ঢাকা, মঙ্গলবার ২৬, নভেম্বর ২০২৪ ১৬:২৬:০২ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

ধারাবাহিক উপন্যাস : আমি রোহিঙ্গা না

দীপু মাহমুদ

উইমেননিউজ২৪.কম

প্রকাশিত :

মরিজানের শরীর ভারী হয়ে এসেছে। কোমরে হাত রেখে টেনে টেনে হাঁটে। এভাবে হাঁটতে ভালো লাগে। কপালে চিকচিকে ঘাম। মুখে প্রশান্তির হাসি। গর্ভের সন্তান বড্ড বেশি নড়াচড়া করে। মরিজান আলতো করে নিজের পেটে হাত রাখল। আদর মাখা গলায় বলল, `মাকে দেখতে ইচ্ছে হয়? খুব বেশি? আচ্ছা আমি সেজেগুজে থাকব। তুই জন্মেই বলবি, ইয়া আল্লাহ্‌, আমার মা কী সুন্দর! তাকে দেখতে পরির মতো লাগে।` 
বাচিডং স্বাস্থ্য কেন্দ্রে এসে শুয়ে পড়ল মরিজান। অল্প একটু হেঁটেই কাহিল হয়ে পড়েছে। সন্তান আর গর্ভে থাকতে চাইছে না। সে আলোবাতাস দেখবে। মরিজানের প্রথম সন্তান হবে। রশিদউল্লাহর বাবা হওয়ার আনন্দ উথলে উঠছে। সে মরিজানকে জেলা সদরে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। মরিজান রাজি হয়নি। মংডু এখান থেকে অনেকদূর।
মরিজানের ব্যথা উঠেছে। সে রশিদউল্লাহর হাত আঁকড়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে ব্যথা সহ্য করার চেষ্টা করছে। ব্যথা সহ্য হচ্ছে না।
চমকে উঠেছে রশিদউল্লাহ। বাচিডং আগুনে জ্বলছে। কয়েকদিন ধরে শোনা কথা বুঝি সত্যি হলো! মগরা এসে বলেছিল, `এই দেশ তোদের না। তোরা এই দেশ ছেড়ে চলে যা।`
মরিজানের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়েছে রশিদউল্লাহ। সে বাড়ির দিকে দৌড় শুরু করেছে। তার বাড়ি আগুনে পুড়ছে। বাড়িতে বুড়ি মা আছেন। গোরু আছে, জমির ফসল তুলে রেখেছে। সেনাবাহিনী বাড়িতে আগুন দিয়েছে। আগুনে বুড়ি মা পুড়ছেন, চাষের গোরু পুড়ছে, জমির ফসল পুড়ছে। মা ডাকছেন, `ও রশিদ! আয় বাপ। ওরা আমাদের পুড়িয়ে মেরে ফেলল।`
রশিদউল্লাহ দৌড়াচ্ছে। মরিজান তার পেছনে। ভারী শরীর নিয়ে দৌড়াতে গিয়ে সে পিছিয়ে পড়েছে। আচমকা থমকে গেছে রশিদউল্লাহ। উলটে মুখ থুবড়ে পড়েছে মাটিতে। খুব কাছ থেকে সেনাবাহিনীর ছোড়া বুলেট তার বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছে। এক মগ ছুটে এসেছে। তার হাতে খোলা ছুরি। আগুনের আলোয় বিশাল ছুরি ঝলসে উঠেছে। মাটিতে পড়ে আছে রশিদউল্লাহ। তার দেহে প্রাণ আছে এখনো। সে গোঙাচ্ছে। ছুরি হাতে সেই মগ এগিয়ে এসেছে। ছুরি চালিয়েছে রশিদউল্লাহর গলায়। গোঙাতে গোঙাতে রশিদউল্লাহর ছটফটে দেহ নিথর হয়ে এসেছে। 
দাঁড়িয়ে পড়েছে মরিজান। সামনে তার বাড়ি পুড়ছে। পোয়াতি সংসার। বাড়িতে যেতে হলে স্বামীর লাশ ডিঙিয়ে যেতে হবে। পেটের সন্তান নড়ে উঠেছে। সে বাঁচতে চায়। পৃথিবীর আলো দেখবে বলে আকুল হয়ে হাত-পা ছুড়ছে। মরিজান ফিসফিস করে বলল, `ভয় পাস না। শক্ত হয়ে থাক। আমি তোকে বাঁচাব। আমি তোর মা।`
মরিজান বাড়ির পথ ছেড়ে ডানদিকে ছুটতে লাগল। ওদিকে নাফ নদী। ওপাশে শাহপরীর দ্বীপ। 
মরিজান দুই হাতে পেট চেপে ধরে ছুটছে। নাফ নদী পেরুলেই বাংলাদেশ। স্বাধীন এক দেশের ঠিকানা।
"আমি রোহিঙ্গা না" দেশহীন মানুষের কাহিনি। তীব্র দেশপ্রেম আর ভালোবাসার গল্প। ১০ বছর পর নাফ নদীতে নৌকা ভেসেছে। গন্তব্য মিয়ানমার। সেই নৌকায় মা। সে তাঁর জন্মভূমিতে ফিরে যাচ্ছে। সন্তান দুই হাঁটু মুড়ে বাংলাদেশের মাটি আঁকড়ে পড়ে আছে। এখানে জন্মেছে সে। এই তার জন্মভূমি।
মায়ের চোখে পানি। মা কাঁদছে।