৫২ থেকে ৭১: ভাষা থেকে স্বাধীনতা
আইরীন নিয়াজী মান্না
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০৯:১২ পিএম, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ রবিবার
৫২ থেকে ৭১: ভাষা থেকে স্বাধীনতা
সারা পৃথিবীতে বাঙালী জাতিই একমাত্র জাতি যারা মাতৃভাষা রক্ষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলো। নিজেদের জীবনের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠা করেছিল রাষ্ট্রভাষা ‘বাংলা’কে। আজ থেকে ঠিক ৬৯ বছর আগে মায়ের মুখের ভাষা রক্ষা করতে গিয়ে বাংলার দামাল ছেলেরা আকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছিল। মায়ের মুখের ভাষা রক্ষার জন্য তারা লড়াই করেছে অত্যাচারি, নির্যাতনকারী শাসকদের বিরুদ্ধে! সালাম, রফিক, জব্বার, শফিকদের আত্নত্যাগের কাহিনী মায়ের মুখের ভাষা-রাষ্ট্র ভাষা রক্ষার জন্য জীবন বিলীন করে দেয়ার এক মহান গল্প।
এই উপমহাদেশে এক সময় আমরা সবাই এক সাথে ছিলাম। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব বাংলা) এক সঙ্গে মিলে ছিলো ভারতীয় উপমহাদেশ। প্রায় দুই শ বছরের শাসন ও শোষণের পর ১৯৪৭ সালে বৃটিশরা উপমহাদেশ ছেড়ে চলে গেলে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সময়ের স্রোতধারায় রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও জাতিগত কারণে আমরা বিভক্ত হয়ে পরি ভারত ও পাকিস্তান নামে। আমাদের এই বাংলাদেশের তখন নাম ছিলো পূর্ব বাংলা।
পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষ মুসলমান হওয়ার কারণে শুধু ধর্মের ভিত্তিতে আমরা এক রকম বাধ্য হয়েই পাকিস্তানের পক্ষে ছিলাম। তারপর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের নিপিড়ন, নির্যাতন আর বঞ্চনার মধ্যে দিয়ে পূর্ব বাংলার লাখ লাখ মানুষের জীবন কাটছিলো। কিন্তু এক সময় শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণ এ দু অঞ্চলের মিলকে ধরে রাখতে পারলো না। যেহেতু পশ্চিম পাকিস্তার আমাদের চেয়ে শক্তিশালী তাই কেন্দ্রীয়ভাবে দুই অঞ্চলকে তারাই নিয়ন্ত্রণ করতো। তারা বিভিন্ন দিক থেকে আমাদের শোষণ করতে শুরু করলো। সেই শোষণের কালো থাবা অর্থনীতি ও সামাজিক গন্ডি পেড়িয়ে আমাদের ভাষার ওপর এসে পড়লো। বাঙালী জাতির মুখের ভাষা, মায়ের ভাষায় এসে পাকিস্তানী শোষকেরা হস্তক্ষেপ করতে শুরু করলো।
ভাষা আন্দোলন শুরুর প্রেক্ষাপট:
দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের আলোকে সংখ্যাগরিষ্ট মুসলমানদের জন্য রাষ্ট্রসমূহ প্রতিষ্ঠা লাভের কথা থাকলেও বাস্তবে তা হয়নি। ফলে দুটি আলাদা বৈশিষ্টপূর্ণ ভূখন্ড নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। এর একটি হলো পূর্ব পাকিস্তান আর অপরটি হলো পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব বাংলা অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝখানে ভারত অবস্থিত। এ দুই অংশের মধ্যে ব্যবধান ছিলো প্রায় দেড় হাজার মাইল। পাকিস্তানের এই দু অঞ্চলের ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, লোকাচার ও জীবন-জীবিকার মাঝে কখনো সুসম্পর্ক ও সুভ্রাতৃত্ব গড়ে উঠতে পারেনি। ভৌগোলিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পার্থক্যের মতো দুই অঞ্চলের অর্থনৈতিক বৈষম্যও দিনে দিনে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
পাকিস্তানের লোক সংখ্যার ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলা সংখ্যাগরিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও স্বাধিকারের ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলা ক্রমাগত উপক্ষিত হতে থাকে। পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদে পূর্ব বাংলার সংখ্যাধিক্য থাকা সত্ত্বেও গভর্ণর জেনারেল ও প্রধানমন্ত্রী উভয় পদেই নিয়োগ করা হয় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। সংখ্যাগরিষ্টের দাবিকে উপেক্ষা করে পাকিস্তানের রাজধানীও প্রতিষ্ঠিত হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। দেশরক্ষা বাহিনী ও সিভিল সার্ভিসের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে পূর্ব বাংলার জনসাধারণ সংখ্যানুপাতে স্থান লাভ করতে পারেনি। এমনি ভাবেই পাকিস্তান সৃষ্টির গোড়া থেকেই পূর্ব বাংলা শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হতে থাকে। কেবল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবেই নয়, ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষপাত ও বৈষম্যমূলক আচরণ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের মুখের ভাষা বাংলা হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে এ ভাষাকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কখনো স্বীকৃতি দেয়নি। ফলে পূর্ব বাংলার মানুষ স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানিদের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে শুরু করে। পাকিস্তানির দু‘অংশের সাংস্কৃতিক পার্থক্যের কারণে প্রথম সংঘাত বাধে ভাষা নিয়ে।
