রাবেয়া খাতুন আমার খালাম্মা
লুৎফর রহমান রিটন
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০৬:২৬ পিএম, ২৭ ডিসেম্বর ২০২০ রবিবার
ক্যাপশন ১> ডিসেম্বরের কোনো এক উজ্জ্বল সন্ধ্যায় বাংলা মোটর ইস্কাটন মোড়ে তাঁর ‘প্রপার্টি এনক্লেভ’-এর বাসভবনে সাপ্তাহিক ‘লাবণী’ পত্রিকার জন্যে কথাশিল্পী রাবেয়া খাতুনের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন লুৎফর রহমান রিটন। সময়কাল ডিসেম্বর ১৯৮৬
খালাম্মাকে (কথাশিল্পী রাবেয়া খাতুনকে) হাসানো আমার জন্যে সবচে সহজ কাজ এই পৃথিবীতে। আমার কথাবার্তায় ভীষণ মজা পান খালাম্মা। আমি আমার ছেলেবেলা থেকেই ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছি। আমি মজা করতে ভালোবাসি। আর তিনি মজা পেতে।
আমার সঙ্গে খালাম্মার সম্পর্কটা খুবই ইন্টারেস্টিং। অধিকাংশ সময়েই আমি তাঁর কাছে ছেলের মতো। কিন্তু কখনো কখনো আমি আমাদের সম্পর্ক আর বয়েসের ব্যবধানটা ঘুচিয়ে ফেলি। হয়ে উঠি দু'জন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ। আমাদের দু'জনের প্রধান কাজ লেখা। অসমবয়েসী আমরা দু'জন প্রায়ই সমসাময়িক কালের দু'জন লেখক হিশেবে পৃথিবীর যাবতীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করি দ্বিধাহীন। তখন আমি ভুলে যাই তিনি আমার খালাম্মা। এবং তিনিও ভুলে যান আমি তাঁর পুত্রবৎ। আমাদের আলোচনায় উঠে আসে জীবনের হাসি আনন্দ সুখ দুঃখের নানান উপাখ্যান। উঠে আসে মানব মানবীর জটিল সম্পর্কের নানান মোচড়। উঠে আসে জীবনের প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য গোপন গলিঘুপচির আলো অন্ধকারগুলোও।
আমাকে তিনি প্রশ্ন করে করে আমার মাধ্যমে জেনে নেন তাঁর প্রায় দুই প্রজন্ম আগের একজন পুরুষের জীবনদৃষ্টি। আমার ব্যক্তিজীবন। আমার দাম্পত্য জীবন। আমার প্রেম। আমার অভিমান। আমার সংগ্রাম। আমার জেদ—সব, সবকিছু। শার্লির সঙ্গে আমার একজীবনের ভালোবাসার গল্পও তিনি শোনেন গভীর অভিনিবেশ নিয়ে। জানতে চান প্রবাস জীবনের ঘাত প্রতিঘাতগুলো। প্রবাসের তরুণ-তরুণীদের মুক্ত স্বাধীন জীবন যাপনের সুফল আর কুফলগুলো। তিনি নিজে প্রায় সারা পৃথিবী ভ্রমণ করেছেন। নিজের চোখেই দেখেছেন বহুকিছু। তারপরেও আমার কাছ থেকে জানার চেষ্টা করেন। মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করেন তাঁর দেখা আর আমার দেখাকে। ভিন্ন বয়েসী আমাদের দু'জনের উপলব্ধির মিল অমিলগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যবচ্ছেদ করেন। একজন প্রকৃত লেখক তো সেটাই করে থাকেন। নিজের উপলব্ধিটা লেখেন ঠিকই কিন্তু অন্যের উপলব্ধিকেও মাথায় রাখেন।
যখনই ফোন করি খালাম্মাকে, শার্লির কথা তিনি জিজ্ঞেস করবেনই করবেন। আমাদের দু'জনকে একটা বইও উৎসর্গ করেছেন খালাম্মা। বইটার নাম ‘কৃস্টালের রাজহাঁস’। উৎসর্গপত্রে লিখেছেন—‘ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন ও শার্লি, রোমান্টিক জুটিকে।’
