিনি যোগ দেন। এই সম্মেলন তৎকালীন ভারতীয় নারীদের সার্বিক উন্নতির জন্য তাদের শিক্ষা, সামাজিক অধিকার, সুযোগ সুবিধা আদায়, দুঃস্থ ও দুর্গত নারীদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ ও সাহায্য করার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৩৫ সালে বৃটিশ সরকার ভারত শাসন সংস্কার আইন পাশ করেন। তখন পর্যন্ত ভারতীয় নারীদের ভোটাধিকার ছিল না। এই সময় শামসুন নাহার নিখিল ভারত মহিলা সম্মেলনের কলকাতা শাখার তরফ থেকে এদেশের মেয়েদের ভোটাধিকার নিয়ে ব্যাপকভাবে আন্দোলন চালাতে থাকেন। ফলে ভারতীয় নারীদের ভোটাধিকারের দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়ে আইন পাশ হয়। যার ফলে এদেশের মেয়েরা ভোট দেয়ার অধিকার পেলেন। এছাড়াও আন্দোলনের কারনে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার কয়েকটি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত করা হয়। ১৯৩৬ সালে কলকাতায় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনের অধিবেশন হয়। এই অধিবেশনে বাংলার মুসলমান নারী সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন তিনি। ১৯৪৩-৪৪ সালে বাংলাদেশে যে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় সে সময়ও তিনি ছিলেন দুঃস্থ দরিদ্র জনগণের পাশে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের ফলে তিনি স্বামী পুত্রসহ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন এবং রাজধানী ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। ১৯৫৫ সালে বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনি বাংলা একাডেমীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৫৫ সালে তিনি কলম্বোতে অনুষ্ঠিত ‘ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব উইমেন’-এর সুবর্ণ জয়ন্তী সম্মেলনে ছয় সদস্য বিশিষ্ট পাকিস্তানি নারী প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। পরে তিনি সমগ্র এশিয়ার জন্য এই আন্তর্জাতিক মৈত্রী সংঘের আঞ্চলিক পরিচালক হয়েছিলেন। দেশভাগের কয়েক বছর পর ঢাকায় নারীদের জন্য প্রতিষ্ঠিত ‘বেগম ক্লাব’এর তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী। এই ক্লাব তাঁর নেতৃত্বে নারীদের উন্নয়নমূলক, শিক্ষামূলক কাজের জন্য সভা, আলোচনা সভা, সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে বহুবার । তিনি ১৯৬২ সালে ঢাকা লেডিস ক্লাবের সভানেত্রী ছিলেন। শামসুন নাহারের চেষ্টায় ১৯৬১ সালে ‘পঙ্গু শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্র’ স্থাপিত হয়। তিনি ১৯৬৩ সালে সমগ্র পাকিস্তান শিশু কল্যাণ পরিষদের সভানেত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে লন্ডনে জাতিসংঘের উদ্যোগে ‘পারিবারিক আইনে নারীর মর্যাদা’ সম্পর্কে একটি সভা হয়। এতে পাকিস্তানের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে শামসুন নাহার যোগদান করেন। আই.এ পড়ার সময় তিনি ‘নওরোজ’ এবং ‘আত্মশক্তি’ পত্রিকার ‘মহিলা বিভাগ’ সম্পাদনা করতেন। এছাড়াও কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘বুলবুল’ পত্রিকাটির তিনি ও তাঁর ভাই যুগ্মভাবে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতেন। তাঁর প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে রয়েছে-‘পুণ্যময়ী’(১৯২৫), ‘ফুল বাগিচা’(১৯৩৫), ‘বেগম মহল’(১৯৩৬), ‘রোকেয়া জীবনী’(১৯৩৭), ‘শিশুর শিক্ষা’(১৯৩৯) ‘আমার দেখা তুরস্ক’(১৯৫৫), ‘নজরুলকে  যেমন দেখেছি’(১৯৫৮) প্রভৃতি। ‘সবুজ পাঠ’, ‘কিশোর সাথী’, ‘তাজমহল পাঠ’, ‘নতুন তাজমহল পাঠ’, ‘বিচিত্র পাঠ্য’ প্রভৃতিসহ বেশ কয়েকটি পাঠ্য পুস্তকও রচনা করেছিলেন তিনি। ১৯৪৪ সালে বৃটিশ সরকার তাঁকে শিক্ষাক্ষেত্র ও সমাজসেবার ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে এমবিই উপাধি দিয়ে সম্মানিত করে। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সরকার বেগম শামসুন নাহার মাহমুদকে মরণোত্তর ‘বেগম রোকেয়া পদক, ১৯৯৫’ প্রদান করে। ১৯৬৪ সালের ১০ এপ্রিল মাত্র ৫৬ বৎসর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। তাঁর নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের একটি আবাসিক হলের নামকরণ করা হয় শামসুন নাহার হল।