সাধারণ গৃহবধূ রেহেনার যুদ্ধজয়ের গল্প
নাসিমা মীর
উইমেননিউজ২৪.কম
প্রকাশিত : ০১:২০ পিএম, ১৮ অক্টোবর ২০১৭ বুধবার | আপডেট: ১২:১৯ পিএম, ১ নভেম্বর ২০১৭ বুধবার
স্কুলের ফাঁকে ছাত্রীদের সঙ্গে বাল্য বিয়ের কুফল নিয়ে আলোচনা করছেন রেহানা খাতুন। ছবিটি খরনা নাদুরপুকুর ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তোলা।
গ্রামীণ একজন সাধারণ গৃহবধূ থেকে জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি হয়ে ওঠা রেহেনা খাতুনের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পটা বড় কঠিন। অনেক চড়াই-উত্সরাই পেড়িয়ে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন সমাজের অধিকার বঞ্চিত নারীদের জন্য। নিজেই বাল্যবিয়ের শিকার হওয়া রেহেনার উদ্যোগে অনেক নারীর ভাঙা সংসারও জোড়া লেগেছে।
কমলাচাপড়, বাঁশগাড়ি, বীরগ্রাম, বকভ্যালিসহ আশে পাশের ১৫ গ্রামে বাল্য বিয়ে বন্ধ করেছেন রেহেনা খাতুন। বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার খরনা ইউনিয়নের সংরক্ষিত আসনের সদস্য এই নারী শুধু বাল্যবিয়েই নয় হিল্লা বিয়ে, নারী নির্যাতন, নারী শিক্ষার ভূমিকাসহ নানা রকম সামাজিক সচেতনতামূলক কাজ করে যাচ্ছেন।
বগুড়া শহর থেকে দক্ষিণে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে কমলাচাপড় গ্রামের গৃহবধূ রেহেনা খাতুনের বর্তমানে একজন সফল ও জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি। তিনি একে একে শিকার হয়েছেন বাল্যবিয়ে, স্বামীর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। এমন কি স্বামীর কাছে থেকে পাওয়া দুই তালাকেরও শিকার হয়েছিলেন তিনি। আপোষ-মিমাংসায় স্বামীর কাছে ফিরলেও পরবর্তীতের হিল্লা বিয়ের মত ঘটনা তার জীবনে ঘটতে যাচ্ছিল। কিন্তু অত্যন্ত দৃঢ় মনোবল এবং প্রতিবাদী কণ্ঠের কারণে ফতোয়াবাজরা তাকে হিল্লা বিয়ে দেয়ার সাহস করতে পারেননি।
নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া এসব প্রতিকূলতার শেকল ভেঙ্গে ঘুরে দাঁড়ানো রেহেনা গ্রামীণ সামাজিক পরিবেশের নানা অনাচার ও কুসংস্কারের বেড়াজাল ভাঙ্গার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের তার এই মানসিকতাকে শুরুর দিকে গ্রামের অধিকাংশ মানুষই পছন্দ করতেন না। কিন্তু পারিবারিক কিংবা সামাজিক কোনো সমস্যা-সংকটে যখন অন্যরা মুখ ফিরিয়ে নিতেন তখন ওইসব সংকটে পরা মানুষদের পাশে রেহেনা খাতুন দাঁড়াতেন। এভাবেই ধীরে ধীরে তিনি গ্রামের সব মানুষের কাছে ভরসার স্থান হয়ে ওঠেন। আর সে কারণেই পরবর্তীতে গ্রামবাসীই তাকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সদস্য পদের প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেন। জনগণের সমর্থন ছিল বলেই প্রতিদ্বন্দ্বী চারজনকে পেছনে রেখে সহজেই বিজয়ী হন রেহেনা খাতুন।
খরনা ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত ওয়ার্ডের সদস্য রেহেনা খাতুন তার নিজের সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে জানান, মাত্র দেড়-দুই বছর বয়সে তার মা মারা যান। এরপর বাবা আরেকটি বিয়ে করেন। কিন্ত সৎ মায়ের অনাদার ও অবহেলার কারণে নানী তাকে নিয়ে যান। নানীর কাছেই বড় হতে থাকেন তিনি। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় ১৯৯৫ সালের জুন মাসে মাত্র তের বছর বয়সে পাশের কমলাচাপর গ্রামের পান ব্যবসায়ী মোকারেম হোসেনের সাথে বিয়ে দেওয়া হয়। সংসারের নানা হিসেব-নিকেষ তো দুরের কথা, সংসার কি সেটাই তিনি বুঝতেন না। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন এসব বুঝতে শেখেন ততদিনে স্বামীর সঙ্গেও শুরু হয়ে যায় নানা মানসিক দ্বন্দ্ব। আর তখনই শুরু হয় স্বামীর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। তাদের এই ঝগড়া-কলহ নিয়ে গ্রামে একাধিকবার গ্রাম্য সালিশও বসে। আত্নীয়-স্বজনের কথায় প্রভাবিত হয়ে বিয়ের দশ বছরের মাথায় ২০০৪ সালে গোপনে স্বামী তাকে তালাক দেন। ততদিনে নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গেলে রেহেনা খাতুন পাশের গ্রামে তার মামার বাড়িতে আশ্রয় নেন এবং আদালতে স্বামীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের মামলা করেন। প্রথম দিকে মামারা মামলার খরচ চালালেও আর্থিক অনটনের কারণে এক সময় তারা টাকা-পয়সা দেওয়া বন্ধ করেন। তখন বাধ্য হয়েই রেহেনা খাতুনকে কাজের সন্ধানে নামতে হয়। মানুষের বাড়ি-ঘর লেপা-পোচা, কাপড় ধোয়া কিংবা কখনও সখনও বিয়ে বাড়িতে বাসর ঘর সাজিয়ে দেওয়ার মত কাজও করতে হয়েছে তাকে।
