ঢাকা, শুক্রবার ২২, নভেম্বর ২০২৪ ১১:০০:৫৬ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

নোনতা ঈদ, মিঠা ঈদ

শামীম আজাদ

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১২:৪৭ এএম, ২৫ জুলাই ২০২১ রবিবার

শামীম আজাদ।  ছবি ফেসবুক থেকে নেয়া।

শামীম আজাদ। ছবি ফেসবুক থেকে নেয়া।

আমার বারো তেরো বছর বয়সে আমরা ছোট্ট মহকুমা শহর জামালপুরে ছিলাম। সে সময় মেয়েরা বাজারে যেতো না। ক্লান্ত অবসন্ন দুপুরবেলা শোনা যেতো, ছিট কাপড় নিবে... ছিটের কা...প...ড়...। ছিট কাপড় ফেরিওয়ালা ডাক। ডাকটা যিনি দিতেন তিনি মালিক। তার সামনে মাথায় মার্কিন কাপড়ে গিঁট দেয়া কাপড়ের বোঝা নিয়ে হাঁটতো মুটে।ভারবাহক। ছাতি থাকতো মালিকের মাথায়। সে সময় মেয়েরা ছিটের মানে ফুল লতাপাতা প্রিন্টের এবং ছেলেরা একরঙের জামা পরতো। আব্বা সামাদ চাচা সহ ঈদের বাজার করতেন। সিংহযানী ষ্টেশন রোড থেকে সেমাই, পোলাওর চাল আর কখনো গজ হিসেবে কাপড় কিনে মন্তাজ ভাইকে দিয়ে বাসায় পাঠাতেন। মন্তাজ ভাই সাইকেলের পেছনে সেগুলো বেঁধে বাসায় আসতেন। আমি হিমসাগর গাছের নিচে খালি পায়ে দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকতাম যতক্ষণ না আব্বার রিক্সা বা ঐ সরু মন্তাজ ভাইর শরীর দেখা যায়। কি যে একটা অবস্থা! ঈদ তো না এগিয়ে আসছে এরকম অনেক অনেক দম বন্ধকরা মুহূর্ত!
আম্মার একটা সিঙ্গার সেলাই কল ছিল। দেখতে কালোরঙের হাতির শুঁড়ের মতন । তাতে আবার সোনার রঙে ডোবানো তুলি দিয়ে নকশা করে লেখা। ডানে গোল রূপালি চাকার মধ্যে কাঠের হ্যান্ডেল। হ্যান্ডেলের নিচেই আয়তক্ষেত্র আকারের কালো স্টিলের ঢাকনা দেয়া একটা কম্পার্টমেন্ট। ওটাতে পেন্সিল, মাপার ফিতে, বাড়তি সুতোর ‘ববিন’। রূপালি স্টিলের ববিনগুলোয় জামার রঙে মিলিয়ে সুতো ভরার সময় মাঝে মাঝে আমরা হ্যান্ডেল ঘোরাবার সুযোগ পেতাম। সে যে কি আনন্দ যেন এক খেলা।
নতুন কাপড়গুলো সাদা জলে ধুয়ে মাড় ছাড়িয়ে রোদ দিলে ঐ কাপড়ের কাছে ঘোরাঘুরি করতাম। শুকানো মাত্রই তার থেকে তুলে মেঝেতে বিছানো বেতের পাটিতে  রাখতাম। সেখানে মেশিন মানে সেলাইর কল, কাপড়ে দাগ দেবার মোটা পেন্সিল, কাঁচি ও মাপার ফিতে রাখাই আছে। আব্বা বাসায় থাকলে ওঁরা দু’জনেই  পরামর্শ করে জামার স্টাইল ঠিক করতেন। কিছুতেই আলট্রা মডার্ণ যাতে না হয়। ততক্ষণে কুয়াতলা পেরিয়ে জানালা দিয়ে রোদ এসে পড়তো সিলেটী পাটিতে। আমি সেই যে কাপড়  কেনার পর তার পিছু নিয়েছি তা আর ছাড়তাম না। সেলাইর সময় কাপড়ের অন্য প্রান্ত ধরে টানা দেয়া, এটা ওটা এগিয়ে দেয়া, রান্না দেখে আসা এসবের জন্য আমি লেগে থাকতাম।কাটা এক টুকরো কাপড়ও ফেলতাম না, লুকিয়ে রাখতাম। ঈদের আগে খেলতে আসা বন্ধুদের কেউ যেন টের না পায় কি রকম হবে আমার ঈদের জামা! জামাটা অন্য বন্ধুদের কারো মতো না হওয়াই ছিলো একটা বিগ ডিল। 
