ইতিহাসের পাতা থেকে: কেমন ছিলো বঙ্গবন্ধুর সেই দিনটি
দীপন নন্দী
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০৭:৪৮ পিএম, ৭ মার্চ ২০২১ রবিবার
ইতিহাসের পাতা থেকে কেমন ছিলো বঙ্গবন্ধুর সেই দিনটি
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর বাংলার স্বাধীনতা একই সূত্রে গাথা। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য নেতৃত্বে সাড়ে ৭ কোটি বাঙালী পাকদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরেছিলো মুক্তিযুদ্ধে। সে ইতিহাস সকলের জানা। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ যে বজ্রকণ্ঠ ভাষণের মাধ্যমে তিনি ঐক্যবদ্ধ করে তুলেছিলেন সমগ্র জাতিকে, পাকিস্তনী শাসকের বিরুদ্ধে সরাসরি
ঘোষণা করেছিলেন দেশের স্বাধীনতা সে দিনটি কেমন কেটেছিলো এই মহান নেতার। সেদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত জাতির পিতার কিভাবে কেটেছিলো সময় তা তোমাদের জানাচ্ছেন দীপন নন্দী।
দুধেল বর্ণের পাঞ্জাবি। তার উপর হাতাকাটা কালো কোট পরে দৃঢ়তার সাথে মঞ্চে উঠলেন দীর্ঘদেহী এক বাঙালি। পরবর্তীতে যে ব্যক্তি পরিণত হন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে। জীবনের অর্ধশত বসন্ত পার করে আসা সেই বাঙালির নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। সেদিন তিনি মঞ্চে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন সাত কোটি বাঙালির ভবিষ্যত, আত্নসস্মান আর অধিকার আদায়ের জাদুমন্ত্র। সে মন্ত্রে নিজেকে মন্ত্রমুগ্ধ করতে সেদিন পূর্ব বাংলার টেকনাফ থেকে তেতুঁলিয়া, সর্বত্র থেকে লাখো জনতা এসে মিশেছিলেন রেসকোর্স ময়দানে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য ও ভিডিও ফুটেজ দেখে বোঝা যায়, সেদিন আক্ষরিক অর্থেই জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিলো রেসকোর্স ময়দান (আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)। সেদিনের সেই ভাষণ শুধু বাঙালির স্বাধীনতার ঘোষণাই ছিলো না, ছিলো এক অমরকাব্য। আর সেই কাব্যের কবি আমাদের জাতির জনক। বাঙালির অবিসংবাদিত এই নেতা ৭ মার্চের ভাষণে কী বলেছিলেন, সেই ভাষণের দিক নির্দেশনায় বাঙালি জাতি যে মরণপণ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলÑতা আজ কারও অজানা নয়। কিন্তু সেদিনটি কেমন কেটেছিল বঙ্গবন্ধুর? কিরূপ প্রস্তুতি ছিলো তার ভাষণের আগের-এ কথাগুলো এখনও অনেকেরই অজানা। তেমনি অজানা, সেদিন রাতের কথাও।
দলীয় নেতাদের সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠক : ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সকাল থেকেই ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ভিড় জমাতে শুরু করেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। বঙ্গবন্ধুর জামাতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া তার স্মৃতিকথায় লেখেন, ‘ঐদিন বঙ্গবন্ধু তার বাসভবনের লাইব্রেরি কক্ষে তাজউদ্দিন আহমদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, ড. কামাল হোসেনসহ আরো কয়েকজনকে নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে অংশ নেন। ঘন্টাব্যাপী বৈঠকের পর বঙ্গবন্ধু সবাইকে বলেন, ছাত্রজনতার দাবির সাথে তারা একমত পোষণ করেছেন এবং বিকেলে রেসকোর্সে চারদফা দাবি পেশ করা হবে।’ এরপর ড. কামাল হোসেনকে চারদফার খসড়া তৈরি করতে বলেন। দুপুরের খাবারের পর তিনি বিশ্রাম নেওয়ার সময়, তাকে চূড়ান্ত কপিটি দেখানো হয়। কপিটি টাইপ করেছিলেন মোহাম্মদ হানিফ। এ সময় বঙ্গবন্ধু আমাকে টাইপ কপির সাথে মূল কপিটি মিলিয়ে দেখার নির্দেশ দেন।’
কি ছিল সেই চার দফা : ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’-বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে মন্ত্রের মত সেইসব উচ্চারণ আজও উদ্বেলিত করে প্রত্যেক বাংলাদেশীকে। যে কোন আন্দোলনে তার সেই ভরাট কণ্ঠস্বর প্রেরণা জোগায়। অথচ সেদিন যখন ভাষণের ঘোষণাপত্র তৈরি হচ্ছিল সেখানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের এসব কথার কোন ছাপই ছিল না। ঘোষণাপত্র প্রসঙ্গে বিস্তারিত উঠে এসেছে এম এ ওয়াজেদ আলীর স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থে। সেদিন ৭ মার্চে ঘোষণাপত্রের চূড়ান্ত কপিটি মিলিয়ে দেখার এক পর্যায়ে তিনি খন্দকার মোশতাককে জিজ্ঞেস করেন, ‘ইশতেহারে স্বাধীনতার ঘোষণার কথা উল্লেখ করা হয়েছে কিনা।’
