নারী দিবসের পক্ষে-বিপক্ষে...
সজীব সরকার
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০২:১৯ এএম, ৮ মার্চ ২০২১ সোমবার
প্রতি বছর ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এ দিবসকে ঘিরে এর পক্ষে-বিপক্ষে অনেকে অবস্থান নেন। কারো মতে, আলাদা করে নারী দিবস পালন মানেই নারীদের আলাদা করে ফেলা। এ দিবসের পক্ষে যারা, তারা মনে করেন নারীর অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে নারী দিবস পালনের উপযোগিতা রয়েছে।
এ দুই পক্ষের একে অন্যকে ভুল মনে করে। তবে নিরপেক্ষভাবে দেখলে আসলে কাউকেই নির্বিচারে ভুল বলা চলে না। একদিকে আমরা যখন নারীদের ‘মানুষ’ হিসেবে দেখতে শিখতে বলছি, তখন আলাদা করে নারীর জন্যে দিবস পালন একরকমের বৈপরীত্য মনে হয় বটে। তবে কথা হলো, সব সমাজের সব মানুষ এখনো নারীদের পরিপূর্ণ ও স্বতন্ত্র মানুষ হিসেবে ভাবতে শেখেনি। এর ফলে সমাজে নারীর সম্পর্কে নেতিবাচক ও ভুল ধ্যান-ধারণা, নারীকে ক্ষুদ্র ও পুরুষের তুলনায় নিম্নশ্রেণির মানুষ মনে করা, নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য এমনকি নিপীড়নকে যৌক্তিক ও স্বাভাবিক মনে করা, নারীকে তাচ্ছিল্যের প্রবণতা এবং নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতাসহ নানা ধরনের বৈষম্য-অন্যায়-অনাচার এখনো প্রবলভাবে রয়ে গেছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে নারী দিবস পালনের গুরুত্ব রয়েছে।
অনেকে মনে করেন, নারীকে বিভিন্ন সমাজে নানা ধরনের বাড়তি সুবিধা দেওয়া হয় যা আবার পুরুষের প্রতি বৈষম্য। এক্ষেত্রে তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি বা চাকরিতে নারী কোটা, নারী শিক্ষার্থীদের জন্যে আলাদা বৃত্তির ব্যবস্থা ও গণপরিবহনে নারীদের জন্যে আলাদা আসনের মতো বিষয়গুলোর উদাহরণ দিয়ে থাকেন। এসব সুবিধার যারা বিরোধিতা করেন, তাদের যুক্তি হলো—নারী-পুরুষকে যখন সমান অধিকার দিতে বলা হচ্ছে, তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি বা চাকরিতে নারীদের বাড়তি সুবিধা দেওয়া বা আলাদা বৃত্তি দেওয়ার অর্থ হলো পুরুষের সঙ্গে অন্যায় করা। তাদের মতে, পুরুষরা যখন বাসে দাঁড়িয়ে যাবে, তখন নারীদেরও দাঁড়িয়ে যেতে হবে; নারীদের জন্যে আলাদা আসন বরাদ্দ রাখা মানে পুরুষের সঙ্গে বৈষম্য করা।
এসব প্রসঙ্গে তর্কের আগে আসলে সমাজ-বাস্তবতার দিকে তাকানো জরুরি। শত-সহস্র বছর ধরে নারীরা সমাজের সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। শিক্ষা-অর্থনীতি-রাজনীতিসহ সব ক্ষেত্রে তারা পুরুষদের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। দৌঁড় প্রতিযোগিতায় যখন একজন অনেক আগে থেকে দৌঁড় শুরু করে অনেকটা দূরত্ব এগিয়ে থাকে, তখন অন্যজনকে দৌঁড় শুরু করতে বললে তার পক্ষে কখনোই প্রথমজনকে ধরা বা তার সঙ্গে পেরে ওঠা সম্ভব নয়। পুরুষরা অনেক বছর আগে থেকেই সমাজের সব সুযোগ পেয়ে আসছে; এই অবস্থায় নারীরা পুরুষদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এখন নারীদের যদি শিক্ষা ও কর্মসংস্থানসহ অন্যান্য বিষয়ে পুরুষদের সাথে প্রতিযোগিতায় নামানো হয়, তাহলে একে সমতা বলা চলে না। দৌঁড়ে যে আগে থেকে এগিয়ে রয়েছে, তার সঙ্গে তাল মেলানোর সুযোগ দিতে হলে অনেক পরে দৌঁড় শুরু করতে দেওয়া প্রতিযোগীকে কিছুটা এগিয়ে দিতেই হবে; না হলে সেখানে পরের প্রতিযোগীর সঙ্গে বৈষম্য থেকেই যাবে।