এবার আসি রান্নার কথায়। এ সময় আম্মা মাঝে মাঝে উঠে রান্না ঘরে কষা মাংস দেখে আসতেন। কখনো আমাদের বলতেন চুলোর মাংস নেড়ে দিতে। বড় ঈদে ঝাল মাংস, কাবাব ও ঝুরা মাংসের ফব পিঠা আর ছোট ঈদে সেমাই জর্দা, নারকেলের ফব, মুরগীর কোরমা হতোই হতো। তখনো চটপটি চিনি না, দইবড়া খাইনি, কেক বা আইসস্ক্রিমের প্রশ্নই আসে না।  আমি বলতাম, একটা নোনতা ঈদ  আরেকটা মিঠা ঈদ। দু’ঈদে দু’রকমের গন্ধে ম ম করতো  আমাদের মাছের পিঠরঙা টিনশেড রান্না ঘর। 
একবার আম্মা কোরবানীর  ঈদে মাংস পাতলা পাতলা টুকরো টুকরো করে নুন মেখে তারে গেঁথে শুকিয়ে রেখেছিলেন। কিছুদিন পরে  তা রান্নার আগে গরম পানিতে ভেজানোর পর কূয়োপাড়ের পেঁপে গাছের নিচেপরা  কচি পেঁপে শিলে থেতো করে মশলা সহ মাখিয়ে রেখেছিলেন। তারপর কাটা মশলা দিয়ে  মাখা মাখা করে রান্না করেছিলেন। আর সে রান্না আমাদের পাতে দেবার আগে বলছিলেন, আইজ তুমরা গোস্ত’র হুকোইন খাইবায়। মাসের শুটকি তো সব সময় খেতাম। সেবার মাংসের খেলাম।  ফ্রিজ ছাড়া প্রিজার্ভেশন আর কি! আরো কথা আছে তা হলো নোনতা ঈদে প্রায়ই পরতাম রিসাইকেল জামা আর মিঠা ঈদে নতুন কাপড়ের। কোরবানীর ভাগের মাংসেই  বেশ কিছু অর্থ চলে যেতো। সরকারী সৎ অফিসার বলে আব্বা, তরফদার সাহেবের নাম ছিল। আমি নিজেও শিশুচোখে কিছু কিছু ব্যাপার দেখেছি। সে গল্প আরেকদিন বলবো। আবার ঈদের গল্পে যাই।
একটা ঈদের  কথা মনে পড়ছে। হয়তো সেটা নোনতা ঈদ ছিলো। আমার বয়স পাঁচ। আমরা তখন ময়মনসিংহ শহরে থাকি।  কলেজ রোডের উপর টকটকে লাল এক টানা বারন্দায় আম্মার মেশিন, মানে সেলাইর কল রাখা। আম্মা তার একটা পুরানো জংলি ছাপা জর্জেট শাড়ি কেটে বিস্তর কুঁচি দিয়ে নাচের ড্রেসের মত একটা লংস্কার্ট বানিয়ে নিয়েছেন। উর্ধবাস হাল্কা গোলাপী সাটিনের থ্রি কোয়ার্টার হাতা এক সর্ট টপ। সেটাও আম্মার পুরানো কামিজ কাটা কাপড়ে। এবার যখন তারই একটি টুকরোয় একটা ওয়েস্ট কোট হলো, এ ম্যাজিক রূপান্তর দেখে আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। তারপরও কিছু বিস্ময় বাকি ছিলো। সে সময় বিদেশী পুরানো কাপড়ের মার্কেট বসতো ট্রাঙ্ক্ররোডে। সেখানে জামাগুলো থেকে খোলা ইলাস্টিক, পুঁতি, পাথর আলাদা করে বিক্রি হতো। পিয়নভাইর মাধ্যমে  আম্মা কিনে আনালেন ছোট ছোট গোল আয়না। তার সংগে এলো লাল প্লাস্টিকের রিং। এর মধ্যে ঢুকিয়ে কি কায়দা করে যে আয়না বসিয়ে দিলেন সেই ওয়েস্ট কোটে! বললেন, অইলো তোর ইরানী ড্রেস! আমার বুদ্ধিমতি মায়ের করা সে জামাগুলো দেখে বন্ধুরা বুঝতেই পারত না এর রহস্য। আর আমার? ঈদের জামাটা বন্ধুদের কারো মতো না হলেই হলো!