তিনি বলেন, ‘সামরিক শাসনের ক্ষমতাবলে জারীকৃত আইনগত কাঠামোর অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে ঢাকায় বসে পাকিস্তানের অখন্ডতা লঙ্ঘন সংক্রান্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার ব্যাপারটি খুব ঝুঁকিপূর্ণ। সুতরাং, এই ব্যাপারটা ইশতেহারে লেখা হয়নি।’
সেদিনের ইশতেহারে ইয়াহিয়া খানের নিকট চার দফা দাবি করা হয়। দাবিগুলো হলো, ১. সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে। ২. পহেলা মার্চ হতে আন্দোলনে যে সমস্ত ভাইবোনকে হত্যা করা হয়েছে, সে বিষয়ে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিশন গঠনের মাধ্যমে তদন্ত করে সে ব্যাপারে দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে। ৩. সামরিক আইন অবিলম্বে প্রত্যাহার করে নিতে হবে। ৪. অবিলম্বে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাপ্রাপ্ত দলের নেতার কাছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
রেসকোর্সের পথে : রেসকোর্সে রওয়ানা হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু কয়েকজন নেতাকর্মীকে ডেকে বলেন, ‘চার দফার এই ইশতেহারটি দেশি ও বিদেশি সাংবাদিকদের মাঝে বিলি করবে।’ এই বলে তিনি একটি ট্রাকে উঠে যাত্রা করেন। এ সময় সেই ট্রাকে ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি গাজী গোলাম মোস্তফা, শেখ ফজলুল হক মণি, ছাত্রলীগের প্রাক্তন সহ-সভাপতি তোফায়েল আহমদ, নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন, সিরাজুল আলম খান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। এছাড়া মোস্তফা মহসীন মন্টু, কামরুল আলম খসরু, মহিউদ্দিন, আ স ম আবদুর রব ও শাহজাহান সিরাজসহ অন্যান্য নেতাকর্মীরা অন্য একটি ট্রাকে ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্প্রচার হঠাৎ করে বন্ধ : সেদিন রেসকোর্সে নৌকা আকৃতির সভামঞ্চটি স্থাপন করা হয়েছিল বর্তমান শিশুপার্কের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে। বঙ্গবন্ধু বেরিয়ে যাবার পর একটি গাড়ি নিয়ে শেখ হাসিনাসহ অন্যান্যদের নিয়ে যাত্রা করেন ওয়াজেদ মিয়া। মঞ্চের কাছাকাছি পৌঁছে শেখ হাসিনা রেডিও চালু করতে বলেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্প্রচারের কথা এ সময় রেডিওতে বারবার ঘোষণা করা হচ্ছিল। কিন্তু ভাষণ শুরু হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই রেডিও নিস্তব্ধ। সম্প্রচারের অনুমতি থাকার পরেও সরকারের তাৎক্ষনিক নির্দেশে ভাষণ সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়। সেদিন রাতে ইকবাল বাহার চৌধুরীর নেতৃত্বে রেডিও পাকিস্তান কেন্দ্রের সকল কর্মকর্তারা ৩২ নম্বরের বাসায় এসে বঙ্গবন্ধুকে জানান, এ ভাষণ সম্প্রচার করতে না দেয়া পর্যন্ত তারা কাজে যোগ দেবেন না। এদিন রেডিও পাকিস্তানের সকল অনুষ্ঠান বন্ধ ছিল। ৮ মার্চ সকাল ৮টায় পাকিস্তান রেডিও ঢাকা কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হয়, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের ভাষণ হুবহু সকাল ৯টায় প্রচার করা হবে।
এ প্রসঙ্গে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, ‘রেডিওর ঘোষকরা আগে থেকেই রেসকোর্স থেকে ইস্পাত দৃঢ় দর্শকের নজিরবিহীন উদ্দীপনার কথা প্রচার করতে শুরু করে।’ তিনি আরো লেখেন, ‘এই ব্যাপারে সামরিক আইন প্রশাসকের দপ্তর হস্তক্ষেপ করে এই বাজে ব্যাপারটি বন্ধের নিদের্শ দেন। সে কথা মতো আমি রেডিও কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেই। আদেশটি শুনে টেলিফোনের ওপারে থাকা বাঙালি অফিসার আমাকে বলেন, “আমরা যদি সাড়ে সাত কোটি জনগণের কণ্ঠ প্রচার করতে না পারি তাহলে আমরা কাজই করব না।” এই কথার সাথে সাথে বেতার কেন্দ্র নীরব হয়ে যায়।’
‘‘এখন থেকে একসাথে দু’বেলা একত্রে খাব’’ : রেসকোর্স ময়দানে অবিন্বশর সেই ভাষণ শেষে তিনি রাতে পুরো পরিবারকে সাথে নিয়ে রাতের খাবার খেতে বসেন। এ সময় বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, শেখ হাসিনা, ওয়াজেদ মিয়া, শেখ কামাল, শেখ জামাল, রেহানা, রাসেল, শেখ শহীদ উপস্থিত ছিলেন। তিনি এ সময় গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘আমার যা বলার ছিল আজকের জনসভায় তা প্রকাশ্যে বলে ফেলেছি। সরকার এখন আমাকে যে কোন মূহুর্তে গ্রেফতার করতে পারে। সেজন্য আজ থেকে তোমরা প্রতিদিন দুবেলা আমার সঙ্গে খাবে।’ সেদিন থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত প্রতিদিন বঙ্গবন্ধুর পুরো পরিবার তার সঙ্গে খাবার খেয়েছেন।
তথ্যসূত্র : ‘বঙ্গবন্ধু কীভাবে আমাদের স্বাধীনতা এনেছিলেন’, মুনতাসীর মামুন; মাওলা ব্রাদার্স।