রেহেনা খাতুন বলেন, ‘মামলার প্রতিটি তারিখে আদালতে যাওয়া-আসা এবং আইনজীবীর ফিসহ অন্তত ১ হাজার টাকা খরচ হতো। কিন্তু সেটা আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। তাই আমাকে কাজ খুঁজে নিতে হয়েছে।’ এভাবে প্রায় দুই বছর কেটে যাওয়ার পর ২০০৭ সালে মামার বাড়ির ওই গ্রামের এক বিয়ের বাড়ি সাজাতে গিয়েই পরিচয় হয় বেসরকারি সংস্থা প্রোগ্রাম ফর ইকো সোস্যাল ডেভলপমেন্টের (পেসড্) নির্বাহী পরিচালক মাহফজু আরা মিভার সঙ্গে।
রেহেনা খাতুন জানান, তার কাজ দেখে মাহফুজ আরা মিভা তাকে কাছে ডেকে নেন এবং কোথায় কাজ শিখেছে সেটা জানতে চান। তখনই তাকে সবকিছু খুলে বলেন। এরপর তিনি সালিশের মাধ্যমে স্বামীর সঙ্গে তার বিরোধ নিষ্পত্তির অশ্বাস দেন। পরবর্তীতে তিনি তার সংস্থার মাধ্যমে তার স্বামীকে নোটিশ করেন।
এরপর শুনানিতে উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে পেসড্’র নির্বাহী পরিচালক মাহাফুজ আরা বেগম মিভা বুঝতে পারেন অন্যের কথায় প্রভাবিত হয়ে তার স্বামী তাকে নির্যাতন করেছেন এবং তালাকও দিয়েছেন। কয়েকবার দু’জনকে কাউন্সিলিং করার পর মোকারেম রেহেনাকে আবার ফিরে নিতে চান। এরপর ওই অফিসেই কাজী ডেকে দ্বিতীয়বার বিয়ে পড়ানো হয়। কিন্তু স্বামীর সংসারে ফিরে আসার পর গ্রামের অনেকেই এটা নিয়ে কানা-ঘুষা করেন। ফতোয়াবাজরাও হিল্লা বিয়ে দিতে চান। কিন্তু তারা দু’জন এ ধরনের ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। তাদের মানসিক দৃঢ়তায় শেষ পর্যন্ত ফতোয়াবাজরা পিছু হটতে বাধ্য হন। তখন থেকেই রেহেনা খাতুন বাল্য আর হিল্লা বিয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে শুরু হোন।
রেহেনা খাতুন বলেন, ‘এরপর থেকেই গ্রামের যেখানে বাল্য বিয়ের কথা শুনি ছুটে যাই। যদি শুনি মেয়ে দেখতে আসছে, কিন্তু মেয়ের বয়স ১৮ হয়নি। সঙ্গে সঙ্গে মেয়ের বাবা-মা’র কাছে গিয়ে তাদের বোঝাই’।
এ পর্যন্ত কতগুলো বাল্য ঠেকিয়েছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গুনে দেখিনি, তবে অনেক হবে। গ্রামে এখন বাল্য বিয়ে নেই বললেই চলে। তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও গিয়ে ছেলে-মেয়েদের বিশেষ করে মেয়েদের বাল্য বিয়ের কুফল সম্পর্কে বলি। এখন মেয়েরাই অনেক সচেতন হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এখন কোনো মেয়ের বাড়ি থেকে কম বয়সে বিয়ের কথা হলে ওই মেয়ে নিজেই এসে খবর দেয়’।
শাজাহানপুর উপজেলার খরনা নাদুরপুকুর ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক জাহিদুর রহমান বলেন, এই গ্রামগুলোতে আগে বাল্য বিয়ের প্রবণতা এতটাই ছিল যে, মেয়েরা প্রাইমারী পার হওয়ার পর পরই বিয়ে দেওয়া হত। অষ্টম-নবম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হতে হতে অধিকাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যেত। কিন্তু এখন আর বাল্য বিয়ের কথা তেমন শোনা যায় না। এর পেছনে রেহেনা আপার ভূমিকা অনেক।
ওই স্কুলের সহকারি শিক্ষিকা আকতার বানু জানান, ‘রেহেনা আপা এ পর্যন্ত দুইবার এই স্কুলে এসেছেন। তিনি বাল্য বিয়ে নিয়ে ছেলে-মেয়েদের কথা বলেছেন। শুধু মেয়েদেরই নয় ছেলে শিক্ষার্থীদেরও তিনি বাল্য বিয়ের বিষয়ে সতর্ক করেছেন। তার কথায় ছাত্র-ছাত্রীরা উদ্বুদ্ধ হয়েছে।’
খরনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাজেদুর রহমান শাহীন বলেন, রেহেনা খাতুনের মধ্যে অনেক কর্মস্পৃহা আছে। গ্রামের কারো বাল্য বিয়ের কথা শুনলেই উনি সেখানে চলে যান। পরিস্থিতি জটিল হলে উনি আমাদের জানান।
বেসরকারি সংস্থা পেসড্-এর নির্বাহী পরিচালক মাহফুজ আরা মিভা বলেন, ‘জন্মের পর থেকেই নানা প্রতিকুল অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। সে ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছে কিন্তু কোন অবলম্বন পাচ্ছিল না। নিজের উপর আস্থা ও বিশ্বাস দেখে আমরা তাকে সাহস যুগিয়েছি। এখন সে শুধু নিজ গ্রামেই নয়, আশে-পাশের ১৫টি গ্রামের মানুষের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছে।