রিভেঞ্জ পর্ন নারীদের জীবন তছনছ করছে
বিবিসি বাংলা অনলাইন
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০১:১৫ পিএম, ৩০ এপ্রিল ২০২১ শুক্রবার
প্রতীকী ছবি
চব্বিশ-বছর বয়সী সিতির সাথে এক লোকের পাঁচ বছরের সম্পর্ক। তার পরিবার একথা জানতো না। পাঁচ বছর পর তাকে নিয়েই বের হয় প্রতিশোধমূলক পর্নোগ্রাফি। ব্যক্তিগত গোপনীয়তার স্বার্থে এখানে সিতির নাম বদলে দেয়া হয়েছে।
প্রেমিকের সাথে সম্পর্ক যখন খারাপ হয়ে পড়লে সিতি গত বছর সম্পর্কটি ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করেন। আর ঠিক তখনই তার সাবেক প্রেমিক তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবিগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে।
'রিভেঞ্জ পর্ন' বা প্রতিশোধমূলক পর্ন মানে হলো সেক্স করার ভিডিও বা ছবি অনুমতি ছাড়াই অনলাইনে প্রকাশ করা।
অনেক দেশেই এটা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়, এবং যাদের বিরুদ্ধে এসব করা হয়, কর্তৃপক্ষ তাদের জন্য সুবিচারের ব্যবস্থা করে।
কিন্তু ইন্দোনেশিয়ায় সিতির মতো যারা প্রতিশোধমূলক পর্নের শিকার হয়েছেন, তাদের অনেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে যেতে ভয় পান। কারণ সে দেশে পর্নোগ্রাফি সংক্রান্ত যে আইনটি রয়েছে, তাতে কে অন্যায় করেছে এবং কে এর শিকার, তার মধ্যে কোন তফাৎ রাখা হয়নি।
দু'হাজার উনিশ সালে এক নারীর যৌনমিলনের একটি ব্যক্তিগত ভিডিও তার অনুমতি ছাড়াই প্রকাশ করা হয়। এবং এ নিয়ে যে মামলা হয়, তাতে দেখা যায় ফরিয়াদীকেই তিন বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। পরে অবশ্য উচ্চতর আদালতে আপিল করার পর রায়টি বাতিল হয়ে যায়।
ইন্দোনেশিয়ায় প্রতিশোধমূলক পর্নের যারা শিকার তারা মনে করেন, সুবিচারের জন্য কোথায়ও যাওয়ার জায়গা তাদের নেই।
"মানসিক আঘাতে জর্জরিত হয়ে একেক সময় মনে হয় আমি আর এ থেকে মুক্তি পাব না। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি আর বাঁচতে চাই না। আমি কাঁদতে চাই, কিন্তু চোখে আর পানি আসে না," বলছেন সিতি।
মুসলমান-প্রধান দেশ ইন্দোনেশিয়ায় যৌনতা এবং বিয়ের আগের শারীরিক সম্পর্ক নিয়ে ধর্মীয় বিধিনিষেধ রয়েছে। সামাজিকভাবেও একে কলঙ্ক হিসেবে দেখা হয়।
ইন্দোনেশিয়ায় নারীদের আইনগত সাহায্য দিয়ে থাকেন এমন একজন আইনজীবী হুসনা আমিন বলছেন, পুরো দেশ জুড়ে সিতির মতো পরিস্থিতির শিকার বহু নারী।
ইন্দোনেশিয়ার নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বিষয়ক জাতীয় কমিশনের এক হিসেব অনুযায়ী, সে দেশে ২০২০ সালে অনলাইনে ১,৪২৫টি জেন্ডার সহিংসতার অভিযোগ রেকর্ড করা হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি হবে, কারণ অনেক নারীই তাদের অভিযোগ নিয়ে পুলিশের দ্বারস্থ হতে চান না।
"নারীরা ভয় পান কারণ এসব খবর প্রকাশিত হলে পর্নোগ্রাফি আইনটি তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হতে পারে," বলছেন হুসনা আমিন।
পর্নোগ্রাফি আইনে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি "স্বেচ্ছায় পর্নোগ্রাফি সংক্রান্ত কোন কন্টেন্টে নিজে মডেল হতে পারবেন না, অথবা এই কাজে কোন অনুমতিও দিতে পারবেন না।"
এতে আরও বলা হয়েছে, "কোন ব্যক্তি পর্নোগ্রাফি তৈরি, প্রযোজনা, বিতরণ, নকল, সম্প্রচার, আমদানি, রপ্তানি, বাণিজ্য এবং ভাড়া দিতে পারবেন না।"
পাশাপাশি আইটিই নামে পরিচিত আরেকটি আইনে বলা হয়েছে, "শালীনতা ভঙ্গ হয় এমন কোন কন্টেন্ট কিংবা ইলেকট্রনিক দলিল বিতরণ ও সম্প্রচার নিষিদ্ধ।"
এই আইনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, কোন ফাঁস হওয়া ভিডিওতে যে কাউকে দেখা গেলে তাকে শাস্তি দেয়া যাবে।
