ঢাকা, রবিবার ২৪, নভেম্বর ২০২৪ ১৫:৫২:১৩ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

ঠেঙ্গামারা যখন ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে

মনিজা রহমান

উইমেননিউজ২৪.কম

প্রকাশিত : ০৪:১৬ পিএম, ২৪ অক্টোবর ২০১৭ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৯:৫৭ পিএম, ২৬ অক্টোবর ২০১৭ বৃহস্পতিবার

আবদুস সামাদ কিভাবে হয়ে গেলেন হোসনে আরা বেগম?

ভিক্ষুকের মুষ্টি চালকে পুঁজি করে গড়া ওঠা ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ, কিভাবে হল ফাইভ স্টার হোটেল, রিসোর্ট, হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজসহ হাজার কোটি টাকার মালিক?

কিভাবে সম্ভব হল এই অসাধ্য সাধন?

বইয়ে পড়া সংগ্রামী মানুষের প্রতীক ড. হোসনে আরা বেগম আর তার গড়া ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ সম্পর্কে লিখেছেন ’মনিজা রহমান’। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে সাক্ষাত হয় দু’জনের।

আপা, আপনার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট কি?

বেশীরভাগ সফল মানুষ কিন্তু এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারেন না। কিন্তু ড. হোসনে আরা বেগম পারলেন। ওভারিতে টিউমার আর তার অপারেশন, এরপরে পুরুষ থেকে নারীতে রূপান্তর এই ঘটনাই ছিল তাঁর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে ফিরে আসার ওই সময়ে নিজেই নিজেকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বাকী জীবনটা মানুষের সেবা করে কাটাবেন।

ওনার জন্য প্রস্তুত ছিল লাশ নেবার খাট। সবাই ধরেই নিয়েছিলেন তিনি আর বাঁচবেন না। সেই তিনি নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এলেন। কারণ ওনার মনোবল ছিল কঠিন। বাবা মারা গেছেন অনেক আগে। বিধবা অসহায় মাকে দেখার কেউ নেই। আর এজন্যেই ফিরে এলেন যেন তিনি।

কিন্তু এ কেমন ফেরা! ছিলেন পুরুষ, হয়ে গেলেন নারী। নাম ছিল আবদুস সামাদ, সেই নাম হয়ে গেল হোসনে আরা। ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লতিফ হলে। চলে আসতে হল মন্নুজান হলে। স্বাধীন জীবন যাপনের পরিবর্তে মেনে নিতে হল পরাধীনতার শেকল। কি দু:সহ বেদনা, আজন্ম বাধাবন্ধনহীন জীবন ছেড়ে হয়ে গেলেন পরাধীন। সবাই তাকে দেখত, মনে হত তিনি যেন কোন মানুষ নন, বুঝি কোন চিড়িয়াখানার প্রাণী! প্রাণে বেঁচে এলেও প্রতিনিয়ত মানুষের তীরযর দৃষ্টি মেরে ফেলতে লাগল তাঁকে।

অন্য কেউ হলে হয়ত আত্নহত্যা করতো। কিন্তু লড়াকু মানুষটি সেটা করলেন না। বাধা থেকেই নিজের শক্তিমত্তা জানতে পারলেন প্রফেসর ড. হোসনে আরা বেগম। ছোট বেলা থেকে তিনি লেখাপড়ায় ভালো ছিলেন। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন পুরুষ হিসেবে। তাঁর অধ্যয়নের বিষয় ছিল বোটানি। ১৯৭৫ সালে মাস্টার্স শেষ বর্ষে তাঁর জীবনের এই রূপান্তর ঘটে। যেটা নিয়ে সিরিজ প্রতিবেদন করেছিল সেই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন বিচিত্রা। এত কিছুর মধ্যেও হোসনে আরা বেগম মাস্টার্সে ভালো ফলাফল করেন। প্রথম শ্রেণী নিয়ে পাশ করেন তিনি।

