শেষ মোঘল সম্রাজ্ঞী জিনাত মহল, মৃত্যুদিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি
অনু সরকার
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০৬:৫৭ পিএম, ১৭ জুলাই ২০২১ শনিবার
শেষ মোঘল সম্রাজ্ঞী জিনাত মহল ও শেষ মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর।
বেগম জিনাত মহল (১৮২৩-১৮৮৬); তিনি ছিলেন মোঘল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাজ্ঞী। তিনি বাহাদুর শাহ জাফরের পরিবর্তে মোঘল সাম্রাজ্য পরিচালনা করতেন। জিনাত মহল বাদশাহের সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী ছিলেন।
মোঘল বাদশাহের সঙ্গে যখন বিয়ে হল, তখন বাদশাহর বয়স পঁয়ষট্টি বছর, আর মেয়েটির বয়স মাত্র সতেরো। সতেরো বছরের মেয়েটি দিল্লির লাল কেল্লায় নামল পালকি থেকে, নববধূর বেশে। লোকজনের চাপা গুঞ্জন আর বুড়োর ভীমরতির কথা কানে আসছিল। কিন্তু মেয়েটা দেখছিল লালকেল্লার লাল পাথর। দিন পড়ে এলো। বাদশাহী ব্যাপার!
মোঘল বাদশাহ দ্বিতীয় আকবর শাহ চোখ বুজলেন, বাষট্টি বছর বয়সে দিল্লির সিংহাসনে বসলেন শাহজাদা মির্জা আবু জাফর। নাম হল বাহাদুর শাহ জাফর। বাদশাহ কবিতা চর্চা করতে ভালোবাসতেন। রীতিমতো কবি ছিলেন তিনি। ছিলেন উচ্চমানের গীতিকার। উর্দু ও ফারসি ভাষায় ভাল দখল ছিল। বাদশাহ গান শুনতে এবং মঞ্চাভিনয় দেখতেও ভালোবাসতেন। নিজস্ব সমৃদ্ধ পাঠাগার ছিল। তার আলফাজ দিল্লির কবিতা-প্রেমীদের প্রিয় ছিল। মির্জা গালিব তখন দিল্লি-আগ্রার জনপথে নৈঃশব্দ খোঁজেন গভীর রাতে, নেশার ঘোরে মাঝে মাঝে গেয়ে ওঠেন স্বরচিত গজল। বাদশাহর তাকে সভায় আগলে রেখে দিলেন, তাকে ভূষিত করলেন একের পর এক উপাধিতে; দবির-উল-মুল্ক, নজম-উদ-দৌলা, মির্জা নোশা।
মোঘল বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফর তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মোটা পেনশনে দিন কাটান। কোম্পানির সিভিল সার্জেন্টরা ঠিক করে দেয় প্রশাসনিক কর্তব্য। বাহাদুর শাহ শীলমোহর দেন, না দিলেও চলে। তিন বছর বাদশাহী জীবন কাটিয়ে বাহাদুর শাহ আবার নিকাহ করলেন। একটি অল্পবয়সী মেয়েকে তার খুব মনে ধরে গিয়েছিল। চঞ্চল, লাজুক না, মেয়েলি তেহজীবের আড়ষ্টতা নেই কথাবার্তায়। ভালো লেগে গেল ব্যতিক্রমী চরিত্রের 'অ-মেয়েলি' মেয়েটিকে।
জিনাত মহল বাহাদুর শাহ জাফরের সাথে ১৮৪০ সালের ১৯ নভেম্বর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। তাদের ঘরে মির্জা জাওয়ান বখত নামের এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়েছিল।