নারী অধিকার কর্মীরা বলছেন, এই আইনকে ব্যবহার করে নির্যাতনকারী ও প্রতিশোধকামী পুরুষরা পার পেয়ে যাচ্ছে। কারণ নারীদের রয়েছে কলঙ্কের ভয় এবং আইনটি শেষ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা হতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা।
সিতির ভালবাসার সম্পর্কের সূচনা অন্য সবার মতোই। তারা একই স্কুলে পড়তো। তাদের বন্ধুরা ছিল দু'জনেই পরিচিত। সে সময় তার প্রেমিককে খুবই বিশ্বস্ত, মনোযোগী এবং দয়ালু বলে তার মনে হয়েছিল।
"খুবই বোকার মতো কাজ করেছিলাম আমি। ভেবেছিলাম সে-ই আমার স্বামী হতে যাচ্ছে। তাই তাকে আমার কিছু ছবি এবং ভিডিও তুলতে দিয়েছিলাম," তিনি বলেন।
কিন্তু সম্পর্কের চার বছরের মধ্যে তার প্রেমিকের আচরণ বদলে যেতে থাকে।
"আমার বন্ধুদের সাথে দেখা হোক সে সেটা চাইতো না। দিনে ৫০ বার ফোন করে জানতে চাইতো আমি কোথায় আছি, কার সঙ্গে আছি।"
"আমার মনে হয়েছিল আমাকে খাঁচায় পুরে ফেলা হচ্ছে। যদি আমি খাঁচায় বন্দী থাকি, তাহলে সে খুশি। খাঁচা থেকে বের হলেই তার মাথা খারাপ হয়ে যেতো।"
একদিন সিতির প্রেমিক হঠাৎ করেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এসে হাজির হয় এবং সিতিকে গালাগাল করতে থাকে। সিতির ছবিগুলো সে সোশ্যাল মিডিয়ায় ফাঁস করে দেবে বলেও ভয় দেখায়।
"সে আমাকে 'কুত্তি, 'সস্তা', 'পতিতা' ইত্যাদি নামে ডাকতে থাকে," জানান তিনি। "আরেকদিন তার সাথে গাড়িতে বসে আমি যখন বলছি যে আমাদের সম্পর্ক শেষ, সে তখন আমার গলা চেপে ধরেছিল।"
"গাড়ি চালানোর সময় আমার খুব ভয় করতো। আত্মহত্যার কথা ভাবতাম। মাঝেমাঝেই মনে হতো চলন্ত গাড়ি থেকে বাইরে ঝাঁপ দিলে কেমন হয়!"
'আমিই ভিকটিম':
সিতি তার সাবেক প্রেমিকের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে নালিশ করতে চান না। কারণ অভিযোগ করতে হলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ফাঁস হওয়া তার সব অন্তরঙ্গ ভিডিও এবং ছবি থানায় জমা দিতে হবে এবং সাক্ষী জোগাড় করতে হবে।
"আমি পরিস্থিতির শিকার। কিন্তু তার পরও আমি চাইবো না যে এগুলো ছড়িয়ে পড়ুক," বলছেন তিনি।
"পুলিশ আমাকে সত্যি সত্যি সাহায্য করবে এটাও আমি বিশ্বাস করি না। কারণ তাদের বেশিরভাগই পুরুষ। আমার পরিবারকেও কিছু বলতে পারছি না। কারণ ঘটনাটি সম্পর্কে তারা এখনও কিছুই জানে না।"
পুলিশের কাছে অভিযোগ করার ব্যাপারে নারীদের এই দ্বিধা নিয়ে বিবিসির ইন্দোনেশিয়া বিভাগ পুলিশের আইজি পোল রাদেন প্রাবোয়ো আর্গোর সাথে কথা বলেছে। তিনি জানিয়েছেন, ভিকটিম যেখানে নারী, সেখানে অভিযোগ জানানোর ব্যাপারে বিশেষ নিয়মকানুনের ব্যবস্থা রয়েছে এবং এসব মামলার তদন্ত করবে নারী পুলিশ কর্মকর্তারা।
কিন্তু আইনি সাহায্য সংস্থা এলবিএইচ-এপিআইকে বলছে, অনলাইনে লিঙ্গ-ভিত্তিক যেসব অপরাধ ঘটে, তার মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশ সম্পর্কে পুলিশের কাছে অভিযোগ করা হয়।
সংস্থাটি বলছে, রিভেঞ্জ পর্নসহ অনলাইনে নারীদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের সহিংসতার মাত্রা অনেক বেড়েছে। এই মহামারির মধ্যেই তারা প্রতিদিন গড়ে দুই থেকে তিনটি করে অভিযোগ পাচ্ছে।
"এই পরিস্থিতির শিকার অনেক নারী মনে করেন, যে সাহায্য তাদের পাওয়া দরকার সেটি তারা পাচ্ছেন না। এখানে আইনি প্রক্রিয়া খুবই দীর্ঘ, আর আইন সাধারণত মেয়ে পক্ষ নেয় না।," বলছেন হুসনা আমিন।
'শোবার ঘরে সরকারি নজরদারী':
ইন্দোনেশিয়ায় ২০১৯ সালে একটি মামলা সংবাদের শিরোনাম হয়েছিল। এতে পর্নোগ্রাফি আইনে এক নারীকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। এই আইনে সর্বোচ্চ ১৫ বছরের সাজার বিধান রয়েছে।
