হাঁস পালনে সুখ এসেছে জাহানারার জীবনে
উদ্যোক্তা ডেস্ক
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০২:০৮ পিএম, ১৬ মার্চ ২০২১ মঙ্গলবার
প্রতীকী ছবি
‘হাঁস বদলে দিয়েছে আমাদের জীবন। হাঁস পালন করেই আজ আমরা সুখি। আমাদের পরিবারে আসছে সচ্ছলতা।’ বলছিলেন হাঁসের সফল খামারি জাহানারা বেগম।
পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার খানমরিচ ইউনিয়নের করতকান্দি গ্রামের জাহানারা বেগম ও তার স্বামী আতাউর রহমান হাঁসের খামার করেছেন। ১৯৯৮ সালে তারা হাঁস পালন শুরু করেন। খামারে এখন ৭শ’র বেশি হাঁস রয়েছে। বছরে আয় হয় দুই থেকে তিন লাখ টাকা। দুই ছেলের পড়ালেখার খরচ ও পাঁচজনের সংসার চালিয়েও বেশ সঞ্চয় করতে পারছেন তারা। অথচ এই সাফল্যের গল্পের শুরুটা এক হাজার টাকা দিয়ে।
২২ বছর আগের কথা। ৫শ’ টাকা দিয়ে ৫০ টি হাঁসের বাচ্চা কেনেন জাহানার বেগম। ৫শ’ টাকায় তৈরি করেন হাঁসের ঘর। লালন-পালনে খরচ হয় সামান্যই। সেই হাঁস ছয় মাস পর বাজারে বিক্রি করে পান প্রায় ৬ হাজার টাকা। তার আগে হাঁসগুলো যে ডিম দেয়, তা থেকে বেশ ভালো টাকা আয় হয় তাদের। সেই শুরু। এরপর শুধু সামনে এগিয়ে চলা। ধীরে ধীরে বেড়েছে খামারের পরিধি। এখন তারা হাঁস পালনের পাশাপাশি গরু পালনও শুরু করেছেন।
জাহানারা বেগম হাঁস পালনের শুরুর ঘটনা তুলে ধরে বলেন, ‘আজ আমাগারে বাড়ি হাঁসের খামারে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর বৈশাখ মাসের শেষের দিকে তিন-চার দিন বয়সের ৮শ’ থেকে ১ হাজার হাঁসের বাচ্চা কিনে নিয়ে আসি। মাঘ মাসে পরিণত বয়স হলে বিক্রি শুরু করি। প্রতি জোড়া পাইকারি ৫শ’থেকে ৬শ’ টাকায় বিক্রি হয়।’
তিনি জানান, ছয় মাসের মধ্যে হাঁস ডিম দেয়া শুরু করে। খামার থেকে প্রতিদিন ৩শ’ থেকে ৪শ ডিম পাওয়া যায়। এর বাজারমূল্য তিন থেকে সাড়ে তিন চার হাজার টাকা।
খামারি দম্পতির পাঁচ সদস্যের সংসার। বড় ছেলে জাহাঙ্গীর হোসেন বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে মাস্টার্স পাশ করে একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করেছে। ছোট ছেলে জাহিদুল ইসলাম স্থানীয় বেসরকারি কলেজে ডিগ্রী পড়ছে।
আতাউর রহমান জানান, এই হাঁসের খামার শুরুর আগে তার কোন ফসলী জমি ছিল না। ১৫ শতক জায়গা নিয়ে বসত বাড়ি ও খামার। আগে অন্যের জায়গায় বর্গা চাষ করে খুব কষ্টে সংসার চালাতে হতো। তখন বুদ্ধি করে হাঁসের খামার করি। সেই খামার দিয়ে এখন ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা ও সংসারের খরচ সবই চালিয়ে নিচ্ছি। এই হাঁস পালন করে ৫ বিঘা জমি কিনেছি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জাহানারা বেগম বাড়ির পেছনে খাবারের পাতিল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। একটু পরেই ছোট ছেলে জাহিদুলকে সঙ্গে নিয়ে হাঁসগুলোকে খাবার দিতে শুরু করেন। মুহূর্তেই শুরু হয় খাবার খেতে শত শত হাঁসের প্রতিযোগিতা।