অতি সাধারণ পরিবারের মেয়েটি হল বাদশাহর চতুর্থ বেগম। বিগত যৌবনা অন্যান্য বেগমরা বিরক্তি নিয়ে দেখলেন, একটা ষোলো-সতেরো বছরের মেয়ে বাদশাহের সঙ্গে মহলে প্রবেশ করছে তার নঈ বেগম হয়ে; বেগম জীনাত মহল।
অল্প সময়ের মধ্যেই অন্দরমহলের অন্যান্য সহচরীদের এবং প্রজাদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন জীনাত মহল। বৃদ্ধ বাদশাহের যুবতী ভার্যা, তাই বাদশাহর ওপরেও প্রভাব ছিল যথেষ্ট। উনি যা আবদার করতেন, বৃদ্ধ তাই-ই মেনে নিতেন। উনি বাপের বাড়ি বা অন্য কোথাও যাওয়ার জন্য পালকি নিয়ে রাজপথে এলে, যে পথ দিয়ে যেতেন সেই পথে ডঙ্কা বাজত। আর তাই লোকমুখে নাম হয়ে গেছিল 'ডঙ্কা বেগম'। জিনাত মহল পুরাতন দিল্লির লাল কুয়ানে নিজের প্রাসাদে বাস করতেন। লাল কুয়ানে তার প্রাসাদসম মহলের নামও পরে হয়ে যায় জীনাত মহল। ১৮৪৬ সালে বাদশাহী খাজানার টাকায় নির্মাণ করা হয়েছিল এই প্রাসাদ জীনাত মহল। লাল কুয়ানের সেই জিনাত মহল অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে আজও।
অন্য বেগমদের হিংসে বাড়ত, কুৎসা রটানো চলত জীনাত মহলের নামে। তবে তিনি নিজের পরিকল্পনা এবং কৌশলে অবচিল থাকতেন। জীনাত মহল সত্যিই ছিলেন অন্য ধাতুর মানুষ। অন্দরমহলে আবদ্ধ থাকার মতো পর্দানশীন বেগম নন। শুধু সহচরী নয়, সহচররাও থাকত তার সঙ্গে অনুগত এবং বিশ্বস্ত দাসের মতো। যে যা মানে বের করুক, উনি পরোয়া করতেন না।
বাহাদুর শাহ জাফরের বাইশজন ছেলে ছিল। কিন্তু জীনাত আর বাহাদুর শাহের একমাত্র সন্তান ছিলো মির্জা জাওয়ান বখত। শাহজাদা দারা বখতের মৃত্যুর পর (বাহাদুর শাহের পর জ্যেষ্ঠ পুত্র হিসেবে তারই বাদশাহ হওয়ার কথা। কিন্তু ঊনষাট বছর বয়সে তিনি মারা যান) শাহজাদা জওয়ান বখতকেই উত্তরাধিকার ঘোষণা করার জন্য জল্পনা শুরু করে দিলেন জীনাত মহল। জিনাত মহল সম্রাটকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারতেন। তাই সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী মির্জা দারা বখতের মৃত্যুর পর তিনি তার সন্তান মির্জা জাওয়ান বখতকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করতে তদবির শুরু করেন। কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নীতি অনুযায়ী এটা গ্রহণযোগ্য ছিল না। কোম্পানির সাহেবরা এ প্রস্তাব না-মঞ্জুর করে দিল, তারা স্পষ্ট জানাল-পরবর্তী উত্তরাধিকার মির্জা ফত-উল-মুল্ক বাহাদুর (ওরফে মির্জা ফাখরু), তাকেই তারা বাদশাহর ওয়ারিস মেনে নেবে। জীনাত মহল সাময়িকভাবে দমে গেলেও হাল ছাড়লেন না। অনেক স্বপ্ন ছিল তার একমাত্র পুত্র, জওয়ান বখতকে নিয়ে। ১৮৫২ সালে, মাত্র এগারো বছর বয়সে জওয়ান বখতের নিকাহ করালেন। খানা-পিনা চলল দশ দিন ধরে!