গোপনে তোলা এক ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ওই মহিলা একাধিক পুরুষের সঙ্গে সেক্স করছেন, এবং ভিডিওটি অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে।
ওই নারীর পক্ষে মামলা লড়েছিলেন আস্রি ভিদিয়া। তিনি বলছেন, তার মক্কেল ছিল নির্দোষ। কারণ তিনি তার স্বামীর হাতে নিয়মিত নির্যাতিত হতেন এবং তিনি ছিলেন যৌন উদ্দেশ্যে পাচারের শিকার।
পর্নোগ্রাফি আইনকে বড় বেশি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে - এর কারণে নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, তার মন্তব্য।
আস্রি ভিদিয়া বিষয়টি নিয়ে তিনি এতটাই চিন্তিত হয়ে পড়েন যে গত বছর ইন্দোনেশিয়ার সাংবিধানিক আদালতে তিনি পর্নোগ্রাফি আইনকে চ্যালেঞ্জ করে মামলা দায়ের করেন।
তিনি বলেন, "আমার মক্কেলের ওপর নির্যাতন চলেছিল দুই ভাবে - প্রথমত, সে একজন ভিকটিম হলেও পর্নোগ্রাফিতে একজন মডেল হিসেবে বিবেচনা করে তাকে জেল দেয়া হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, তাকে একজন যৌনকর্মী আখ্যা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সে ছিল পরিস্থিতির শিকার।"
ইন্দোনেশিয়ার নারীদের জন্য এই দুটি মামলার গভীর তাৎপর্য রয়েছে বলে মনে করেন মিজ ভিদিয়া।
"নারী-পুরুষ ঘনিষ্ঠ হয়ে ছবি তুললে, বা ভিডিও করলে, তারপর তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটলে, তাদের ছবি আর ভিডিওগুলো যদি অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে জেল-জরিমানা হবে তাদেরই।"
কিন্তু আদালত ২০২০ সালে চ্যালেঞ্জটি খারিজ করে দেয়। আস্রি ভিদিয়া বলছেন, এরপর নারীদের যৌন সহিংসতার হাতে থেকে রক্ষার আশা নিভু নিভু প্রদীপের মতো জ্বলছে।
'এভাবে চলতে পারে না':
বন্ধুবান্ধবের সহায়তায় গত বছর থেকে সিতির জীবন কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে।
"প্রতি রাতে আমি কাঁদতাম, প্রার্থনা করতেম। আমি আর নিতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল আমি পাগল হয়ে যাব। কিন্তু পরে কিছুটা সাহস ফিরে এলো।"
সিতি আইনি সংস্থা এলবিএইচ-এপিআইকের সাহায্য নেয়ার পর আইনজীবী হুসনা আমিন সিতির সাবেক প্রেমিকের প্রতি একটি সমন পাঠিয়ে তার সব কার্যকলাপ বন্ধ করার ব্যবস্থা করেন।
সিতি সম্প্রতি টের পেয়েছেন যে তার সাবেক প্রেমিক তার নাম ও ছবি ব্যবহার করে একটি ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলেছে। তার আশঙ্কা, এই ভুয়া অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে আবার তার ছবি ও ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়া হবে।
"আমি এখন কাউকেই বিশ্বাস করতে পারি না," বলছিলেন তিনি।
বিবিসি ইন্দোনেশিয়া বিভাগ এসব বিষয়ে নারীর ক্ষমতায়ন ও শিশু-রক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করলেও তারা কোন মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে জাতীয় কমিশন জানাচ্ছে, তারা একটি আইনের খসড়া তৈরি করেছে যেখানে যৌন সহিংসতার শিকার নারীরা নিজেরই বিচারের সম্মুখীন হবে না, নিজের মামলার জন্য তাদের নিজেদের প্রমাণ খুঁজে বের করতে হবে না এবং তার বক্তব্যকেই আদালতে প্রমাণ হিসেবে গ্রাহ্য করা হবে।
কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার রক্ষণশীল ইসলামপন্থীদের সরব প্রতিবাদের মুখে খসড়াটি আটকে আছে। তাদের আশঙ্কা এই আইনের মাধ্যমে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ককে অনুমোদন দেয়া হবে এবং নারীবাদকে উসকে দেয়া হবে।
ফলে, সিতির মতো অনেকেই এখন এমন এক জীবনে আটকা পড়ে আছেন যেখানে হয় তাদের বিপদের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে চুপ থাকতে হচ্ছে, নয়তো মুখ খুলে বিচার, নিপীড়ন আর বৈষম্যের ঝুঁকিতে পড়তে হচ্ছে।