আব্বা জামালপুর বদলী হবার আগে আমরা নারায়নগন্জ আমলা পাড়ায় ছিলাম ও গার্লস স্কুলে পড়তাম। তখন বিপ্লবী হেনা দাস আমাদের হেড টিচার ছিলেন। আমার বয়স হবে এগারো টেগারো। আমার আবৃত্তি করা, মঞ্চ সাহস ইত্যাদি দেখেই কিনা জানিনা আপা আমাকে আমাদের গার্লস গাইডদের মার্চ পাস্টের সময়ে সবার অগ্রে গেঁথে দিলেন। আমি ভাবলাম সেল্যুটের জন্য আমার উচ্চকিত কন্ঠটা জরুরী। সেখানে পায়ে পরতাম ছেলেদের কেডস। তবে আমাকে নাকি ‘ফ্যাশন’ শব্দটি বল্লেই সব পরানো যেত। বিনা দ্বিধায় আমি ভাইয়ার ছোট হয়ে যাওয়া নটি বয় স্যু পরি। আমার কোন সমস্যা নেই।
নারায়নগঞ্জে থাকতে আমার ছোটখালা- খালামনি তার টুকটুকে কন্যা রাজীকে নিয়ে সদ্য লন্ডন বেড়িয়ে এসেছেন। রাজী যা পরে সব লন্ডনের, বিলেতের সাদা ছেলেমেয়ের পোশাক। তখন মেয়েদের জামা মানেই ফুলের প্রিন্ট। কিন্তু হা হয়ে দেখি রাজী মাঝে মাঝে ছেলেদের মত পোশাকও পরে! আব্বা বল্লেন, ইতা বিলাতর ফ্যাশন। তুই পিনতেনি? আমি আনন্দে বলি, অয় পিন্তাম। লন্ডনে রানীর কন্যা প্রিন্সস এ্যান্ যে আমার চেয়ে ইকটু বড় সেও ছেলেদের প্যান্ট শার্ট পরে। আম্মার সামান্য অল্টারেশনে ভাইয়ার ট্রাউজার শার্ট পরে মহানন্দে খালামনির বিলেতী ক্যামেরার সামনে দ্বিধাহীন দাঁড়িয়ে গেলাম।
অনেক পরে বুঝেছি, সততার সরকারী কর্মচারির বাড়িতে এভাবেই ঈদ আনতে হয়! আমি সে ইরানী ড্রেস পরে সেখানে মঞ্চে উঠেছি, নজরুল জয়ন্তীতে রুম ঝুম ঝুম রুম ঝুম ঝুম/ খেজুর পাতায় নুপূর বাজায় নেচেছিলাম। আর উরনি উড়িয়ে ঘুরুল্লা দিলেই জামার ঘের চারিদিকে গোল হয়ে ঘুরতে থাকলে নিজেকে পরী মনে হচ্ছিল। তাই ঘুরতে ঘুরতে এমন চক্কর মারছিলাম করেছিলাম যে আমাকে থামানো যাচ্ছিল না। 
কিন্তু জামালপুরেই - আরো বড় হলে মনে পড়ে ক্লাশ নাইনে পড়ার সময় - আমার ঈদের জামার ডিজাইনটা এলো পাকিস্তা্নী হিট ছায়াছবি ‘আরমান’ ছবির নায়িকা জেবার মতো। বোট নেক টেডি কামিজ। কথাকলি হলে সিনেমা হলে ‘আরমান’দেখে লম্বা জুলপিওলা ওয়াহিদ মুরাদের চেহারা দেখে আমরা পাগল হয়ে গেলাম। আমি, মন্টি সেইসব জামা পরে বকুল তলা দিয়ে দর্পভরে হেঁটে গেলে ছেলেরা ক্রিকেট খেলা্র বোলিং থামিয়ে গাইতো, “একেলে না যা না… হামে ছোড় করতুম… “। কিন্তু ও টুকুই ছিল সে সময়ে গার্ল কলিং বা ইভ টিজিং এর ধরন। 
সেখানে আম্মার সেলাইয়ে খুব নাম ছিল। ফ্রেমে বাঁধানো ক্রস স্টিচের কাজের জন্য জামালপুর বাৎসরিক বানিজ্য মেলায় তিনি প্রতিবার ‘আপওয়া’র স্টলে পুরস্কার পেতেন।  আপওয়া মানে অল পাকিস্তান উইমেন্স এসোসিয়েশন। কিন্তু তিনি কোন পুরস্কার নিজে নিতেন না। কারণ তখন কোন নারীই ওভাবে জনতার মঞ্চে উঠে নিজ কৃতিত্ব প্রদর্শন করতেন না। কেন তা জানতাম না। কিন্তু তাঁর নাম ঘোষনা করা মাত্র আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে হুটোপুটি পড়ে যেত কে আনবে এসডিওর সঙ্গে হ্যান্ড শেক করে সে পুরস্কার!