কতো স্মৃতি খালাম্মার সঙ্গে! কক্সবাজার সী বিচ, চান্দের গাড়ি, ইনানি বিচ, বগুড়া এফ কটেজ, কলকাতা বইমেলা, কলকাতা গ্র্যাণ্ড হোটেল সুইমিংপুল লবি, ব্যাংকক হসপিটাল—কোনটা রেখে কোনটা বলি। একটিমাত্র রচনায় সেগুলো লেখা সম্ভবও নয়। তবে যেখানেই গেছি আমার কথাবার্তা আর পাগলামি দেখে খালাম্মা তো হেসেই গুঁড়োগুঁড়ো হয়েছেন বারবার, প্রতিবার।
বছর তিন আগে, ২০১৭ সালে, নিজের বইয়ের লেখক সম্মানীর টাকার ভাগ দিলেন তিনি প্রত্যেক সন্তানকে। ফরিদুর রেজা সাগরকেও। একটা ভাগ পাঠিয়ে দিলেন আমাকেও। রাবেয়া খাতুন নামাঙ্কিত খামের ওপর আমার নামটি লিখলেন। তারপর সেই খামটা একজন বাহকের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন চ্যানেল আইতে, আমার কাছে। খাম খুলে দেখি ভেতরে কয়েকটা চকচকে নোট, পাঁচশ টাকার। ফোন দিলাম তাঁকে। খালাম্মা বললেন, এটা তোমার। আমার বইয়ের রয়্যালিটির টাকা। সাগর-কেকাদের সবাইকেই দিয়েছি। তুমি এটা খরচ করো।
আমি সেই টাকা খরচ না করে নিয়ে এসেছি কানাডায়।
০২
২০১০ সালে খালাম্মার সঙ্গে বগুড়ায় তাঁর শশুরবাড়ি যাওয়া হলো। বগুড়া টিটো হলে খালাম্মা আর সাগর ভাইয়ের সংবর্ধনা ছিলো সেবার। ঢাকা থেকে বড়সড় একটা দল ছিলো সেই যাত্রায়, তাঁদের সঙ্গে। অনুষ্ঠান বিকেলে।
সকাল বেলা খালাম্মা আমাকে নিয়ে গেলেন ‘এফ কটেজ’ নামের শান্তস্নিগ্ধ একটি বাড়িতে। বিয়ের পর স্বামী ফজজুল হকের (বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা ‘সিনেমা’র সম্পাদক এবং প্রথম ছোটদের চলচ্চিত্র ‘প্রেসিডেন্ট’-এর পরিচালক) সঙ্গে এই বাড়িটিতেই এসে উঠেছিলেন কথাশিল্পী রাবেয়া খাতুন। এটা তাঁর শশুরবাড়ি। এই বাড়ির প্রতিটি ইট-সুড়কি-গাছ-পাথরের সঙ্গে খালাম্মার প্রথম যৌবনের সহস্র স্মৃতি মিশে আছে।
অনেক আবেগ আর উচ্ছ্বাসের তোড়ে ভাসতে ভাসতে খালাম্মা আমাকে দেখালেন—এই ঘরটায় হয়েছিলো আমাদের প্রথম বাসর। সাগরের জন্ম এখানেই। তারপর ভেতর বাড়ির প্রশস্ত বারান্দায় নিয়ে গিয়ে দেখালেন—সকাল বেলায়, ঠিক এই জায়গাটায় নারকেল গাছের চিরল চিরল পাতার ফাঁক গলে রোদ আসতো প্রচুর। সেই রোদে সাগরকে এখানে আমি গোসল করাতাম।
আমি জানতে চাইলাম-- বাড়ির নাম ‘এফ কটেজ’ কেনো? খালাম্মা বললেন—সাগরের বাবা ফজলুল হক, ওর দুই চাচা ফজলুল করিম আর ফজলুল আলম। সবার নামের প্রথম অক্ষর এফ। সেই বিবেচনায় সাগরের বাবা বাড়িটার নাম দিয়েছিলেন ‘এফ কটেজ’।
ফজলুল হকের ক্রিয়েটিভিটি নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। নিজের দুই পুত্রকেও তিনি এফ এলফাবেটের আওতায় রেখে ‘এফ কটেজ’ভুক্ত করেছেন—ফরিদুর রেজা আর ফরহাদুর রেজা।