সরকারী কলেজে অধ্যপনার চাকরী পান হোসনে আরা বেগম। বিয়ে করেন এক বন্ধুকে। সরকারী চাকুরী, নতুন বিয়ে, আনন্দে-ফূর্তিতে ভালোই ছিলেন তিনি। অবসরে ক্যারোম খেলতেন। দাবা খেলতেন। আর দশজন মানুষের মতো জীবনটা কাটিয়ে দিতেন হয়ত। হঠাৎ তাঁর মনে হল, মৃত্যু মুখে নিজেকে দেয়া প্রতিশ্রুতির কথা। মনে পড়ল, তিনি বঞ্চিত অসহায় নারীদের নিয়ে কিছু করবেন! জন্মাবধি পুরুষ জীবনে অভ্যস্ত হবার কারনে নারী জীবনে নিজেকে মানিয়ে নিতে গিয়ে হোসনে আরা বেগম বুঝতে পেরেছিলেন, কত পিছিয়ে আছে বাংলাদেশের নারীরা!

এভাবেই একদিন তিনি শুরু করলেন ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘের কাজ। ১৯৮০ সালে ভিক্ষুকদের মুষ্টি চালের মাধ্যমে গঠন করা এই সংগঠনটি এখন সারা বিশ্বের বিস্ময়। সম্প্রতি ইয়েল ইউনিভার্সিটি ড. হোসনে আরা বেগমকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল এই বিষয়ে পেপার প্রেজেন্টেশনের জন্য। নিউইয়র্কে আসার পরে ওনার সম্মানে মঙ্গলবার ১৭ অক্টোবর বাংগালী অধ্যুষিত জ্যাকসন হাইটসে এক মত বিনিময় সভার আয়োজন করেন সিনিয়র সাংবাদিক আকবর হায়দার কিরন। ওখানে আরও ছিলেন আরেক সিনিয়র সাংবাদিক ফারুখ ফয়সাল, যিনি বর্তমানে ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ সংক্ষেপে টিএমএসএসের একজন উপদেষ্টা।

ড. হোসনে আরা বেগম শৈশব থেকেই ছিলেন প্রতিবাদী। অন্যকে সাহায্য করতে কোর্টে যেতেন। এই অফিস থেকে অন্য অফিসে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। নির্যাতিতা মেয়েদের হাসপাতালে নিয়ে যেতেন। তাঁর স্বামী বলতো, তোমার এত মানুষের কাজ করার কি দরকার! আত্নীয়রা বলত, তুমি না সরকারী কলেজের প্রফেসর! তোমার কি এসব মানায়! কিন্তু তিনি নিজেকে ঘরে আটতে রাখতে পারতেন।

এভাবেই একদিন জন্ম হল ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘের। ড. হোসনে আরা বেগম সেই ইতিহাস বলতে গিয়ে জানান, ’১২৬ জন মহিলাদের একটি সংগঠন একদিন আমার সঙ্গে দেখা করতে এল। ওদের বেশীরভাগ ভিক্ষুক। কেউ কেউ দেহকর্মী। ওরা বলল, আমরা মানুষের বাড়িতে ঝি-চাকরের কাজ করি। তাদের ঘর মুছে দেই, ঝাড়ু দেই। কাজে সামান্য গাফিলতি হলে ওরা আমাদের কিল-ঘুষি মারতে আসে। কিন্তু আমরা কি খাই, কিভাবে থাকি, সেই খবর ওরা রাখে না। এখন আপনিই পারেন আমাদের উদ্ধার করতে।’ হোসনে আরা এদেরকে ঐক্যবদ্ধ করলেন। ওদেরকে বললেন, ‘স্বাবলম্বী হতে হলে আমাদের মধ্যে ঐক্য গঠন করতে হবে। শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। যদি কেউ বড় হতে চায়, সেই জন্য নিজের মধ্যে স্বপ্ন সৃষ্টি করতে হবে।’

১২৬ জন ভিক্ষুকের মুষ্টির ২০৬ মন চাল নিয়ে শুরু করা সেই সংঘের এখন মোট সম্পদের পরিমান ১৫ হাজার কোটি টাকা। বেতনভুক্ত জনবল ৩১ হাজার। উপকারভোগী পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৫৩ লাখ। টিএমএসএসের আছে হাজার বেডের হাসপাতালন, ৫ টি প্রাইমারী স্কুল, সরকার অনুমোদিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ৩২টি, শ্রম ঘন শিল্প প্রতিষ্ঠান ২৪টি, পাঁচতারা হোটেল কাম রিসোর্ট আছে একটি, উন্নতমানের হোটেল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে ৩০টি। হেলিকপ্টার আছে দুটি। রিয়েল এস্টেট এপার্টমেন্ট আছে। আছে মেডিকেল কলেজ, নার্সিং কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট, পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ট্রাভেলস এ্যান্ড ট্যুরিজম, সিএনজি লিমিটেড সহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান।

