একজন সুফিয়া কামাল: শৃঙ্খলমুক্ত জীবনের বাঁশিওয়ালা
আইরীন নিয়াজী মান্না
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ১০:১৮ এএম, ২০ জুন ২০২১ রবিবার
কবি সুফিয়া কামাল। ফাইল ছবি।
‘অনেক কথার গুঞ্জন শুনি/অনেক গানের সুর/সবচেয়ে ভাল/লাগে যে আমার/‘মাগো’ ডাক সুমধুর। ...আমার দেশের মাঠের মাটিতে/কৃষাণ দুপুরবেলা/ক্লান্তি নাশিতে/কন্ঠে যে তার/সুর লয়ে করে খেলা।’ ........
তিনি দেশকে ভালোবেসেছেন গভীর মমতায়। দেশের প্রতি ছিল তাঁর মমত্ববোধ। তার রচিত কবিতায় সেই ভালোবাসা উঠে এসেছে বারবার। তার মনের গহীনে থাকা ভালোবাসা তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন মানুষের প্রতি। কচি-কাঁচার মেলায় তিনি আমাদের মুক্তযুদ্ধের গল্প শোনাতেন। বাংলাদেশের গল্প বলতেন, ইতিহাসের গল্প বলতেন। আমরা মনোমুগ্ধ হয়ে শুনতাম সে সব গল্প আর স্বপ্ন দেখতাম ভবিষ্যতের। আমরা তাকে খালাম্ম বলে ডাকতাম; তিনি আমাদের ভালোবাসতেন নিজের সন্তানের মত।
আমার মায়ের হাত ধরে সেই শিশু বয়সে তার লেখার সাথে আমার প্রথম পরিচয়। মা সুর করে আবৃত্তি করতেন ‘আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা/তোমরা এ যুগে সেই বয়সেই লেখাপড়া কর মেলা/আমরা যখন আকাশের তলে ওড়ায়েছি শুধু ঘুড়ি/তোমরা এখন কলের জাহাজ চালাও গগন জুড়ি’।
মায়ের মুখ থেকে শুনে শুনে আমাকে এই কবিতা মুখস্ত করতে হতো। পরে একটু বড় হয়েই এই মহান কবির সান্নিধ্য পাই। এই খালাম্মা আর কেউ নন; কবি বেগম সুফয়া কামাল।
কচি-কাঁচার মেলার তিনজন প্রতিষ্ঠাতার অন্যতম সুফিয়া কামাল। তিনিই আমাদের শিখিয়েছিলেন কিভাবে দেশকে ভালোবাসতে হয়, কিভাবে মানুষকে ভালোবাসতে হয়।
প্রায়ই আমরা একদল বাচ্চা-কাচ্চা দল বেধে তার ধানমন্ডির বাসায় যেতাম। কচি-কাঁচার অন্যতম সংগঠক আনজাল ভাই আমাদের নিয়ে যেতেন। সে দিন কি যে মজা হতো! অনেকটা সময় আমরা খালাম্মার সাথে কাটিয়ে; অনেক রকম গল্প শুনে তারপর বাড়ি ফিরতাম। খালাম্মা আমাদের অনেক রকম খাবার খেতে দিতেন। মুড়ির মুড়কী, পিঠা, পায়েশ কত্ত না খাবার! ধানমন্ডি ৩২ নম্বরেরর ঠিক পাশের বাসাটাই খালাম্মার বাসা। ওই বাসায় যাওয়ার এটিও ছিলো একটি আকর্ষণ আমার কাছে। খালাম্মা বঙ্গবন্ধুর গল্প করতেন আমাদের কাছে। মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা তুলে ধরতেন। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম।
একদিন খালাম্ম তার ড্রইং রুমে আমাদের নিয়ে বসে আছেন। মুক্তযুদ্ধের সময়ের গল্প বলছেন তিনি। হঠাত গল্প থামিয়ে আমাকে কাছে ডেকে বললেন, ‘যে গল্পগুলো বলছি তা খুব মন দিয়ে শুনবে। বড় হলে কাজে লাগবে। মনে থাকবে?’
হ্যাঁ। বড় হওয়ার পর তার অনেক বলে যাওয়া কথাই কাজে লেগেছে। মনে রেখেছি আমি; আমরা। আজ ২০ জুন খালাম্মার ১০৭তম জন্মদিন। তাকে প্রাণঢালা ভালোবাসা এবং শুভেচ্ছা আজকের দিনে। ১৯১১ সালের এ দিনে তিনি বরিশালের শায়েস্তাবাদের মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।
সুফিয়া কামাল শুধু নারী আন্দোলনের অগ্রপথিক নয়, সামগ্রিক সমাজ সংস্কারের প্রতীক ছিলেন। অবিচল ছিলেন আপন চেতনায়। আজ চারদিকে যেভাবে জঙ্গিবাদের আস্ফাালন দেখছি তাতে বারবার সুফিয়া কামালের কথা মনে হয়। আমাদের এই প্রিয় খালাম্মা বেঁচে থাকলে রুখে দাঁড়াতেন মৌলবাদের বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশে নারীজাগরণ ও অসাম্প্রদায়িক নারী-পুরুষ সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমৃত্যু লড়ে গেছেন প্রগতিশীল আলোকিত এই নারী। এদেশে নারী অগ্রাসনে তার ভূমিকা অসামান্য।
ভাষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, অসহযোগ আন্দোলন, নারীজাগরণ আর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ও ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন তিনি।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের চেতনাকে তিনি ধারণ করতেন গভীরভাবে। আর সেই চেতনার রুমালটি বহন করেছি আমরা। সেটাকেই ছড়িয়ে দিতে হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। নতুন প্রজন্মের কচি-কাঁচারা এগিয়ে নিয়ে যাবে সেই চেতনাকে।
মানুষকে মানুষ হতে জীবনের শুরু থেকেই সাধনায় ব্রতী হতে হয়। আর সেই সাধনায় নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন সুফিয়া কামাল। সুফিয়া কামালের মতো মানুষেরাই মানসিক বিকাশের আলোয় এই দেশটিকে গড়েছেন। কখনো নিজের জন্য কিছু করেননি। করেছেন প্রতিটি মানুষের জন্য। আমৃত্যু ধারণ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিলেন তিনি মানুষের পাশেই। সব রকমের ভয়-ভীতি আর সংচোক দূর করে তিনি জাতীয় সংকটের মুহূর্তে চেতনার দীপ্ত শিখা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মানুষ আর মানবতার পাশে।
১৯৯৯ সালে ২০ নভেম্বর তিনি মারা যান। তাকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। আজ তার জন্মদিনে রইলো গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।