ব্রিটিশ রেসিডেন্সির কিছু কর্মকর্তা পারিবারিক ব্যাপারে অতিরিক্ত নাক গলাচ্ছে বলে যথেষ্ট বিরক্ত ছিলেন বেগম জীনাত মহল। সেই রাগ থেকেই হত নানারকম কোম্পানি-বিরোধী ষড়যন্ত্র। দিল্লী রেসিডেন্সির স্যার থমাস মেটকেফ যখন ১৮৫৩ সালে দীর্ঘ অসুস্থতার পর মারা গেলেন, অনেকেই সন্দেহ করেছিল, সেটি বিষক্রিয়ার প্রভাব। সন্দেহের তির ছিল বেগম জীনাত মহলের দিকেই।
এ ঘটনার পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অভিজ্ঞ প্রশাসকদের কপালে ভাঁজ বাড়তে শুরু করল। তারা বুঝলেন, লাল কেল্লা নয়, শাসন চলছে লাল কুয়াঁ থেকে। দেখতে দেখতে আরো কয়েক বছর কাটল। ইতিমধ্যে ১৮৫৬-তে বাদশাহী উত্তরাধিকার মির্জা ফাখরুও মারা গেলেন। খুলে গেল নতুন উত্তরাধিকার নিয়ে জল্পনার সম্ভাবনা। কিন্তু আচমকাই এসে পড়ল সিপাহী বিদ্রোহ।
১৮৫৭ সালে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলন মোড় ঘুরিয়ে দিল সবার ভাগ্যের। কোম্পানির সাহেবরা জানতেন, অসুস্থ বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ জাফর যা-ই ভাবুন বা করুন, বেগম জীনাত মহল ইংরেজদের বিপক্ষেই থাকবেন। হলও তাই, উনি লাল কেল্লার দরজা খুলে দিলেন মীরাটের বিদ্রোহী সিপাইদের জন্য। বাদশাহর যুবক শাহজাদারাও এক এক করে ইনকালাব বলে নেমে পড়ল বিদ্রোহের লড়াইয়ে। কিন্তু বেগম জিনাত মহল সুকৌশলে নিজের ছেলেকে সরিয়ে রাখলেন বিদ্রোহের আগুন থেকে, তার তখনও স্বপ্ন, এইসব মিটে গেলে জাওয়ান বখতকেই ক্ষমতায় বসাতে হবে। নিজে সবরকমভাবে বিদ্রোহে সক্রিয় হয়ে উঠলেন, ছেলেকে রেখে দিলেন আড়ালে। গায়ে আঁচ আসতে দিলেন না।
সে বছর ১২ মে বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ হঠাৎই দরবার ডাকলেন অনেক দিন পর (জীনাতের কথা মতোই), সিপাইদের প্রতিনিধিরা তাকে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেওয়ার আর্জি জানাল। অথর্ব বৃদ্ধ, নেতৃত্ব দিতে অক্ষম, চিকের আড়ালে বসে থাকা বেগম জীনাতের দিকে তাকালেন ইশারার অপেক্ষায়। ১৬ মে সিপাহীরা প্রায় পঞ্চাশজন ইংরেজকে একদিনে হত্যা করল। দিল্লির ইংরেজ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে ইংরেজ বন্দি-যাকে পেল, তাকেই হত্যা করা হল। হত্যা করা হল সিভিলিয়ান ইংরেজ পরিবারের মানুষজনকেও। শুরু হল লুঠ-তরাজ। লুঠ এবং অরাজকতার বিরোধিতা করলেও প্রকাশ্যে বিদ্রোহকে সমর্থন জানালেন দিল্লির বাদশাহ। কয়েক মাস দিশাহীন খণ্ড-যুদ্ধের পর, দিল্লিকে দ্রুত ঘিরে ফেলল কোম্পানির লাল ফৌজ। উপযুক্ত সেনাপতি এবং যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার মত ব্যক্তির অভাব ছিল। অভিজ্ঞতা ছিল না শাহজাদাদের। বাবরের বংশধররা যুদ্ধ করতেই ভুলে গিয়েছিলেন চারশো বছর পর।
পরাস্ত হল অসম ক্ষমতার বিদ্রোহ, অন্য কোথাও থেকে সামরিক সাহায্যও এল না। বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ জাফরের বয়স তখন বিরাশি। অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি আত্মগোপন করলেন সম্রাট হুমায়ূনের সমাধিসৌধতে। বাদশাহর প্রধান উপদেষ্টা এবং উজির হাকিম আহসানউল্লাহ খাঁ পরামর্শ দিলেন-‘আগেই নিষেধ করেছিলাম বিদ্রোহের পথে যেতে, গ্রাহ্য করলেন না। অনেক হয়েছে, এবারে আত্মসমর্পণ করুন।’
