ইয়েমেন: ২০১১ সালের গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন যে নারী
অনলাইন ডেস্ক
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০৬:৫৩ পিএম, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ সোমবার
ইশরাক আল-মাকতারি
মিশর আর তিউনিসিয়ার গণঅভ্যুত্থানে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০১১ সালের জানুয়ারিতে ইয়েমেনেও শুরু হয়েছিল পরিবর্তনের দাবিতে তরুণ ইয়েমেনিদের বিক্ষোভ। কিন্তু ইয়েমেনে সেই বিক্ষোভ চাপা পড়ে গিয়েছিল পরবর্তীকালের যুদ্ধ আর মানবিক দুর্যোগে।
যারা সেই বিক্ষোভে যোগ দিতে সেদিন পথে নেমেছিলেন তাদের একজন ইশরাক আল-মাকতারি। তিনি এখন ইয়েমেনের তায়েজ শহরের একজন আইনজীবী ও নারী অধিকার কর্মী।
তিনি তার দুই শিশুকন্যাকে নিয়ে প্রথম দিনের বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন। সেই বিক্ষোভ ছিল ইয়েমেনের নারীদের জন্য আত্মপ্রকাশের এক নজিরবিহীন সুযোগ।
২০১১ সালের ২৭ জানুয়ারি। আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তখন পরিবর্তনের দাবিতে যে গণঅভ্যুত্থান চলছিল - তার ঢেউ এসে পৌছালো ইয়েমেনে।
রাজধানী সানার রাস্তায় নেমে এলো হাজার হাজার মানুষ। এই বিক্ষোভেই পরবর্তীকালে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন দীর্ঘদিন ধরে শাসনক্ষমতায় থাকা আলি আবদুল্লাহ সালেহ।
ইশরাক আল-মাকতারি বলেন, ‘ইয়েমেনের পরিস্থিতি তখন অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে যখন প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করলেন, তিনি তার নিজের পুননির্বাচন এবং তার ছেলেকে তার উত্তরাধিকারী করার জন্য সংবিধানে সংশোধনী আনবেন, তখন বহু তরুণ যুবক বিক্ষোভে যোগ দিচ্ছিল। দুর্নীতি আর মুদ্রাস্ফীতিও তখন বেড়ে গিয়েছিল।’
ইশরাক আল-মাকতারি ছিলেন ইয়েমেনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় তায়েজ শহরের একজন আইনজীবী ও নারী অধিকার কর্মী। ওই শহরটি ছিল প্রধানত শিক্ষিত লোকদের শহর, এবং ইয়েমেনের সাংস্কৃতিক রাজধানী-আর পরে তা পরিচিত হয়েছিল বিপ্লবের সূতিকাগার হিসেবে।
তিনি বলেন, ‘ওই বৈপ্লবিক বিস্ফোরণ তখন অভাবনীয় কিছু ছিল না। আর আরব বসন্তের ঘটনাবলী তাকে আরো উস্কে দিয়েছিল - যা ঘটেছিল জানুয়ারি মাসে তিউনিসিয়া ও মিশরে।’
২০১১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি খবর ছড়িয়ে পড়লো যে মিশরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক পদত্যাগ করেছেন - তখন ইয়েমেনিরাও অনুভব করলেন যে একটি নতুন ভবিষ্যতের সম্ভাবনা তাদের হাতের নাগালে।
ইশরাক বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছিল রাস্তায় বেরিয়ে যাই। হোসনি মুবারকের যদি পতন হতে পারে, তাহলে তো ইয়েমেনি প্রেসিডেন্টেরও পতন হওয়া সম্ভব। তখন সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার মত বাজে। আমি আমার ছোট দুই মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম।’