পুরুষশাসিত সমাজে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানসহ সব ক্ষেত্রে সহস্র বছর ধরে পুরুষেরা একচ্ছত্র আধিপত্য করে আসছে। এমন একটা সমাজব্যবস্থায় নারীদের আলাদা বৃত্তি বা কোটার মতো ন্যূনতম বাড়তি সুবিধা না দিলে পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যের কারণে নারীদের পক্ষে কোনোভাবেই নিজেদের অবস্থান তৈরি করে নেওয়া সম্ভব নয়। আপাতদৃষ্টিতে এটি পুরুষদের প্রতি বৈষম্য মনে হতে পারে, তবে অ্যাকাডেমিক পরিভাষায় এটি ‘ইতিবাচক বৈষম্য’ (পজেটিভ ডিসক্রিমিনেশন)। পুরুষের তুলনায় পিছিয়ে থাকা নারীকে পুরুষের কাছাকাছি অবস্থানে নিয়ে আসতে এই ‘বৈষম্য’ দরকার এবং এতে দোষের কিছু নেই। একটা সময়ে নারী-পুরুষ যখন সমান অবস্থানে চলে আসবে, তখন আর নারীকে ওই বাড়তি সুবিধা দেওয়া হবে না বা দেওয়ার আর প্রয়োজন থাকবে না।
একটু যদি ভেবে দেখা যায়, আমাদের সমাজে নারীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ খুব কম। সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিকসহ নানা কারণে অভিভাবকেরা পয়সা খরচ করে ছেলে সন্তানদের পড়ানোকে ‘লাভজনক’ এবং মেয়েদের পড়ানোকে ‘লস প্রজেক্ট’ মনে করেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতায়াতের পথে নারীদের নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। গণপরিবহনে নারীদের যাতায়াত স্বস্তিদায়ক তো দূরের কথা নিরাপদ পর্যন্ত নয়। অনেক বাধা পেরিয়ে পড়াশোনা শেষ করতে পারলেও চাকরি পাওয়া ও চাকরির পর তা চালিয়ে যাওয়া নারীর পক্ষে দুঃসাধ্য ব্যাপার।
এসব বিষয় বিবেচনায় নারীকে কিছুটা হলেও ‘বাড়তি সুবিধা’ দিয়ে এগিয়ে দিতেই হবে; পিছিয়ে থাকা নারীকে এগিয়ে থাকা পুরুষের সঙ্গে দৌঁড় প্রতিযোগিতায় কেবল নামতে দিলেই একে সমতা বলা যাবে না। দুজনকে আগে একটি জায়গায় এনে মেলাতে হবে এবং এর পরই কেবল দুজনকে প্রতিযোগিতা করতে বলা যৌক্তিক হবে।
নারীর প্রতি বৈষম্য দূর হয়নি। নারীর প্রতি বিদ্বেষ বা তাচ্ছিল্যের প্রবণতা কমেনি। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ হয়নি। নারীরা এখনো পুরুষের মতো সব ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিষ্ঠার বাধাহীন সুযোগ পায়নি। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের সব ক্ষেত্রে নারীরা এখনো পদে পদে বাধার সম্মুখীন। নারী দিবসকে উপলক্ষ করে এসব বিষয়ের প্রতি সমাজের সব মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়; এ বিবেচনায় নারী দিবস পালনে আদতে দোষের কিছু নেই।
নারী দিবস পালনের অর্থ হলো নারীর অধিকার এখনো প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। কিন্তু এটিই নির্মম বাস্তবতা; নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত এই দিবস পালনের প্রয়োজন রয়েছে।
সমাজে কেবল নারীরাই নন, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষসহ প্রান্তিক শ্রেণির অনেক মানুষই এখনো মানুষ হিসেবে তাদের প্রাপ্য অধিকার ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছেন। তাদের সবারই অধিকার প্রতিষ্ঠা করা দরকার। নারী, পুরুষ ও তৃতীয় লিঙ্গসহ সমাজের সব জনগোষ্ঠীর সব সদস্য অচিরেই পূর্ণাঙ্গ ও স্বতন্ত্র মানুষ হিসেবে স্বীকৃত হবে, নিজেদের অধিকার পাবে এবং সবাই প্রথমত ও প্রধানত ‘মানুষ’ হিসেবে বিবেচিত হবে—এমনটিই প্রত্যাশা।
অমন সমাজে নারী দিবস পালনের প্রয়োজন হবে না; সেই সমাজে উদযাপিত হবে মানবতার উৎসব, গাওয়া হবে জীবনের জয়গান!
লেখক : সজীব সরকার : সহকারী অধ্যাপক ও চেয়ারপারসন, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি। প্রতিষ্ঠাতা : মিডিয়াস্কুল ডট এক্সওয়াইজেড।