ভাষা আন্দোলন :
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাসে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন একটি অনন্য ঐতিহাসিক ঘটনা। পাকিস্তানের জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষের মাতৃভাষা ছিলো বাংলা। অপর পক্ষে সমস্ত পাকিস্তানের উর্দু ভাষাভাষির সংখ্যা ছিলো মাত্র ছয় ভাগ। সে হিসেবে দেখা যায়, বাংলা ভাষাই ছিলো পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের ভাষা। কিন্তু তারপরও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে বাংলাকে উপেক্ষা করতে থাকে।
পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে বাংলা ভাষার কথা আলোচিত হয়। ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় তাসাদ্দুক হোসেনের সভাপতিত্বে পূর্ব পাকিস্তান যুব কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনেই প্রথম পূর্ব পাকিস্তানের অফিস ও আইন-আদালতের ভাষা এবং শিক্ষার বাহন হিসেবে বাংলাকে চালু করার দাবি জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এরপর পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবি নিয়ে এগিয়ে আসে ‘তমদ্দুন মজলিশ’। তমদ্দুন মজলিশ ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তারিখে ভাষা আন্দোলনের প্রথম বই - পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু প্রকাশ করে। এই বইয়ের লেখক ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাসেম, ড. কাজী মোতাহান হোসেন এবং আবুল মনসুর আহমদ। তারা বাংলা ভাষার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে উর্দুর সাথে বাংলাকেও পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানান এবং ভাষা আন্দোলনের রুপরেখা তুলে ধরেন। এই বইয়ে অধ্যাপক আবুল কাসেম পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি মানুষকে ভাষা আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য আহবান জানান।
তমদ্দুন মজলিশ ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে ভাষা আন্দোলনের সাংগঠনিক রুপদানের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। এই সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর বা আহবায়ক নির্বাচিত হন নূরুল হক ভূঁইয়া। এ সময় রাষ্ট্রভাষা বাংলার যৌক্তিকতা মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করার উদ্দেশ্যে তমদ্দুন মজলিশের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এমনি একটি সভা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানে বক্তব্য রাখেন হাবীবুল্লাহ বাহার, ড. কাজী মোতাহান হোসেন, অধ্যাপক আবুল কাসেম প্রমূখ।
১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে করাচীতে পাকিস্তান সরকারের এক শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে একটি ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা সৈয়দ আফজালসহ অন্যান্য মন্ত্রীদের সঙ্গে দেখা করে বাংলা ভাষার সমর্থনে তাদের প্রতিশ্রুতি আদায় করেন। এভাবেই ৫২-র ভাষা আন্দোলনের প্রথম সূত্রপাত হয়।
তারপর ১৯৪৮ সালের জানুয়ারী মাসে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার উদ্দেশ্যে ঢাকায় নতুন করে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদ ভাষার প্রশ্নে যে দাবি পেশ করে তা ছিলো ১. বাংলা ভাষাই পূর্ব বাংলার (পূর্ব পাকিস্তানের) শিক্ষা বাহন ও অফিস-আদালতের ভাষা হবে এবং ২. পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে দুটি-বাংলা ও উর্দু।