ইশরাক ছিলেন সেদিন রাতের ওই বিক্ষোভে যোগ দেয়া খুব অল্প কয়েকজন নারীর অন্যতম। যে নারীরা এসেছিলেন, তাদের মধ্যে একমাত্র ইশরাকই ছিলেন ট্রাউজার পরা, এবং তার মুখ ছিল খোলা। যে পোশাক বেশীর ভাগ ইয়েমেনিরা পরতেন - ইশরাক সেরকম কালো আবায়াও পরেননি।
তিনি আরও বলেন, ‘আমার এখনো আমার বড় মেয়ের কথা মনে আছে। একজন বিক্ষোভকারী তাকে তার কাঁধে বসিয়ে নিয়েছিল। তাদের শ্লোগান শুনে সে খুবই উত্তেজিত হয়েছিল। জনগণ এই শাসকচক্রের পতন চায়। তবে নিরাপত্তা বাহিনীর কথা ভেবে মনে একটা ভয়ও কাজ করছিল।’
ইশরাক বলেন, ‘নিরাপত্তা বাহিনী নজর রাখছিল। বিক্ষোভকারীদের নাম টুকে রাখছিল তারা। আমার মনের মধ্যে যেরকম একটা আশাবাদ কাজ করছিল তেমনি, এটা স্বীকার করতেই হবে যে সাথে সাথে এক রকম ভয়ও করছিল। আমার দুটি ছোট ছোট মেয়ে, তাদের দায়িত্ব তো আমারই। কারণ সেদিন রাতে তাদের বাবা প্রদেশের বাইরে এক জায়গায় গিয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘আমরা বাড়ি ফিরলাম ভোর তিনটার সময়। সাধারণ ইয়েমেনিদের কাছে এটা ছিল রাস্তায় রাত কাটানোর মতই অস্বাভাবিক ঘটনা।’
সারা ইয়েমেন জুড়ে বিক্ষোভ এবং অবস্থান ধর্মঘট দানা বাঁধতে লাগলো। সমাজের সর্বস্তরের সব মত-পথের ইয়েমেনিরা এতে যোগ দিতে লাগলেন।
তার মধ্যে ছিল উত্তরের একটি বিদ্রোহী আন্দোলন - যাদের বলা হতো হুতি। এই হুতিদের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট সালেহ অন্তত ৬ বার যুদ্ধ করেছেন।
এই অস্থিরতার মধ্যে হুতি বিদ্রোহীরা ইয়েমেনের উত্তরাঞ্চলের সা'দায় তাদের নিয়ন্ত্রণ সংহত করতে সক্ষম হলো।
অন্যদিকে তায়েজে বিক্ষোভকারীরা একটি অবস্থান কর্মসুচি পালন করছিল - যে জায়গাটি পরিচিত হয় ফ্রিডম স্কোয়ার নামে। এটা ছিল ইয়েমেনের নারীদের জন্য তাদের উপস্থিতি জানান দেবার এক অভূতপূর্ব সুযোগ।
ইশরাক জানান, দ্বিতীয় দিন থেকেই অনেক নারাী বিক্ষোভে যোগ দিতে লাগলো। এর মধ্যে ছিল আইনের ছাত্রী, ও সাংবাদিকরা, তার পর নারী শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষকরা যোগ দিলেন।
এটা ছিল এক বিরাট ব্যাপার। তরুণী নারীরা চাইছিলেন, ইয়েমেনের নতুন প্রস্তাবিত সংবিধান রচনায় তাদের ভুমিকা থাকতে হবে। এবং মোটের ওপর বলতে গেলে তাদের প্রতি যথেষ্ট সম্মান দেখানো হয়েছিল।
বিক্ষোভকারীরা নিজেদের সংগঠিত করলেন। তাদের রাজনৈতিক দাবির পাশাপাশি দেশে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা বলছিলেন তারা।
ইশরাক বলেন, ‘আমি নারী অধিকার সংশ্লিষ্ট ইস্যু নিয়ে কাজ করছিলাম। তাই বিক্ষোভকারীদের তাঁবুগুলোর ভেতরে আমি কিছু কোর্স করাচ্ছিলাম - আমার অভিজ্ঞতা নিয়ে স্বেচ্ছাসেবকদের সাথে কথা বলছিলাম। মানুষ তখন মানবাধিকার সম্পর্কে জানতে চাইতো।’
