কে এই কমলা হ্যারিস?
অনলাইন ডেস্ক
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০৪:২১ পিএম, ১৩ আগস্ট ২০২০ বৃহস্পতিবার
কমলা হ্যারিস
আমেরিকা থেকে দু’বছরে এক বার ভারতে দাদু-দিদার কাছে আসত ছোট্ট মেয়েটা। তাঁদের বাড়ি ছিল চেন্নাইয়ের বেসান্ত নগরে । দাদুর (নানা) সঙ্গে সকাল বিকেল সমুদ্রসৈকতে হাঁটতে যাওয়া ছিল বালিকার প্রিয় আকর্ষণ। উচ্চপদস্থ আমলার দায়িত্ব থেকে অবসরগ্রহণের পরে বেসান্ত নগরেই সস্ত্রীক থাকতেন তার দাদু।
সে সময় নিজের বন্ধুদের সঙ্গে আর্থসামাজিক নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন দাদু। না বুঝলেও শুনতে ভাল লাগত ছোট্ট কমলার। তখন কি আর জানতেন, এক দিন এই সব বিষয় ঘিরেই আবর্তিত হবে তাঁর জীবন।
সে দিনের বালিকাই আজকের মার্কিন সেনেটর কমলা হ্যারিস। প্রথম অ-শ্বেতাঙ্গ মহিলা হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী। বর্ণবিদ্বেষের উত্তপ্ত আবহের মধ্যেই তাঁকে বেছে নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জো বাইডেন। যা মার্কিন ইতিহাসে নজিরবিহীন।
এই স্বীকৃতির কৃতিত্ব কমলা দিয়েছেন তাঁর মা শ্যামলা গোপালনকে। এন্ডোক্রিনোলজি নিয়ে গবেষণার জন্য শ্যামলা পাড়ি দিয়েছিলেন আমেরিকা। সেখানে বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে গবেষণা করেন তিনি। এর পর দেশে ফিরে সম্বন্ধ করে পছন্দ করা পাত্রকে বিয়ে করার কথা ছিল শ্যামলার।
কিন্তু তার বদলে তিনি আমেরিকায় শুধু থেকে গেলেন, তা-ই নয়, জড়িয়ে পড়লেন সেখানকার নাগরিক অধিকার রক্ষার আন্দোলনে। বিয়ে করলেন ডোনাল্ড হ্যারিসকে। আদতে জামাইকা (তখনও ব্রিটিশ উপনিবেশ) থেকে ষাটের দশকের একদম শুরুতে আমেরিকায় গিয়ে থিতু হন ডোনাল্ড।
ডোনাল্ডও আমেরিকায় পড়তে গিয়েছিলেন শ্যামলার মতো। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ছিলেন অর্থনীতির ছাত্র। তিনিও স্ত্রীর সঙ্গে একই আন্দোলনের শরিক হন। ডোনাল্ড-শ্যামলার বড় মেয়ে কমলার জন্ম ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ডে, ১৯৬৪-র ২০ অক্টোবর।
কমলার ছোট বোনের নাম মায়া লক্ষ্মী। বিজ্ঞানী শ্যামলার গভীর শ্রদ্ধা ছিল ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের উপর। তাই তাঁর দুই মেয়ের নামই হিন্দুধর্মের ধনসম্পদ ও শ্রীবৃদ্ধির দেবীর নাম অনুসারে। ছোট থেকেই মিশ্র সংস্কৃতিতে বড় হয়েছেন কমলা ও মায়া। গির্জায় সমবেত উপাসনাসঙ্গীতে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি তাঁরা নিয়মিত যেতেন মন্দিরেও।
কমলার যখন সাত বছর বয়স, তাঁর বাবা মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। দুই মেয়েকে নিয়ে আলাদা হয়ে যান শ্যামলা। তবে দুই বোনেরই তাঁদের বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। অর্থনীতির নামী অধ্যাপক বাবার কাছে ছুটি কাটাতেও যেতেন তাঁরা।
মায়ের পাশাপাশি কমলার জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিলেন তাঁর দাদু, পি ভি গোপালন। স্বাধীনতা সংগ্রামী গোপালন পরে উচ্চপদস্থ আমলার পদে আসীন ছিলেন দীর্ঘ দিন। গোপালনের মতোই দৃপ্ত ছিলেন তাঁর বিজ্ঞানীকন্যা শ্যামলাও। স্তন ক্যানসার নিয়ে গবেষণার জন্য পৃথিবীর নানা দেশে ঘুরেছেন তিনি। সঙ্গে নিয়ে যেতেন মেয়েদেরও।
