বাদুর রহস্য
নাসরীন মুস্তাফা
উইমেননিউজ২৪.কম
প্রকাশিত : ০৫:৪১ পিএম, ১৮ অক্টোবর ২০১৭ বুধবার | আপডেট: ০৩:২৮ পিএম, ২২ অক্টোবর ২০১৭ রবিবার
নাসরীন মুস্তাফা
নেপালে এক গুর্খা বুড়ো বলেছিল, বাদুড় থেকে সাবধান। খবরদার, কোন বাদুড়ের ওড়াউড়ির সামনে পড়ে যেও না।
কেন?
বুড়ো গম্ভীর মুখে বলেছিল, বাদুড় যদি সোজা তোমার নাক বরাবর উড়ে আসে, তবে বুঝবে লক্ষন খারাপ। কেউ কোন একটা অভিশাপ তোমাকে দিয়েছে আর বাদুড়টা সেই অভিশাপ তোমার উপর ছেড়ে দেবে। কেননা, অভিশাপটা বাদুড়ই বয়ে নিয়ে আসছে।
কে আর অভিশাপ দেবে?
বুড়ো আমার দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি হেনে বলেছিল, শুধু কি অভিশাপ? বাদুড়ের উড়ে আসা মানে হচ্ছে সংকেত। কেউ তোমার সাথে বেঈমানি করতে চাইছে বা তোমাকে জাদুটোনা করবে, বাদুড় সেই সংকেত জানিয়ে দেয়।
কোঁকড়া চুলের মেয়েদের চুল কে কোঁকড়া করে দেয়?
গুর্খা বুড়ো আমার কোঁকড়া চুলের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিল, তোমার চুলের ভেতর বাদুড় ঢুকেছিল। বাদুড়টাই তোমার চুলকে পেঁচিয়ে জটা করে দিয়েছে।
আমি জানতাম, বাদুড় প্রকৃতির বন্ধু। এর যে এরকম গুণাবলী আছে, তা জানা ছিল না। বাদুড় একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী যে কিনা উড়তে পারে, রাতের সাথি, অন্ধকার ভালোবাসে, শুধু এই ক’টা গুণের জন্যই বাদুড়ের ঘাড়ে মানুষের ভয় আর দুর্ভাগ্য সম্পর্কিত বিশ্বাস চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এদের কিছু কিছু প্রজাতি রক্ত খায় বটে। ভ্যাম্পায়ার নাম এদের, মেক্সিকো, মধ্য আমেরিকা আর দক্ষিণ আমেরিকাতে দেখা মেলে। এরাই একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী, যার একমাত্র খাদ্য হচ্ছে রক্ত। এই ‘দুষ্টু’ বাদুড়টা দিনে ঘুমায়, রাতে জেগে থাকে। গুহার ছাদ আঁকড়ে ধরে ঝুলতে থাকে। এরা সাধারণত একশ’ জন এক সাথে হয়ে দলবদ্ধ ভাবে বসবাস কওে, যদিও এই সংখ্যা কখনো কখনো এক হাজার কি এর চেয়েও বেশি হতে পারে। এক বছরে এরকম একশ’ বাদুড়ের একটি ‘সমাজ’ পঁচিশটি গরুর রক্ত চুষে শেষ করতে সক্ষম!
রাতের সবচেয়ে অন্ধকার সময়ে নেমে আসে এই বাদুড়টি। মাটি থেকে আঘাত হানে শিকারের উপর। নাকে এরা শিকারের উষ্ণতার গন্ধ পায়, তা থেকে বুঝে নেয় তাজা গরম রক্ত কোথায় কামড়ালে পাবে। এরপর? ঘুমিয়ে থাকা গৃহপালিত পশু আর ঘোড়ার ঘাড়ে তী² কামড় বসিয়ে প্রায় ত্রিশ মিনিট ধরে রক্ত চুষে খায়। মুখ থেকে গড়িয়ে পড়ে রক্তের ধারা। এর মুখের লালা রক্তকে জমাট বাঁধতে দেয় না।
শিশু ভ্যাম্পায়ার কিন্তু রক্ত নয়, তিন মাস বয়স পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধ পান করে। মা-কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে দুধ পানের সময়। কখনো কখনো এভাবে জড়িয়ে ধরেই মায়ের সাথে উড়ে চলে। মানুষের রক্ত কি খায় না? খায় কোথাও কোথাও। মশার রক্তপানের মতই অবস্থা হয় মানুষের, রক্ত যা হারায় তাতে মানুষ মরে না। তবে কামড়ের জায়গায় সংক্রমন হতে পারে। এই সংক্রমন থেকে বড় কোন অসুখ বাঁধিয়ে ফেলাও বিচিত্র নয়।
আর তার জন্যই ইউরোপসহ পাশ্চাত্যের লোককথায় বাদুড়কে রক্তচোষা ড্রাকুলা বানিয়ে অশুভ আত্মার সাথি করা হয়েছে। লোককথা তো কেবল লোককথা হয়েই থাকেনি, গল্প-উপন্যাস লেখা থেকে শুরু করে ভয়াল চলচ্চিত্র পর্যন্ত নির্মান করা হয়েছে বাদুড়ের ভয়ংকর রূপ সাজিয়ে। কোন বাড়িতে বাদুড় থাকলেই হ’ল, বাড়িটাকে ভূতের বাড়ি নাম দেওয়া হবে। অথবা কথাটি ঘুরিয়ে বলি, ভূতের বাড়ি দেখাতে গেলে সেখানে বাদুড়ের উপস্থিতি অপরিহার্য করে ফেলা হয়েছে।
প্রাচীন এক জার্মান বিশ্বাস হচ্ছে, যদি কারোর বাড়িতে বাদুড় ওড়ে, তবে বুঝতে হবে শয়তান সেই লোকের পিছু নিয়েছে। স্লোভেনিয়ান, জার্মান আর ইহুদিরা পরামর্শ দেয়, বাদুড় দেখলে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। কিছুই করছে না, বেচারা হয়তো উড়তে ইচ্ছে হচ্ছিল বলে উড়ছিল। আর তাতেই রায় দেওয়া হ’ল, আর কিন্তু রক্ষে নেই। পৃথিবীর বেশির ভাগ সংস্কৃতিতেই বেচারার এরকম বেহাল দশা।
দক্ষিণ আমেরিকার মায়া ও আজটেক সভ্যতায় বাদুড়কে মৃত্যুর অগ্রদূত মনে করা হ’ত। ইউরোপের সংস্কৃতিতে বাদুড় খুবই রহস্যময় প্রাণী। এর আবাস নাকি পরলোক আর ইহলোকের মাঝামাঝি কোন এক ধূসর এলাকায়। ও পৃথিবীতে আসে কেবল মাত্র মৃত্যুর বার্তা নিয়ে। ও অশুভ।
সত্যিই মায়া হয় বাদুড়ের জন্য!