শ্লোক: বাল্মীকি, রুমি ও শামস আল তাবরিজ
মাহমুদা পারভীন
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০৯:৫৯ পিএম, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ সোমবার
সংগৃহীত ছবি
দুর্ধর্ষ ডাকাত রত্নাকরের কবলে পড়েছেন এক দেবর্ষি। সবকিছু লুটে নিয়ে দেবর্ষিকে হত্যা করতে গেল সেই ডাকাত।দেবর্ষি তখন ডাকাতের কাছে জানতে চাইলেন কেন ডাকাত এই মহাপাপ করছে?
ডাকাত উত্তরে বললো, বাবা মা, স্ত্রী, পুত্র, কন্যার প্রতিপালনের খরচ যোগাড় করার জন্যই এই কাজ করছে সে।
এবার দেবর্ষি প্রশ্ন করলেন–‘রে পাপিষ্ঠ!! তোর পরিবার কি এ মহাপাপের অংশীদার হবে?’
দস্যু রত্নাকর বলে –‘অবশ্যই হবে।’
দেবর্ষি বললেন, ‘আমার উপর আস্থা রাখতে পারিস, আমি পালিয়ে যাবো না। তুই এই ফাঁকে বাড়ি গিয়ে একবার জেনে আয় সত্যিই তোর পরিবার এই পাপের দায়ভার নেবে কি না।’
রত্নাকর বাড়ি গেল এবং বিমর্ষ হয়ে ফিরে এসে জানালো, তার পরিবার কোনোভাবেই এই পাপের দায় নেবে না!
এ ঘটনার পর ভয়ংকর ডাকাত রত্নাকরের চৈতন্য উদয় হলো। সে দেবর্ষির পায়ে পড়ে এই মহাপাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় জানতে চাইল। দেবর্ষি তাকে কায়মনোবাক্যে মন্ত্র জপ করার আদেশ দিলেন। আদেশ মতো রত্নাকর ষাট হাজার বছর তপস্যা করে এই পাপ থেকে উদ্ধার পেল।
এই দীর্ঘ সময় ধরে তপস্যা করতে করতে রত্নাকরের সারা শরীর মাটির ঢিপিতে প্রায় ঢেকে গিয়েছিলো। মাটির ঢিপির আরেক নাম বাল্মীক। তাই রত্নাকর ডাকাতের নতুন নাম হলো ‘বাল্মীকি’। নতুন জীবন পেয়ে বাল্মীকি তমসা নদীর তীরে গভীর বনে বেড়াতে গেলেন। সেখানে তিনি দেখলেন ক্রৌঞ্চ এবং ক্রৌঞ্চী এই দুইটি পাখি গভীর মমতায় একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। কিচির মিচির শব্দে তারা কি যেন বলছে। এ সময় এক শিকারীর তীরে বিদ্ধ হয়ে ক্রৌঞ্চ রক্তাক্ত হলো। মাটিতে লুটিয়ে পড়লে পাখিটি। এ সময় ক্রৌঞ্চীর আর্ত চিৎকার আর বিলাপে বাল্মীকির হৃদয় গভীর বেদনায় আচ্ছন্ন হলো। বাল্মীকির মুখ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিম্নলিখিত শ্লোক উচ্চারিত হলো:
‘মা নিষাদ! প্রতিষ্ঠাং স্ত্বমগমঃ শাশ্বতী সমাঃ।
ষত ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবদীঃ কামমোহিতম্।’
বাল্মীকির হৃদয়ে জাগ্রত গভীর শোক থেকে এই চরণ দুইটি উচ্চারিত হয়েছে বলেই এর নাম হয়েছে শ্লোক। অর্থাৎ শোক থেকে শ্লোক। কথিত আছে এই শ্লোকই পৃথিবীর প্রথম কবিতা।
××× ×××
এর অনেক অনেক দিন পর তুরস্কের কোনিয়াতে মওলানা জালালুদ্দিন রুমি নামের এক সাধারণ শিক্ষকের আবির্ভাব হয়। একদিন রুমি তাঁর ঘরে রাজ্যের বইপত্রে ডুবে পড়াশোনা করছিলেন। এমন সময় শামস আল তাবরিজ নামে এক ক্ষ্যাপাটে লোক এসে সব বইপত্র পাশের জলাশয়ে ফেলে দিলেন। তারপর রুমিকে বললেন-‘শুধু বই পড়লেই জ্ঞানী হওয়া যায় না। বইয়ের জগতের বাইরেও প্রচুর জ্ঞান আছে।’
রুমি এই আগন্তুক ক্ষ্যাপাটে লোকের আরও কিছু অলৌকিক কর্মকাণ্ড দেখে বিস্মিত হলেন। তিনি শামস আল তাবরিজের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন।
জানা যায়, রুমি এই তাবরিজের সাথে চল্লিশ দিন ধরে আধ্যাত্মিক সময় কাটান। তাবরিজের কাছ থেকে চল্লিশটি সূত্র বা শ্লোক আয়ত্ত করেন রুমি। কথিত আছে তাবরিজের কাছ থেকে পাওয়া এই চল্লিশটি শ্লোকের কল্যাণেই পরবর্তী সময়ে রুমি জগৎ এবং জীবনকে ভালোবেসে কবি এবং সাধক হয়ে উঠেন।
শামস আল তাবরিজের এই চল্লিশটা শ্লোক "Forty rules of love" নামে বিখ্যাত। মুম রহমান এই শ্লোকগুলো বাংলায় অনুবাদ করেছেন অসীম মমতা দিয়ে। জলধি প্রকাশন এই অনুবাদ থেকে একটা বই প্রকাশ করেছে ‘ভালোবাসার ৪০ সূত্র’ নামে।
কয়েক মাস ধরে এই বই আমার নিত্যসঙ্গী। এই বইয়ের এক একটি সূত্র, এক একটি উপলব্ধি। মুম রহমানের প্রাঞ্জল অনুবাদ পাঠকের সামনে খুলে দিয়েছে এক আধ্যাত্মিক অনুভবের অনন্য দ্বার।
শুভ সন্ধ্যা। আসুন পাপ থেকে বিরত থাকি এবং ভালোবাসতে শিখি। সকলের মঙ্গল হোক।