সেই পরামর্শ মতো বৃদ্ধ আত্মসমর্পণ করলেন, তাতে যদি পরিবার বাঁচে। কিন্তু তা আর হল না। বিশ্বাসঘাতকতা করলেন আহসানউল্লাহ, ইংরেজদের পক্ষে চলে গিয়ে তাদের হাতে প্রমাণ তুলে দিলেন-বাদশাহ সপরিবার কোম্পানির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছেন। শাহজাদা মির্জা মুঘল এবং মির্জা খিজির সুলতানকে দিল্লি গেটের সামনে গুলি করে হত্যা করল ইংরেজ মেজর উইলিয়াম হডসন। হত্যা করা হল বাদশাহর পৌত্র আবু বখতকেও। তারপর হুমায়ূনের সমাধিসৌধ থেকে বাদশাহকে বার করে নিয়ে যাওয়া হল লাল কুয়াঁর জীনাত মহলে। বন্দী হলেন বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফর এবং জীনাত মহল।
যথেষ্ট অপমান এবং বিদ্রূপের শিকার হলেন অসুস্থ এবং অথর্ব বৃদ্ধ বাদশাহ। ইংরেজ ঘোষণা করল, দিল্লির বিদ্রোহ দমন করা গেছে, দিল্লি আমাদের দখলে। ওদিকে তখন লাল কেল্লার সামনে কামনের মুখে বেঁধে তোপ দেগে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে একের পর এক বন্দি বিদ্রোহী-সিপাইকে। সপরিবারে দিল্লি-আগ্রা ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে সিঁদুরে মেঘ দেখা প্রজারা।
তারপর শুরু হলো বিচারের নামে প্রহশন। ৪১ দিন ধরে একাধিক অপরাধের ধারায় বিচার চলল বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফর এবং জীনাত মহলের। ২১ জন সাক্ষী, ১৯টি শুনানি। তারপর সাজা ঘোষণা হল। যাকে এতদিন বলা হত 'অথর্ব বৃদ্ধ, নেতৃত্ব দিতে অক্ষম', তিনিই হয়ে গেলেন দিল্লি বিদ্রোহের প্রধান অভিযুক্ত। দণ্ডিত হলেন ভারতের শেষ মোঘল বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফর। সলিল সমাধি হল মোঘল শাসনের।
১৭ বছর বয়সে বেগম হয়ে লাল কেল্লায় পালকি থেকে নামা চঞ্চল মেয়েটি, ৩৪ বছর বয়সে তার বৃদ্ধ অসুস্থ বাদশাহের সঙ্গে নির্বাসনে যাওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন। বয়স এবং অসুস্থতার কারণে 'প্রধান অভিযুক্ত'র জেল বা মৃত্যুদণ্ড হল না, কিন্তু নির্বাসন হল একেবারে দেশের বাইরে-রেঙ্গুনে। বাহাদুর শাহ জাফরের অমূল্য পাঠাগারের সব পুঁথি বাজেয়াপ্ত করল কোম্পানি সরকার। বাজেয়াপ্ত করল অনেক বাদশাহী সম্পত্তি, অর্থ; পেনাল্টি অফ রিবেলিয়ন।
বেশ কয়েকটি গরুর গাড়িতে করে পরিবার এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে পূর্বপুরুষের ভূমি দিল্লিকে চির বিদায় জানিয়ে ভোর চারটার সময়ে (মানে রাতের অন্ধকারেই) নির্বাসনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন প্রাক্তন-বাদশাহ, সঙ্গে বৃটিশ রানির রাজকীয় প্রহরা।