সাত আট বছরের সময় ফেনীতে থাকার সময় ঈদে পেলাম প্রথম স্পঞ্জের স্যান্ডেল। আমার বয়স ছিল ছয় কি সাত। আজ থেকে ষাট বছর আগের কথা। তখন স্লিপার শব্দটাই ছিলো না। সবাই বাসায় খড়ম পরতাম আর খটর খটর করে ঘুরে বেড়াতাম। মেয়েদের খড়মের বেল্টে লাল নীল ফুলের তেল পেইন্ট, ছেলেদেরটা শুধু রিক্সার টায়ারের কালো বেল্ট। 
ফেনীতে থাকার সময় আব্বা রোজার মধ্যে অফিসের কাজে ঢাকা গিয়েছিলেন, ফিরে এলেন ঈদের বাজার নিয়ে। সবাই তাঁকে ঘিরে বসেছি। ট্রাঙ্ক থেকে একটার পর একটা জিনিষ বেরুচ্ছে আর আমি হা হয়ে যাচ্ছি। মুখ গহব্বর সব চেয়ে বড় হয়ে গেল যখন দেখলাম তিন ফুটোওলা পা সাইজের জোড়া জোড়া রাবার ও লাল নীল হলুদ ও সবুজ স্ট্র্যাপ হাতে নিয়ে বললেন, এর নাম স্পঞ্জের স্যান্ডেল, জাপানীজ। যাও তেল না অইলে সাবন আর পানি আনো গিয়া। আমরা ম্যাজিক দেখবার আগে যেমন হুড়াহুড়ি পড়ে যায় তেমন লাগিয়ে দিলাম। আব্বা লাল ফিতাজোড়া হাতে নিয়ে তার তিন দিকের তিনটি গুটলিতে সাবান ফেনা লাগিয়ে  একেকটি সাদা কিরিকিরি সোলের ওপর যে তিনটি ফুটো আছে তাতে একে একে পুঁ…চ পুঁ…চ পুঁ…চ করে ঠেলে দিতেই চার জোড়া স্যান্ডেল বনে গেল!
ঈদের দিন নতুন জামা আর দুই স্ট্র্যাপের নীল স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে আমার ডাঁটই বেড়ে গেল! বাড়ি বাড়ি দুধ সেমাই আর পরোটা খাবার পর স্যান্ডেলে ধুলা লেগেছে কি লাগেনি চট করে স্যান্ডেল সহ পা ভেজাই। বলি, যত ইচ্ছা পানিতে চুবাও কিচ্ছু হবে না, এটা বাজে চামড়ার না। পানিতে চুবানোর পর হাঁটতে গেলে পায়ের তলার ঘর্ষনে ঈঁদুরের মত স্কুইজি শব্দ করে। আমার ভাগ্যে ঈর্ষান্বিত একজন তা হাত দিয়ে দেখতে চাইলে আমি অবহেলা ভরে খুলে দিতেই সে নাকের কাছে ধরে বলে, কি পচা গন্ধরে বাবা! আমি টান মেরে ফেরত নিয়ে গর্বভরে বলেছিলাম, হবে না? এটা তো জাপান থেকে এসেছে তাই এতে জাপানী খাবারের গন্ধ! তখন সুশি কাকে বলে তাও জানতাম না। বুঝতাম ওদের খাবারটায় নিশ্চয়ই ভিন্ন গন্ধ থাকে। যেমন আমাদের ঈদের কোরমা পোলাওয়ে, পায়েসে পিঠায়।
সবাই ঈদের শুভেচ্ছা নিন ও সীমিত পরিসরে ঈদ করুন। আর কোন প্রিয়জন না হারিয়ে যদি সবাই বেঁচে যাই তবে একদিন নিশ্চয়ই অনেক ভাল ঈদ হবে। 
লন্ডন
২১.৭.২১
শামীম আজাদ: সিনিয়র সাংবাদিক, লেখক ও কলামিস্ট