স্মৃতি হিশেবে এফ কটেজের ছোট্ট সেই নামফলকটিই এখনও যত্ন করে ঝুলিয়ে রাখা আছে বাড়ির একটি অংশে। খালাম্মা আমার হাত ধরে নিঃশব্দে সেই বাড়ির এইঘর সেইঘর, এই বারান্দা সেই বারান্দা, এই দরোজা সেই দরোজা, এই জানালা সেই জানালার কাছে ঘুরে ঘুরে এলেন কয়েকবার। আমি জানি ঠিক ওই সময়টায় খালাম্মা তাঁর প্রথম যৌবনের আনন্দের প্লাবনে ভেসে যাওয়া দিন আর রাত্রিগুলোর অনিঃশেষ সৌরভকে অনুভব করছিলেন তাঁর প্রতিটি নিঃশ্বাস আর চোখের পাপড়ির প্রতিটি কম্পনে। আমি চুপ করে ছিলাম। অহেতুক কথা বলে আমি খালাম্মার নিরবতার সৌন্দর্যটুকু নষ্ট করিনি একটুও।
প্রিয় খালাম্মা, সারাটা জীবন আপনি কতো কষ্টই না করেছেন। তরুণী থাকা অবস্থায় চার চারটি ছেলেমেয়েকে নিয়ে একলা একা পাড়ি দিয়েছেন জীবনের দীর্ঘ-দীর্ঘতম পথ। সেই পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিলো না। কিন্তু অনটন-ক্লান্তি-অবসাদ-না পাওয়ার বেদনা কোনোকিছুই আপনাকে টলাতে পারেনি, পারেনি থামিয়ে দিতে। জীবন আপনার সঙ্গে কানামাছি খেলতে চেয়েছে। উলটো জীবনকে নিয়ে আপনি কানামাছি খেলেছেন নিরন্তর।
আপনার অসংখ্য গল্প-উপন্যাসের শত সহস্র মুদ্রিত পৃষ্ঠা মুহুর্মুহু আপনাকে জয়ী ঘোষণা করছে।
০৩
২০১২ সালের ০৮ জানুয়ারি একটি পাঁচ-তারকা হোটেলে খালাম্মার একটি গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিখ্যাত লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী। সেবার তিনি খুব সুন্দর একটা বক্তৃতা করেছিলেন খালাম্মার ওপর। ওখানে বসে বসেই একটা টিস্যু পেপারের ভাঁজে ছোট্ট একটা কবিতা টুকেছিলাম 'রাবেয়া খাতুন' নামে। এমনই খুদে অক্ষরে যে সেটা আমি ছাড়া আর কেউই উদ্ধার করতে পারবে না। সেদিন, মঞ্চে শুভেচ্ছা বক্তব্য দিতে উঠে আমি পাঠ করেছিলাম তাঁকে নিয়ে লেখা এই কবিতাটি---
রাবেয়া খাতুন
লুৎফর রহমান রিটন
জীবনের রূপ-রস জীবনের নুন
সংসারে জমে থাকা তুষের আগুন
মুঠো মুঠো আনন্দ-স্ফূর্তির তূণ
স্বর্গীয় নির্মল নির্মম খুন
মানবজমিন সেঁচা প্রিয় অর্জুন
জীবনের পান থেকে খসে যাওয়া চুন
নকশী কাঁথার মতো ক্ষোভের উনুন
বিকশিত ঘুণপোকা সামাজিক ঘুণ
দ্রোহ-প্রেম-সংগ্রাম-বিষাদের ভ্রূণ
দেখেছেন, এঁকেছেন, রাবেয়া খাতুন।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সবচে বর্ষিয়ান কথাশিল্পী রাবেয়া খাতুন। আজ ২৭ ডিসেম্বর তাঁর জন্মদিন।
একটু আগেই জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে ফোন করেছিলাম তাঁকে,অটোয়া থেকে। টেলিফোনে আমি আমার নাম বলতেই বললেন তিনি--আমি তোমার কণ্ঠ শুনেই বুঝেছি তুমি রিটন। নাম বলার দরকার নেই। আমি বললাম--হ্যাপি বার্থ ডে খালাম্মা। তিনি বললেন, ধন্যবাদ।
পেন্ডামিকের কারণে কোনো আনুষ্ঠানিকতা থাকছে না আজ।
জন্মদিনে কেক কাটা হয়েছিলো তো রাত বারোটা এক মিনিটে? আমার প্রশ্নে খুবই আনন্দিত কণ্ঠে বললেন খালাম্মা--হ্যাঁ হয়েছিলো। খুবই উৎফুল্ল খালাম্মা আরো বললেন--কাল রাতে জন্মদিনে সাগর আমাকে হাতের চুড়ি গলার হার আর কানের দুল উপহার দিয়েছে!
রাবেয়া খাতুন, প্রিয় খালাম্মা, আটলান্টিকের এপার থেকে পঁচাশিতম জন্মদিনে অনেক অনেক শুভকামনা আপনার জন্যে।
২৭ ডিসেম্বর ২০২০