কয়েক সপ্তাহ পর পরিস্থিতি খারাপ দিকে মোড় নিলো। বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে উঠলো নিরাপত্তা বাহিনী।
মার্চের ১৮ তারিখ ছিল শুক্রবার - দিনটির নাম দেয়া হয়েছিল মর্যাদা দিবস। সেদিন রাজধানী সানায় সেনাবাহিনী এবং প্রেসিডেন্ট সালেহর অনুগতরা বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। তাতে নিহত হয় ৫০ জনেরও বেশি লোক।
তায়েজ শহরেও ফ্রিডম স্কোয়ারে বিক্ষোভকারীদের ওপর আক্রমণ চালায় সেনাবাহিনী । তাতে নিহত হয় প্রায় ২০ জন। বিক্ষোভকারীদের তাঁবুগুলো পুড়িয়ে দেয়া হয়।
কিন্তু প্রতি শুক্রবারেই বিক্ষোভকারীরা ফ্রিডম স্কোয়ারে ফিরে আসতো।, সেখানে নামাজ পড়তো। ২০১১ সালের ১১ই নভেম্বর মাসে সরকারি বাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর মর্টারের গোলাবর্ষণ শুরু করলো। নিহত হলো তিন জন মহিলা সহ ১৩ জন।
ইশরাক বলেন, ‘কেউ ভাবতেই পারেনি যে মহিলারা যেখানে আছে এরকম একটা জায়গায় কেউ মর্টারের গোলাবর্ষণ করতে পারে। আমি সবচেয়ে বেশি ভয় পেয়েছিলাম আমার বোনের কথা ভেবে। সে তখন ওই স্কোয়ারে ছিল। আমি সেখানে গেলাম।’
তিনি আরও বলেন, ‘খুব ভয় করছিল। কারণ তখনো গোলাবর্ষণ চলছিল। আমার মনে আছে আমি স্কোয়ারের পার্শ্ববর্তী বাড়িগুলোর দেয়াল ঘেঁষে হাঁটছিলাম। তাঁবুগুলোর ওপর গুলি এসে পড়ছিল। আমার চোখের সামনেই।’
ইশরাক তার বোনকে খুঁজে পাননি। তখন তিনি হাসপাতালে গেলেন।
তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে আসার সাথে সাথে সেখানেও গোলাবর্ষণ শুরু হলো। আমাদের সবাইকে মাটির নিচের তলায় পাঠিয়ে দেয়া হলো। আমাদের মাথার ওপর ইট-সুরকি এসে পড়ছিল। আমি ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম, কাঁদছিলাম । কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কারণ হাসপাতালের ওপর গোলাবর্ষণ করা হচ্ছিল। নারী ও শিশুরা আহত হয়েছিল। সেই দৃশ্য এখনো আমার চোখে ভাসে। এতে শাসকগোষ্ঠীর ওপর আমাদের রাগ আরো বেড়ে গেল।’
প্রেসিডেন্ট আলি আবদুল্লাহ সালেহ তখন একটি বোমা হামলায় আহত হবার পর চিকিৎসার জন্য সৌদি আরবে গিয়েছিলেন।
নভেম্বর মাসের শেষ নাগাদ তার প্রতিবেশী দেশগুলো তাকে পদত্যাগ করতে রাজী করায় এই শর্তে যে তাকে কোন রকম বিচারের সম্মুখীন হতে হবে না। এর মধ্যে দিয়েই তার ৩৩ বছরের শাসনকাল শেষ হয়।
ইশরাক বলেন, ‘যেদিন তিনি পদত্যাগ করে তার ডেপুটির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা ঘোষণা করলেন - এটা ছিল এক ক্রান্তিলগ্ন। আমরা আনন্দিত হয়েছিলাম কিন্তু সে আনন্দ সম্পূর্ণ ছিল না। আমাদের আশা ছিল যে পুরোনো শাসকগোষ্ঠী সম্পূর্ণভাবে অপসারিত হবে।’