১৭ অক্টোবর, ১৮৫৮ সাল। ভোরের আজান হাহাকারের মতো লাগছিল বৃদ্ধের কানে। এদিন ভোর চারটায় অনেকটা রাতের অন্ধকারে ৮৩ বছরের বৃদ্ধ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর নির্বাসনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন পূর্বপুরুষের ভূমি দিল্লি ছেড়ে। তার সঙ্গে গেলেন সম্রাজ্ঞী জিনাত মহল, অন্য বেগমরা, দুই শাহজাদা, শাহজাদী এবং অন্য আত্মীয় ও ভৃত্যদের নিয়ে ইংরেজ গোলন্দাজ ও অশ্বারোহী বাহিনী দিল্লি। কিন্তু এলাহাবাদ অবধি গিয়ে ফিরে এলেন বেগম তাজ মহলসহ অন্যান্য বেগম এবং আরো কিছু সহযাত্রী। কেউ রেঙ্গুন যেতে চাইলেন না বাদশাহর সঙ্গে। সঙ্গে গেলেন শুধু বেগম জীনাত মহল আর দুই শাহজাদা-জওয়ান বখত এবং শাহ আব্বাস।
মির্জা জাওয়ান বখতকে বাদশাহ হিসেবে দেখার স্বপ্ন অপূর্ণ রয়ে গেল জীনাতের। বাদশাহীও থাকল না। আর তাই বিদ্রূপের জীবন আর ভূলুন্ঠিত সম্মান নিয়ে দিল্লীতেও থাকতে চাইলেন না ডঙ্কা বেগম। বরং, শত অভিযোগ থাকলেও সেই অসহায় অসুস্থ বৃদ্ধের নির্ভরযোগ্য সঙ্গিনী হয়ে চলে গেলেন রেঙ্গুন।
৯ ডিসেম্বর জাহাজ রেঙ্গুনে পৌঁছেন সম্রাট। ব্রিটিশ বাহিনীর ক্যাপ্টেন নেলসন ডেভিসের বাসভবনের ছোট গ্যারেজে সম্রাট ও তার পরিবার-পরিজনের বন্দিজীবন শুরু হয়। সম্রাটকে শুতে দেয়া হয় একটা পাটের দড়ির খাটিয়ায়। ভারতের প্রিয় মাতৃভূমি থেকে বহু দূরে রেঙ্গুনের মাটিতে সম্রাটের জীবনের বাকি দিনগুলো চরম দু:খ ও অভাব অনটনের মধ্যে কেটেছিল। সম্রাট পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হলেন।
সালতানাত আর অপমানের স্মৃতি নিয়ে রেঙ্গুনে আরো চার বছর বেঁচে ছিলেন বাহাদুর শাহ জাফর। ১৮৬২ সালের ৭ নভেম্বর, শুক্রবার ভোর ৫টায় বাহাদুর শাহ জাফর চীরনিদ্রায় চলে যান। তার মৃত্যুর পর ব্রিটিশরা মোঘল সাম্রাজ্যের আনুষ্ঠানিকভাবে ইতি টেনে দেয়। অন্তিম সময়ে খুব মানসিক কষ্ট পেয়েছিলেন, নিজের দেশের মাটি পেলেন না বলে। বাদশাহর মৃত্যুর পর 'মোঘল বাদশাহ' উপাধি বরখাস্ত করল ইংরেজ সরকার (তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন শেষ, ভারতে বড়োলাটের আসন পাতা হয়েছে)।
জীনাত মহল জীবিত ছিলেন আরো চব্বিশ বছর। রেঙ্গুনেই থাকতেন, দেশে ফেরার ইচ্ছে প্রকাশ করেননি কোনো দিনও। তার শেষ বয়সের একটি আলোকচিত্র আছে, দেখলে মনে হয়-বৃদ্ধার চোখ কত কথা বলে এখনও!
জিনাত মহল ১৮৮৬ সালের ১৭ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। তাকে রেঙ্গুনে শোয়েডাগন প্যাগোডার নিকটবর্তী ড্রাগন টাউনশিপে বাহাদুর শাহ জাফরের সমাধিসৌধে সমাহিত করা হয়। জীবনের অনেকগুলো অপূর্ণ ইচ্ছে, অভিযোগ আর আবদার নিয়ে বাদশার পাশেই চিরনিদ্রায় রইলেন তার ছোটি বেগম, ভারতের সিপাহী বিদ্রোহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, বেগম জীনাত মহল।
বৃদ্ধ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর নিজের এপিটাফ নিজেই লিখে গিয়েছিলেন। এপিটাফে তিনি লিখেছিলেন এক উর্দু গজল। তার দুটো লাইন এমন–‘উমর-এ-দরাজ মাংগে লায়ে থে চার দিন...দো আর্জু মেঁ কাট গিয়ে, দো ইন্তেজার মেঁ’। …একই কথা কি ছিলো শেষ মোঘল সম্রাজ্ঞী জিনাত মহলের মনেও?