ড. হোসনে আরা বেগম বর্তমান ব্যস্ততা ওনার এলাকায় বগুড়াতে একটি আন্তর্জাতিক মানের থিম পার্ক স্থাপনের বিষয়ে। ওয়াশিংটন ও ফ্লোরিডায় কয়েকটি আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় ও আমেরিকার আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার সাথে এই ব্যাপারে কথা বলেছেন তারা। আঠারোশ শতক একরের ওপর এই থিম পার্ক প্রতিষ্ঠা করা হবে।

ড. হোসনে আরা বেগমের দূরদর্শী নেতৃত্বের ফসল বগুড়ার একটি প্রত্যন্ত গ্রামের নামে সৃষ্ট ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘের বিশ্বময় পরিচিতি। তার দূরদর্শীতার আরো একটি প্রমাণ মিলল আরেকটি ঘটনায়। কক্সবাজারে দি প্রিন্সেস নামে তাঁর ফাইভস্টারে হোটেলে পর্যটকদের বিনামূল্যে থাকার সুযোগ করে দেবেন তিনি। তাদের কাজ হবে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরনার্থীদের মানবেতর জীবন যাপন স্বচক্ষে দেখা। এই কাজটি তিনি মানবিক দৃষ্টভঙ্গী নিয়ে করলেও, এর পিছনে একটি সুদূর প্রসারী লক্ষ্যও আছে। ফিলিস্তিনের রামাল্লা প্রতি বছর বহু মানুষ যায় শরণার্থী প্যালেস্টাইনিদের দেখতে। বাংলাদেশেও এখন রোহিঙ্গা শরনার্থীদের সংখ্যা দশ লাখের ওপরে। তাদেরকে ঘিরে বিশ্ব মিডিয়ার ব্যাপক আগ্রহ। তাই তাদের বোঝা মনে না করে রোহিঙ্গাদের ঘিরে এভাবে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সুযোগ আছে বাংলাদেশের। বেসরকারী ভাবে সেই উদ্যোগই নিয়েছে টিএমএসএস। বগুড়ার গর্ব প্রাচীন পুন্ড্র নগরের সভ্যতা পরিদর্শনের ব্যবস্থা আছে টিএমএসএসের।

এত অর্জনের পরে অত্যন্ত সাধাসিধে পোষাকে ঘরোয়া জীবন যাপন ড. হোসনে আরা বেগমের। বড় বোনের মেয়ে আয়শা বেগম, যিনি টিএমএমএসের কোষাধ্যক্ষও, যিনি তাঁর সার্বক্ষনিক সঙ্গী। নিউইয়র্কে এসে উঠেছেন ব্রঙ্কসে আরেক বোনের মেয়ের বাসায়। সবার প্রতি স্নেহময় দৃষ্টি তাঁর। জীবনের বহু উত্থান-পতন আর বাঁক পরিবর্তনেও তিনি নিজের সাদামাটা-আন্তরিক রূপটি পরিহার করেননি। ভুলে যাননি বাংলাদেশের বঞ্চিত নারীদের কথা। যে কারনে তাঁর সংগঠনের সব সদস্যই নারী।

প্রথম যখন পুরুষ থেকে নারী হন, শুরুতে অবাক হতেন কোন বাড়ীতে গেলে নারীদের কেন অন্দর মহলে পাঠিয়ে দেয়া হয় সেই ভেবে। ড্রইং রুমে বসে পুরুষদের আড্ডায় তাদের প্রবেশাধিকার নেই। তাদের খেতে হয় সবার পরে। সমাজে-সংসারে সবর্ত্র পুরুষদের অগ্রাধিকার। নারীরা সব সময়ই অবহেলিত। তাইতো ড. হোসনে আরা বেগমের গড়া ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ শুধু সেই দিনই না, আজো আছে সেই বিপন্ন নারীদের পাশে, আগামীতেও থাকবে।