১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে ইংরেজির পাশাপাশি উর্দু ভাষাতে অধিবেশনের কার্যক্রম রেকর্ড করা শুরু হলে পূর্ব বাংলার গণপরিষদ সদস্য কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রতিবাদ করেন এবং বাংলা ভাষাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে সরকারী স্বীকৃতির দাবি জানান। কিন্তু গণপরিষদ তার এই দাবি প্রত্যাখ্যান করলে পূর্ব বাংলার ছাত্র-শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবি মহলে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দেয়। এর প্রতিবাদে ২৬ ফেব্রুয়ারী ঢাকায় ধর্মঘট আহবান করা হয়।
পরবর্তিতে ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ রাষ্ট্রভাষার দাবি বাস্তবায়নের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন সংগঠনের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় কামরুদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে একটি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এই সংগ্রাম পরিষদ রাষ্ট্রভাষার ক্ষেত্রে সরকারের ষড়যন্ত্র রোধ করার জন্য ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। ঐদিন ঢাকায় বহু ছাত্র আহত হন। এবং তরুণ ছাত্রনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক ও অলি আহমদসহ অনেকে গ্রেফতার হন। এই ঘটনার প্রতিবাদে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৩ মার্চ আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয় এবং এ ধর্মঘট ১৫ মার্চ পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন সংগ্রাম পরিষদের সাথে ১৫ মার্চ আলোচনায় বসেন এবং একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিতে আটক ছাত্রদের মুক্তিদান, পুলিশের অত্যাচার তদন্ত, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব আইন পরিষদে উত্থাপন ও ১৪৪ ধারাসহ সংবাদপত্রের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ইত্যাদি বিষয় অর্ন্তভূক্ত ছিলো।
১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ্ ঢাকায় আসেন। ২১ মার্চ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে যা সোহরাওয়ার্দ্দি উদ্যান) তিনি জনতার উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ দেন। এই জনসভায় তিনি ঘোষণা করেন ‘উর্দু একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’।
২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানেও তিনি একই কথার পুনরাবৃত্তি করলে উপস্থিত ছাত্ররা এক সঙ্গে ‘নো, নো’ বলে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ওই দিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ্কে একটি স্মারকলিপি প্রদান করা হয়।
আরবি হরফে বাংলা প্রচলনের চেষ্টা:
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ভাষার ক্ষেত্রে তাদের ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করা কখনো বন্ধ করেনি। ১৯৪৮ সালে করাচীতে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে ইসলামী আদর্শের খাতিরে বাংলা ভাষার জন্য ‘আরবি হরফ’ বা প্রকারান্তরে ‘উর্দু হরফ’ গ্রহণের প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। বাংলা ভাষায় আরবি হরফ প্রবর্তনের এই জঘন্য প্রচেষ্টার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীরা ১৯৪৯ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তান শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ড ও বর্ণমালা বিশেষজ্ঞ কমিটির কাছে একটি স্বারকলিপি পেশ করে। এই স্বারকলিপিতে বাংলা হরফ পরিবর্তন না করার দাবি জানান হয়।
ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়:
১৯৪৯ সালের ৯ মার্চ পূর্ব বাংলা সরকার বাংলা ভাষা সংস্কারের নামে বাংলা ভাষা কমিটি গঠন করে। এই কমিটির সভাপতি ছিলেন মওলানা আকরাম খাঁ।
১৯৪৯ সালের শেষ দিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকায় আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের পক্ষ থেকে তাকে দেয়া একটি মানপত্রে বাংলা ভাষার দাবি আবার উত্থাপন করা হয়। কিন্তু লিয়াকত আলী খান এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। ১৯৪৯ সালের পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভাষার প্রশ্নটি আবারো উত্থাপন করেন।
১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান গণপরিষদে আবারো ঘোষণা করেন যে, উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে। পূর্ব বাংলার জনগণ এ ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রচন্ড প্রতিবাদ জানায়। ফলে গণপরিষদে ভাষার প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা স্থগিত হয়ে যায়।
