ঢাকা, সোমবার ২৫, নভেম্বর ২০২৪ ২৩:২৭:৫৭ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

ছোট গল্প# আদল

সোমা দেব

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৩:৩৫ পিএম, ২৮ মে ২০২১ শুক্রবার

ছোট গল্প#  আদল, লেখক# সোমা দেব

ছোট গল্প# আদল, লেখক# সোমা দেব

রান্নাঘর থেকে ঝনঝন করে কিছু একটা ভাঙ্গার শব্দ এলো। কাঁচের জগ বা গ্লাস হবে। দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখলাম, যা ভেবেছিলাম, ঠিক তাই!! গত মাসেই এত শখ করে কিনেছিলাম জার্মান গ্লাসের এই জগটা। সারা সময় শোকেসেই ছিলো। গতকাল ঈদের দিন বলে বের করেছিলাম। আর ভাঙ্গবি তো ভাঙ, এই জগটাই ভাঙ্গতে হলো। রাগে, দুঃখে চেঁচালাম অনেকক্ষণ। বুড়ি এই বুয়াটার ওপর অনেকক্ষণ রাগ ঝাড়লাম।
-'দেখেশুনে কাজ করতে পারোনা? বেতন তো কম দেই না! এই জগের দাম জানো তুমি! এখন কি তুমি কিনে দেবে দামি জগটা? একটা কাজও ঠিকঠাক করতে পারোনা! চলে আসো চড়া বেতনে কাজ করতে!' 

রাগের চোটে আবরারকেও ডেকে আনলাম৷ দেখালাম ওকে। আবরার সব দেখলো। মিনমিন করে কী যেন বললো, আবার চলে গেলো বেডরুমে। ওর স্বভাবই এমন। আমি ভাবলাম বুয়াকে বকে দেবে, তা না! 

এমনিতে আবরার খুব রাগী, কাজকর্মে ঊনিশ থেকে বিশ হলেই রেগে যায়। কিন্তু এই বুয়াকে কখনও কিচ্ছু বলেনা। 

কালও বললাম বুয়া পেঁয়াজ কিনে এনে টাকা কম দিয়েছে। আবরার বললো-'থাক, ছেড়ে দাও। বেশি টাকা নাতো!' 

অথচ অফিসের পিয়ন সেদিন বিশ টাকা সরিয়েছিল বলে বাসায় এসে পিয়নটাকে চোর-বাটপার বলে গজগজ করছিলো। 

ঈদের আগে যাকাতের টাকার অনেকটা অংশই এই বুড়ি বুয়াকে দিয়ে দেয়। অথচ আমার বাসায় রান্নার কাজ করে যে বুয়া, বললেও ওকে তেমন কিছু দিতে চায় না। 

আমি জগ ভাঙ্গার টুকরোগুলো নিজের হাতে কুড়াই। পাছে ছেলের পায়ে লেগে পা কাটে! বুয়া বকা খেয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। 

কয়েকদিন পরের কথা, সকালের নাস্তা খেতে বসেছি। আলু ভাজিতে এত্ত লবণ! বুড়ি বুয়াকে আবার বকি। 
-'কোন দিকে মন থাকে রান্না করতে গিয়ে? এত্ত লবণ দিয়ে রেখেছো?'
- 'মনের ভুলে পড়ে গেছে দুইবার'। 

আর আবরার! যে কিনা এক বিন্দু লবণ বেশি হলে খেতে পারেনা, সে কিচ্ছুটি না বলে খেয়ে চলে গেলো। এই বুড়ি বুয়া যদি কখনো বোকামি করে, কিংবা বোকামি করে কোনো কথা বলে সেটা শুনে আবরার মজা পেয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ে। 

সারাক্ষণ কিছু না কিছু ভুল করতেই থাকে বুয়াটা। হয় ফার্নিচার মুছবে না, নয় তো ব্যালকনি মুছতে গিয়ে ফুল গাছের ডাল ভেঙ্গে ফেলবে, রান্নাঘরের কোণায় ময়লা থাকবে, না হয় খাবারের প্লেট ভাঙ্গবে! আর রাখা যাবে না ওকে। 

আজকে এমন রাগ হলো। বুয়াকে ডেকে বললাম-'এই মাস পর থেকে আর আসবেনা তুমি। তোমাকে দিয়ে আর কাজ করাবো না। আর চার দিন কাজ করে বেতন নয়ে বিদায় হও।' 
বুয়া শুধু বললো-'এই করোনার সময়ে তো কাজ না করতে পারলে না খেয়ে মারা যাবো!' 
ওর কথা শুনে আমার মন গললো না। এটাই শেষ কথা। আর কত ক্ষতি মেনে নেবো! 

বিকেলে চা খেতে খেতে আবরার আমাকে বললো-'শুস্মি, বুড়ি বুয়াকে বাদ দিও না। এরকম ছোটখাট ভুল তো আমাদেরও হয়। থাক। ও চলে গেলে তোমারও তো কষ্ট হবে!'
আমি কিছু বললাম না। অবাক হয়ে আবরারের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আবরার টিভি দেখতে লাগলো। 

পরের দিন দুপুরে ছেলের পাশে শুয়ে ওকে ঘুম পাড়াচ্ছিলাম। আমারও চোখ লেগে গিয়েছিল। হঠাৎ ফিসফিস কথার আওয়াজে তন্দ্রা ছুটে গেলো। কান পেতে থাকলাম। আবরারের গলা শোনা যাচ্ছে। কার সাথে যেন কথা বলছে। সন্দেহ নিয়ে কানটা পেতেই রইলাম। সামনে গেলাম না। আবরার কার সাথে কথা বলছে? ভাল করে শোনার চেষ্টা করলাম। 

আবরার বলছে-'বুয়া, শুস্মি যেভাবে বলে সেভাবেই কাজ করো। শুস্মিকে রাগিও না। ও তোমাকে ছাড়িয়ে যেন না দেয়। 

কথা শেষ করে একটু থামলো ও। তারপর আবারও বললো-‘জানো বুয়া, খুব ছোটবেলায় আম্মা মারা গেছে। আম্মার কথা মনেই নেই। শুধু ঈদ এলে আম্মার চেহারার একটা ছবি খুব মনে হয়। পায়জামা-পাঞ্জাবি পড়িয়ে আমাকে কোলে নিয়ে সেমাই খাওয়াচ্ছে। ঈদ এলে আমি চোখ বন্ধ করে আম্মার গায়ের সেই ঘ্রাণটা পাই। সেদিন পুরোনো ট্রাঙ্কে একটা বইয়ের ভেতর আম্মার একটা ছবি পেয়েছি। দেখো। ‘

বলেই বুয়াকে ছবিটা দেখালো। 

ও আবার বললো-'দেখো, আম্মা অনেকটাই তোমার মত দেখতে। কোথায় যেন খুব মিল। তোমাকে দেখলে আমার আম্মার কথা মনে হয়। আমার কথাটা রেখো। এই বাড়ির কাজ ছেড়ে কোথাও যেয়ো না তুমি।'