হাঁসগুলোকে খাবার দেয়া শেষে জাহানারা বেগম জানালেন, ভোরবেলা খামারের দরজা খুললে হাঁসের ডানা ঝাঁপটানোর শব্দে কানে আঙুল দিয়ে থাকতে হয়। পুরো বাড়িতে হইচই পড়ে যায়। এ দৃশ্য দেখাও ভাগ্যের ব্যাপার।
তিনি জানান, হাঁস পালন করে আমি এলাকায় অনেক পরিচিতি অর্জন করেছি। আমার পরে অনেকে যখন ছোট করে হাঁসের খামার শুরু করেছে, আমি তাদের নানা পরামর্শ দিয়েছি। এখনও অনেকে আসে কোন সমস্যা হলেই পরামর্শ নিতে। তাই সকলের অনুরোধে আমি এবছর সংরক্ষিত মহিলা মেম্বার পদে দাঁড়াবো। আপনারা আমার জন্য দোয়া করবেন।
আতাউর রহমান বলেন, ১ হাজার হাঁসের বাচ্চা কিনতে খরচ হয় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। এরপর প্রতিদিন তার খামারে তিন মণ ধান, গম বা ভুট্টা লাগে। এর বাইরে ওষুধ খরচ আছে। ওষুধ ও খাবার বাবদ প্রতিদিন ২ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। পরিণত বয়সে এক জোড়া হাঁস পাইকারি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হয়। সব খরচ বাদ দিয়েও বছরে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা থাকে। তবে বিলে বা নদীর তীরে হাঁসের খামার গড়ে তুলতে তেমন খরচের প্রয়োজন পড়ে না। অল্প খরচে লাভও হয় দ্বিগুন। বর্তমানে হাঁসের খাবারের দাম বৃদ্ধি পাওয়াতে লাভ একটু কম হচ্ছে।
একই গ্রামের আবুল কাশেম মাস্টার জানান, শুরু থেকেই আমরা দেখছি এই পরিবারটি অনেক কষ্ট করে সংসার চালাতো। বর্তমানে হাঁস পালন করে পরিবার পরিজন নিয়ে অনেক সুখে আছে তারা।
খানমরিচ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদুর রহমান বলেন, জাহানারার হাঁসের খামার সত্যিই অনুকরণীয়। অতীতের অভাবের সংসারে হাঁস পালন করে নিজে স্বাবলম্বী হয়েছে এবং পরিবার-পরিজন নিয়ে সুখেই দিন যাপন করছে। তার এই সাফল্যে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে আরও হাঁস খামার তৈরি হবে, দুর হবে এলাকার বেকারত্ব এ প্রত্যাশাই করছি।
ভাঙ্গুড়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. তোফাজ্জল হোসেন বলেন, করতকান্দি গ্রামের খামারি জাহানারা বেগম ও আতাউর রহমান প্রায়ই তাঁর কার্যালয়ে গিয়ে হাঁস লালন-পালন সংক্রান্ত পরামর্শ নিয়ে থাকেন। অনেক সময়ে ফোনেও পারমর্শ গ্রহণ করেন। অনেক দিন থেকে হাস পালন করার কারনে তারা অনেক বেশি অভিজ্ঞ।
তিনি বলেন, হাঁসের খামার করে এই পরিবারটি আজ স্বাবলম্বী হয়েছেন। খামারি হিসাবে সফলতার একটি দৃষ্টান্ত এই পরিবার। তাঁর মতো অন্যদেরও এ ধরনের খামার করতে এগিয়ে আসা উচিত। প্রয়োজনে তাঁদের ঋণ ও অন্যান্য সহযোগিতা দিতে সরকারের সাতটি দপ্তর প্রস্তুত।