ঢাকা, সোমবার ২৫, নভেম্বর ২০২৪ ১০:৩১:৫৪ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

একজন অদম্য প্রতিবন্ধী মহুয়ার উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প

নিজস্ব প্রতিবেদক

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৮:০৪ পিএম, ১৫ নভেম্বর ২০২১ সোমবার

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

জন্ম থেকেই প্রতিবন্ধী বগুড়ার মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস মহুয়া। প্রতিবন্ধিতার কারণে খুব ছোট থেকেই নিদারুণ কষ্ট আর দুর্ভোগের মাঝে জীবনের চাকা ঘুরছে তার। শারীরিক বিকলাঙ্গতা তার বাস্তবতা হলেও মানসিকভাবে তিনি স্বপ্ন দেখেন আকাশ ছোঁয়ার। সেই স্বপ্নকেই একটু একটু করে বাস্তবে রূপ দিচ্ছেন কাপড়ে সুঁই-সুতার কারুকাজ করে। গত ৪ বছর আগে একা নারীদের পোশাকে সেলাইয়ের কাজ শুরু করে মহুয়া আজ সফল নারী উদ্যোক্তা। এই কাজের মাধ্যমে তিনি শুধু নিজের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটাননি আরো ৩৫ নারীকেও আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করেছেন। মহুয়া স্বপ্ন দেখছেন ঘরের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে একটি কারখানা স্থাপনের, যেন প্রতিবন্ধী এবং অসহায় নারীরা স্বাবলম্বী হতে পারেন।

মহুয়ার ব্যক্তি জীবন ও পরিবার: মহুয়ার বাড়ি বগুড়া শহরের চকলোকমান এলাকার খন্দকার পাড়ায়। তার বাবা আব্দুল মজিদ ছিলেন ব্যাংকের কর্মকর্তা। মা ছাহেরা বেগম গৃহিণী। তারা দুই ভাই এক বোন। বড় ভাই গোলাম মোস্তফা ঢাকার ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির লেকচারার এবং মেজ ভাই মোহাম্মদ আলী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। প্রতিবন্ধীর জীবন নিয়েই তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা বেঁচে থাকা পর্যন্ত তার চিকিৎসা করিয়ে গেছেন। তার বাবা সব সময় চেয়েছেন তাকে স্বাভাবিক রাখতে। পড়াশোনা করাতে। তার মা-ও তাকে সব ধরনের যত্ন নিয়ে বেড়ে তুলেছেন। স্কুল-কলেজে পড়ার সময় তার মা তাকে হুইল চেয়ার ঠেলে প্রতিদিন নিয়ে যেতেন এবং আনতেন। ঘুম থেকে উঠার পর আবার ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত তার মা-ই ভরসা। ২০১২ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে গোল্ডেন এ প্লাস পান। এরপর বগুড়া শাহ সুলতান কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর ইংরেজি সাহিত্যে আযিযুল হক কলেজ থেকে অনার্স শেষ করে এখন মাস্টার্সে অধ্যয়ন করছেন।

মহুয়ার পেশাগত জীবন: ২০১৬ সালে অনার্স প্রথম বর্ষে থাকাকালীন সময় তিনি নিজের হাত খরচ চালানোর জন্য অফলাইনে (লোকাল এরিয়া) থ্রিপিসে সেলাইয়ের ফোঁড় তুলতে শুরু করেন। এরপর ২০১৭ সালে ফেসবুকের মাধ্যমে অনলাইনে শুরু করেন নিজের হাতের কাজ করা শাড়ি থ্রিপিস বিক্রি। সে সময় তিনি একা হলেও বর্তমানে তার সঙ্গে আরো ৩৫ জন নারী কাজ করছেন। এই নারীদেরকে তিনি নিজেই কাজ শিখিয়েছেন। কাজ শেখার পর তারা কাজ নিয়ে বাড়িতে বসে সেলাই করেন। কোনো সমস্যা হলে আবারও মহুয়ার কাছে গিয়ে দেখে নেন। এছাড়া তিনি আরো নারীদেরকে কাজ শেখাচ্ছেন যাতে করে তারাও স্বাবলম্বী হতে পারেন। তার অধীনে কাজ করা একজন নারী একটা থ্রিপিসে সেলাই করে মজুরি পান ৩৫০-৪০০ টাকা, শাড়িতে কাজ করে পান ৭শ থেকে ১ হাজার টাকা। কাজ করা এসব থ্রিপিস মহুয়া ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন ১৮০০ থেকে ২৫০০ টাকা এবং শাড়ি ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকায়। প্রতি মাসে তার ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকার মতো শাড়ি-থ্রিপিস বিক্রি হয়। তবে উৎসব এলে তার বিক্রি লাখ টাকা ডিঙিয়ে যায়। ২০১৭ সাল থেকেই তিনি হাতের কাজ করা শাড়ি-থ্রিপিস মূলত বিক্রি করেন ফেসবুকের মাধ্যমে। ফেসবুকে তার Rainbow রংধনু নামে একটি পেজ আছে। এই পেজে গেলেই তার পণ্যের ছবি এবং বিস্তারিত পাওয়া যাবে। এছাড়া ফেসবুকের উই গ্রুপের সঙ্গেও মহুয়া যুক্ত আছেন। উই গ্রুপের মাধ্যমে বাংলাদেশসহ বিশ্বের আরো ১৭টি দেশের প্রবাসী বাংলাদেশি এবং সেখানকার স্থানীয়দের কাছে পণ্য বিক্রি করেছেন। গত ১ বছরে ৯ লক্ষাধিক টাকার পণ্য বিক্রি করেছেন মহুয়া উই গ্রুপের মাধ্যমে।