মায়ের কাজের জন্য কমলার ছাত্রীজীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে কানাডার কুইবেক শহরে। কুইবেকে একটি হাসপাতালে গবেষণা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন শ্যামলা। কুইবেকের ছাত্রীজীবনের পরে হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন কমলা। ডক্টরেট সম্পূর্ণ করেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হেস্টিংস কলেজ অব দ্য ল’ থেকে।
মায়ের সঙ্গে কমলা ও মায়া থাকতেন ক্যালিফোর্নিয়ার অশ্বেতাঙ্গ প্রধান একটি এলাকায়। তাঁদের বন্ধুরা অনেকেই ছিলেন আফ্রিকান বংশোদ্ভূত। ফলে বর্ণবৈষম্যের সমস্যায় তাঁদের পড়তে হয়নি। ভারতীয় খাবার খাওয়া থেকে হাতে মেহেন্দি লাগানো, সবই করতেন বন্ধুদের সঙ্গে মিলেমিশে।
হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় রাজনীতিতে হাতেখড়ি। পাশাপাশি, হাওয়ার্ডে নিয়মিত বিতর্কসভায় অংশ নিয়ে বাগ্মী হয়ে ওঠেন কমলা হ্যারিস। ছোট থেকে তাঁর স্বপ্ন ছিল আইনজীবী হওয়ার। সে স্বপ্ন তিনি পূরণ করেছেন। দীর্ঘদিন সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন আইনজীবী হিসেবে। তিনি বরাবর সরব হয়েছেন মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করে।
১৯৯০ সাল তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যালামেডা কাউন্টির ডেপুটি ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির দায়িত্ব পান। এর পর ২০১০ সালে কমলা ক্যালিফর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল হন। প্রথম মার্কিন-আফ্রিকান এবং দক্ষিণ পূর্ব এশীয় বংশোদ্ভূত হিসেবে তিনি এই দায়িত্বে সম্মানিত হন। সাত বছর সান ফ্রান্সিসকোর ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি এবং তার পরে ক্যালিফর্নিয়ায় ছ’বছর অ্যাটর্নি জেনারেল থাকার পরে ২০১৬ সালে প্রথম অ-শ্বেতাঙ্গ মহিলা সেনেটর হিসেবে ক্যালিফর্নিয়া থেকে নির্বাচিত হন কমলা।
কমলাকে এক জন নির্ভীক যোদ্ধা বলেও বর্ণনা করেছেন বাইডেন। হ্যারিসকে মনোনীত করার পর বাইডেন বলেন, “আমরা দু’জনে মিলে এ বার ট্রাম্পকে কড়া টক্কর দেব।” বাইডেনের সহযোদ্ধা হিসেবে মনোনীত হওয়ার পর হ্যারিস টুইট করেন, “এই মনোনয়নের জন্য আমি গর্বিত। বাইডেন যাতে প্রেসিডেন্ট হতে পারেন তার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করব।”
ইন্দো-মার্কিনদের অনেকেই বাইডেনের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। ভাইস-প্রেসিডেন্টের দৌড়ে শামিল হওয়ার পরই কমলার সমর্থকরা প্রচার শুরু করেছেন, ‘আমেরিকা মে খিলা কমল’। তবে ইন্দো-মার্কিনদের মধ্যে আবার একটা অংশ কমলার মনোনয়ন নিয়ে খুব একটা সন্তুষ্ট নয়। তাঁরা ভারত-আমেরিকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে কমলার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
কমলা বিরোধী এই অংশের মতো প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও বাইডেনের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। কমলা হ্যারিসকে ‘ভয়ানক’ বলেও কটাক্ষ করেছেন তিনি। সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেন, “অবাক হচ্ছি, বাইডেন এ রকম এক জন ব্যক্তিকে কী ভাবে মনোনীত করতে পারলেন।!”
