স্বাধীন ভূ-খণ্ডে পা রাখলেন বাংলার মহানায়ক
আইরীন নিয়াজী মান্না
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০৬:৪৫ পিএম, ১০ জানুয়ারি ২০২১ রবিবার
স্বাধীন ভূ-খণ্ডে পা রাখলেন বাংলার মহানায়ক
দেশ স্বাধীন হয়েছে। উল্লাসে আত্নহারা সারা দেশ। ঘর ছেড়ে বাইরে বেড়িয়ে এসেছে মুক্তিপাগল বাঙালি। লাখো লাখো স্বজনের জীবনের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা, তারপরও বড় সুখ বাঙালির মনে, বাঙালি আজ স্বাধীন। কিন্তু কোথায় যেন বিষাদের সুর! কারণ বাঙালির ত্রাণকর্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনও পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দি! কোথায় আছেন বাঙালির প্রাণের নেতা, কেমন আছেন? বেঁচে আছেন তো বাঙালির রক্ষাকর্তা শেখ মুজিব! এমন শত প্রশ্ন সদ্যস্বাধীন দেশের মানুষের মনে।
এদিকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের ফায়জালাবাদ (লায়ালপুর) সামরিক জেলে গোপনে বঙ্গবন্ধুর বিচার করা হয়। তারপর তাকে দেশদ্রোহী ঘোষণা করে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয়ী হলে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সেই আদেশ বাস্তবায়ন করতে পারেননি।
বিভিন্ন দেশ ও বিশ্বের মুক্তিকামী জনগণ বঙ্গবন্ধুর জীবনের নিরাপত্তার দাবি জানায়। ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জাতির জনক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি প্রদানের দাবি জানানো হয়।
ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। তিনি বাংলাদেশের স্থপতি, কাজেই পাকিস্তানের কোন অধিকার নেই তাকে বন্দি করে রাখার। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে বহু রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করেছে।
এদিকে পাকিস্তানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের পর, ইয়াহিয়া খানকে অপসারণ করে জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করেন। সেদিনই বঙ্গবন্ধুকে ঢাকার উদ্দেশ্যে লন্ডন পাঠান হয়। ৯ জানুয়ারি লন্ডনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সাথে সাক্ষাৎ হয় বঙ্গবন্ধুর।
এদিন লন্ডনে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু একটি বিবৃতি দেন। ‘জয় বাংলা’ রণধ্বনি উচ্চারণ করে তিনি বলেন, ‘বাংলার মুক্তিসংগ্রামে স্বাধীনতার অপরিসীম ও অনাবিল আনন্দ অনুভব করছি। এই মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। আমার জনগণ যখন আমাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেছে তখন আমি রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী হিসেবে একটি নির্জন ও পরিত্যক্ত সেলে বন্দি জীবন কাটাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সমর্থন ও সহযোগিতা দানের জন্য ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, ফ্রান্স ও ব্রিটেনকে আমি ধন্যবাদ জানাই। স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তব সত্য। এ দেশকে বিশ্বের স্বীকৃতি দিতে হবে। বাংলাদেশ অবিলম্বে জাতিসংঘের সদস্য পদের জন্য অনুরোধ জানাবে’।
বিবৃতির শেষে সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনি যে আপনার বাংলাদেশে ফিরে যাবেন সেই দেশ তো এখন ধ্বংসস্তূপ?’ তখন জাতির জনক দৃঢ়কণ্ঠে উত্তর দিয়েছিলেন, আমার বাংলার মানুষ যদি থাকে, বাংলার মাটি যদি থাকে, একদিন এই ধ্বংসস্তূপ থেকেই আমি আমার বাংলাদেশকে ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করবো’।
লন্ডন থেকে ঢাকা আসার পথে বঙ্গবন্ধু দিল্লিতে যাত্রা বিরতি করেন। বিমানবন্দরে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি. ভি. গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান।
তারপর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি স্বাধীন মাতৃভূমিতে পা রাখেন। দিনটি ছিলো সোমবার। তিনি ঢাকায় পৌঁছালে এক অবিস্মরণীয় সংবর্ধনা দেওয়া হয়। বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স লাখ লাখ মানুষ তাদের প্রিয় নেতা-স্বাধীনতার স্থপতিকে এক পলক দেখার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে। বরণডালা সাজিয়ে নিয়ে রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে থাকে সদ্যস্বাধীন বাঙালি। আবেগআপ্লুত বঙ্গবন্ধু বিমান বন্দর থেকে সরাসরি রেসকোর্স ময়দানে চলে যান। সেখানে অপেক্ষারত লাখ লাখ জনতার সমাবেশ থেকে অশ্রুসিক্ত চোখে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন জাতির স্বপ্নদ্রুষ্টা শেখ মুজিব। তার মুখে আজ ভাষা নেই; তিনি ক্লান্ত, অবসন্ন। স্বাধীন দেশে পা রেখে আজ আবেগআপ্লুত তার কন্ঠ, হৃদয় বিহবল। কি বলবেন আজ তিনি! শুধু অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখেন চারদিক। সবুজ-শ্যামল-স্বাধীন বাংলার রূপ যেন নতুনভাবে মুগ্ধ করে তাকে!
দীর্ঘ তেইশ বছরের পরাধীনতার শেকল ভেঙ্গে শেখ মুজিব বাঙালিকে দিয়েছেন মুক্তির স্বাদ। যুগের পর যুগ হাজারও জেল-জুলুম আর অত্যাচার সহ্য করে লড়াই করে বাঙালির জন্য ছিনিয়ে এনেছেন স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। আজ যে তিনি ভীষণ ক্লান্ত! পাকিস্তানের সেই অন্ধকার জেলখানায় তার প্রতিটি মুহুর্ত কেটেছে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে। তার দিন কেটেছে অন্ধ কুঠুরিতে বসে নিজের কবর খোড়ার শব্দ শুনে। আজ তো তিনি ক্লান্ত হবেনই। দীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাস শেষে তিনিই বাঙালিকে দিয়েছেন একটি মুক্ত স্বদেশ। বাঙালি তাকে বসিয়েছে নিজ হৃদয়ে পিতার আসনে। একটি নতুন রাষ্ট্রের নির্মাতা তিনি। তিনি যে বাংলার জাতির পিতা!
রেসকোর্স ময়দান থেকে জাতির পিতা এবার গেলেন ধানমন্ডির ১৮ নম্বর বাড়িতে। এ বাড়িতে তার পরিবারের সদস্যরা অবস্থান করছিলেন। সেই বাড়ির সামনে আর একটি বাড়ি তখন জাতির পিতার জন্য রাখা হয়েছিল। কেননা ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়িটি শত্রু বাহিনী এমনভাবে তছনছ করে দিয়েছিল। বাড়িটি বসবাসের উপযুক্ত ছিল না। অথচ অবিস্মরণীয় এই বাড়িটি কালের সাক্ষি; বাঙালির মুক্তির ঠিকানা।
লেখক: সম্পাদক-উইমেননিউজ২৪.কম