প্রেসিডেন্ট সালেহ তার ডেপুটি আবদ-রাব্বো মানসুর হাদির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। তিনি তার পর ২০১২ সালে একটি প্রতিদ্বন্দ্বীবিহীন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করলেন।
কিন্তু সাধারণ ইয়েমেনীদের জন্য তেমন কোন পরিবর্তন হলো না। দুর্নীতি, খাদ্য নিরাপত্তার অভাব অব্যাহত ছিল, তা ছাড়া সরকারের ক্ষমতাশালী পদগুলোতে সালেহর অনুগত অনেকেই রয়ে গিয়েছিলেন।
২০১৪ সালে হুতি বিদ্রোহীরা তাদের উত্তরাঞ্চলীয় ঘাঁটি থেকে অভিযান শুরু করলো, এবং এক পর্যায়ে তারা রাজধানী সানার নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হলো।
বিস্ময়ের ব্যাপার হলো - এই হুতি বিদ্রোহীদের পেছন থেকে সমর্থন দিয়েছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট আলি আবদুল্লাহ সালেহ। প্রেসিডেন্ট হাদি ২০১৫ সালে দেশ ছেড়ে পালালেন।
সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন একটি সামরিক কোয়ালিশন হুতি বিদ্রোহী ও সালেহর জোটের বিরুদ্ধে বিমান থেকে বোমাবর্ষণ শুরু করলো। যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রয়াসে কোন কাজ হলো না।
সেই যুদ্ধ এখনো চলছে।
ইশরাক বলেন, ‘এই যুদ্ধের সাথে সেই বিপ্লবের প্রকৃত লক্ষ্য যা ছিল, তার সাথে কোন সম্পর্কও দেখি না, সেই বিপ্লবের জন্য কোন অনুশোচনাও বোধ করি না।’
ইশরাক আল মাকতারি বলেন, ‘আমার বিশ্লেষণ হলো, ইয়েমেনের সামরিক বাহিনীর গভীরে সালেহর অনুগতদের শিকড় রয়েছে, এবং তাদের আন্তর্জাতিক সমর্থনও আছে। সালেহ এবং হুতিরা মিলে যে সা'না দখল করলো - সেটা ছিল তার শত্রুদের ওপর প্রতিশোধ - যারা এই শাসকচক্রের পতনের আহ্বান জানাতে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসেছিল এবং বর্তমান ব্যবস্থার পরিবর্তন চেয়েছিল।’
২০১৫ সাল থেকে ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে ১ লক্ষের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে - সেখানে দেখা দিয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুতর মানবিক সংকট।
ইশরাত আল মাকতারি এখন একজন বিচারক এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি সরকারি কমিটির সদস্য। যাদের কাজ মানবাধিকার লংঘন তদন্ত করা।
তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে তিনি ইয়েমেনেই থাকবেন, এবং দেশের জন্য তার পক্ষে যা করা সম্ভব করে যাবেন।
ইশরাক বলেন, ‘ঘরে বাইরে বেরিয়ে এসে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলাম আমার সন্তানদের প্রজন্মের জন্য। কিন্তু তাদের ভবিষ্যৎ এখনো অস্পষ্ট। আমি আমার ছেলে-মেয়েদের সাথে তাদের হতাশা নিয়ে অনেক কথা বলি। কিন্তু ভবিষ্যতের চিত্র ভালো কিছু নয়।’
তিনি বলেন, ‘আমার দুঃখ হয় যে আমাদের ২০১১ সালের আকাঙ্খা ছিল - সামনের পথ হবে কুসুমাস্তীর্ণ, কিন্তু ২০১৪ সালের পর দেখছি আমাদের জীবনটা আসলে একটা মাইন-পাতা পথে পরিণত হয়েছে।’