বরাবরই চরম ট্রাম্পবিরোধী বলে পরিচিত কমলা। মেক্সিকো সীমান্তে দেওয়াল তোলা থেকে শুরু করে অবৈধ অভিবাসী শিশুদের বাবা-মায়ের থেকে আলাদা করে আটকে রাখা— ট্রাম্প প্রশাসনের একের পর এক সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করেছেন তিনি।
এক সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়েও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন কমলা। সে সময় ট্রাম্পকে বিঁধেই প্রচার শানিয়েছিলেন তিনি। তাঁকে বলা হচ্ছিল ‘লেডি ওবামা’। অনেকেই ভেবেছিলেন, বারাক ওবামার পরে হয়তো আরও এক অশ্বেতাঙ্গ এবং প্রথম মহিলা হিসেবে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের আসনে বসতে চলেছেন।
কিন্তু শেষ অবধি কমলা হ্যারিস প্রেসিডেন্ট দৌড় থেকে নিজের নাম সরিয়ে নেন। প্রচার চালানোর মতো যথেষ্ট অর্থের অভাবেই যে মূলত তাঁকে দৌড় থেকে সরে আসতে হল, তা সমর্থকদের একটি ই-মেলে জানান পঞ্চাশোর্ধ্ব কমলা।
প্রেসিডেন্ট মনোনয়নের প্রথম দিকের বিতর্কে বাইডেনের বিভিন্ন নীতির সমালোচনা করেন কমলা। এমনকি বাইডেনের বিরুদ্ধে নানা বিষয় নিয়ে সেনেটে সরবও হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু নির্বাচনের আগে সেই হ্যারিসকেই তাঁর সঙ্গী হিসেবে মনোনীত করে সকলকে চমকে দিয়েছেন বাইডেন। মনে করা হচ্ছে, বর্ণবৈষম্য নিয়ে উত্তপ্ত আমেরিকায় নির্বাচনের আগে হ্যারিসকে বেছে নিয়ে অ-শ্বেতাঙ্গ ভোটব্যাঙ্ক নিশ্চিত করার পথ মসৃণ করলেন বাইডেন।
এই হাইপ্রোফাইল জীবনে এত কাজের চাপ তিনি কী ভাবে সামলান? জানিয়েছেন, দু’টি বিষয়ে তিনি গুরুত্ব দেন। প্রথমত নিয়মিত শরীরচর্চা এবং তৃপ্তি করে খাওয়াদাওয়া। রান্না করতেও খুব ভালবাসেন কমলা। রান্নায় তাঁর সঙ্গী হন, স্বামী ডগলাস এমহফও।
পেশায় আইনজীবী ডগলাসকে পঞ্চাশ বছর বয়সে বিয়ে করেন কমলা। তাঁর কথায়, ডগলাস খুবই ভাল রান্না করেন। তাঁরা দু’জনে এই রান্নাপর্ব খুব উপভোগ করেন। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন সময়ও আসে, যখন রান্না করার সময় থাকে না। তখন মনের চাপ কাটাতে বিভিন্ন পদের রেসিপি পড়েন মার্কিন রাজনীতির মানচিত্রে নতুন তারা কমলা হ্যারিস।
নিজেকে এক জন গর্বিত মার্কিন নাগরিক ভাবতে ভালবাসেন এই ভারতীয় বংশোদ্ভূত। মায়ের দেখিয়ে যাওয়া পথই তাঁর মূল জীবনদর্শন, এ কথা বহু বার বলেছেন তিনি। জীবনের শেষ দিন অবধি একটা কথাই বলতেন শ্যামলা। বলতেন, ‘‘তোমার কাজে তুমি প্রথম হতে পারো। কিন্তু দেখো যেন এই পথে তুমি-ই শেষ ব্যক্তি না হও।’’
ঠিক সেটাই চান কমলাও। নতুনদের পথ দেখাতে। আপাতত মার্কিন তথা বিশ্বরাজনীতির নজর এই শতদলের বিকশিত হওয়ার দিকেই। যিনি রাজনীতিক জীবনে বর্ণবৈষম্যের বহু কটাক্ষ সহ্য করেও নিজেকে করে তুলতে পেরেছেন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
সূত্র : বিবিসি বাংলা