মহুয়ার স্বপ্ন:
 প্রতিবন্ধীদের জন্য কিছু একটা করার স্বপ্ন নিয়ে পরিকল্পনানুযায়ী এগোচ্ছেন মহুয়া। যে কারণে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও ৪ বছর আগেই ব্যবসায় নেমে পড়েন তিনি। ৪ বছর ধরেই তিনি সাধ্যানুযায়ী টাকা জমাতে শুরু করেছেন। তিনি চান প্রতিবন্ধীদের জন্য এমন একটা সংস্থা করতে যে সংস্থার মাধ্যমে প্রতিবন্ধীরা কিছু অনুদান পাবে এবং তাদের লেখাপড়ার খরচ চালাতে পারবে। মহুয়া মনে করেন, অধিকাংশ প্রতিবন্ধীর পরিবার তাদের লেখাপড়া করাতে চায় না। প্রতিবন্ধীরা যদি লেখাপড়া করে শিক্ষিত হয় তাহলে তাদেরকে আর কেউ অবহেলার চোখে দেখবে না। তারাও কাজ করতে পারবে। এখন তো বিশ্বায়নের যুগ। এখন ঘরে বসেও অনলাইনে কাজ করা যায়। তাই তিনি এরকম একটি পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন।

মহুয়ার সহকর্মীদের কথা: মহুয়ার হ‌য়ে কাজ করছেন শেরপু‌রের রো‌জিনা আক্তার, সোহাগী এবং আঁ‌খি। তারা জানান, মহুয়ার সঙ্গে কাজ কর‌তে পে‌রে তারা খু‌শি। কারণ মহুয়া খুব শান্ত এবং খুব ভা‌লো ক‌রে শি‌খি‌য়ে দেন। মহুয়ার কারণে তারা বাড়িতে ব‌সে অর্থ উপার্জন কর‌তে পার‌ছেন।

মহুয়ার বক্তব্য: আমার মা ছাড়া আমাকে দেখাশোনার কেউ নেই। সকালে ঘুম থেকে জাগার পর ঘুমানোর আগ পর্যন্ত মাকে ছাড়া কোনো কিছু কল্পনা করতে পারি না। তবে মা-র বয়স হয়েছে। মা আর কতদিন এভাবে আমাকে দেখবেন। এই বিষয়টি আমার খুব খারাপ লাগে। তবে হতাশা এখন খুব একটা কাজ করে না। কারণ আমার পরিবারের সবাই আমাকে খুব ভালোবাসে। আমার যত্ন নিতে সবাই খুব উদগ্রীব। মহুয়া বলেন, ২০১৬ সালে প্রাইভেট পড়িয়ে এবং অফলাইনে ব্যবসা করে কিছু টাকা জমিয়েছিলাম। সেই টাকা দিয়ে একটি স্মার্টফোন কিনি। স্মার্টফোন কেনা আমার জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয়। কারণ ফোনের মাধ্যমে ফেসবুক ব্যবহার আরো সহজ হয়। ফেসবুকের মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপে মেয়েদের কাপড়ের বিজনেস দেখি। তখন নারীদের জন্য পোশাকে সেলাইয়ের কাজ করে বিক্রির বিজনেসটা আমার জন্য সহজ হয়ে যায়। প্রথম দিকে ওড়না, থ্রিপিস, শাড়ি দিয়ে ব্যবসা শুরু করি। এখন ওয়ান পিস, বিভিন্ন শাড়ি, বিছানার চাদর, কুশন কভার, সোফার কভারসহ আরও অনেক পণ্য নিয়ে কাজ করছি। এছাড়া আগে শুধু সুতি কাপড়ে কাজ করতাম। এখন পণ্যের গুণগত মানের কথা মাথায় রেখে কাপড়ের বৈচিত্র্য নিয়ে এসেছি। কুমিল্লার খাদি, রাজশাহীর মসলিন, সিল্কসহ মোটামুটি সব ধরনের পণ্য রয়েছে। মহুয়া আরো বলেন, তার নিজের বাড়ি বগুড়া শহরে হলেও তিনি বর্তমানে শেরপুরের ছোনকা বাজার এলাকায় ভাড়া বাসাতে মাকে নিয়ে থাকেন। সেখানকার নারীদেরকে দিয়েই তিনি শাড়ি, থ্রিপিসে সেলাইয়ের কাজ করান। ভবিষ্যতে ছোনকা বাজারেই কারখানা দেওয়ার ইচ্ছে আছে তার। ঢাকাতে এক‌টি শোরুম দি‌তে চান তি‌নি।

মহুয়ার মা ছাহেরা বেগম কি বলছেন: মেয়ে প্রতিবন্ধী। কষ্টে তার বুক ফেটে যায়। অনেক চিকিৎসা করানোর পর তারা আত্মসমর্পণ করেছেন। এখন মেয়ে অনলাইনে ব্যবসা করছে। উপার্জন করছে। নিজের জীবনযাপনের খরচ নিচে উঠাচ্ছে, পাশাপাশি অন্য অসহায় নারীদেরও উপার্জনের ব্যবস্থা করছে এসব কারণ থেকে তিনি শত কষ্টের মাঝেও খুশি। তিনি সব রকম পরিস্থিতিতে তার মেয়ের সঙ্গে আছেন বলে জানান এবং সকলের কাছে তার মেয়ের জন্য দোয়া চান।

/