১৯৫১ সালে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান আঁততায়ীর হাতে মৃত্যুবরণ করলে খাজা নাজিমউদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি ঢাকায় এক জনসভায় তিনি ঘোষণা করেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। খাজা নাজিমউদ্দিনের এই ঘোষণায় পূর্ব বাংলার গণমানসে প্রচন্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ফলে এর প্রতিবাদে প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট ও হরতাল পালনের কর্মসুচি গ্রহণ করা হয়। সেদিনই আতাউর রহমানের সভাপতিত্বে কাজী গোলাম মাহবুবকে আহবায়ক করে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করা হয়। এই সংগ্রাম কমিটি রাষ্ট্রভাষার দাবি প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি ৪ ফেব্রুয়ারী ছাত্র ধর্মঘট ও ২১ ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং সারা দেশে হরতাল পালনের কর্মসুচি গ্রহণ করে।
এদিকে ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী ঢাকায় কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় রাষ্ট্রভাষা বাংলা এবং বন্দী মুক্তির দাবিতে শেখ মুজিব ও ছাত্রনেতা মহিউদ্দিন আহমেদ আমরণ অনশন শুরু করেন।
নূরুল আমিন সরকার ছাত্র আন্দোলনের ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ২০ ফেব্র“য়ারী বিকেল ৩টায় ১৪৪ ধারা জারি করে মিছিল ও জনসমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু ২১ ফেব্র“য়ারী ছাত্র-ছাত্রীরা এক সাথে মিলিত হয়ে সংগঠিতভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে মিছিল বের করে। এই মিছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগান দিতে দিতে অধিবেশনরত প্রাদেশীক পরিষদের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে ছাত্ররা বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ চত্বরে সমবেত হয়। এ সময় পুলিশ এই সব ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করলে ছাত্র-জনতার সাথে পুলিশের সংঘর্ষ বেধে যায়। সংঘর্ষের এক পর্যায় পুলিশ ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষন করতে শুরু করে। এ সময় পুলিশের গুলিতে জব্বার, রফিক, সালামসহ অনেকে শহীদ হন। আহত হন বিপুলসংখ্যক ছাত্র-জনতা।
এই হত্যাকান্ডের খবর দাবানলের মতো রাজধানী ঢাকায় ছড়িয়ে পরে। এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারী ছাত্র-জনতার একটি বিশাল শোভাযাত্রা বের হয়। এ শোভাযাত্রার উপরেও পুলিশ নির্দয়ভাবে গুলি চালায়। ফলে এদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে শফিউর রহমান নামে একজন মারা যান। এদিনই ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসে ছাত্রদের আলোচনায় সকল শহীদের স্মৃতি রক্ষার জন্য একটি শহীদ মিনার নির্মানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সিদ্ধান্ত মতো সারা রাত কাজ করে ছাত্রারা ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে ১২ ফুট উচু একটি শহীদ মিনার নির্মান করে। পরের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারী শহীদ শফিউর রহমানের পিতা আনুষ্ঠানিকভাবে এই শহীদ মিনার উদ্ধোধন করেন। কিন্তু শহীদ মিনারটি ২৪ ফেব্রুয়ারী পুলিশ ভেঙ্গে ফেলে। ২১ ফেব্রুয়ারীর শহীদদের স্মৃতিকে ধারণ করে পরে সেখানে আরেকটি মিনার গড়ে ওঠে, সেটিই বর্তমানে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার।
অবশেষে নূরুল আমিন সরকার প্রাদেশীক পরিষদে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গণ্য করার জন্য গণপরিষদে প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে। তারপর অবিরাম ছাত্র ও গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রদান করা হয়।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিলো পূর্ব বাংলার অধিকার বঞ্চিত মানুষের গণচেতনার প্রথম সংগঠিত বহিঃপ্রকাশ। এই ভাষা আন্দোলনের চেতনাই পরবর্তীকালে প্রতিটি গণআন্দোলনে প্রেরণা যোগায় এবং জনগণের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির পথকে সুগম করে স্বাধীনতা অর্জনে সাহায্য করে।
আইরীন নিয়াজী মান্না: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। সম্পাদক-উইমেননিউজ২৪.কম