ঢাকা, সোমবার ২৫, নভেম্বর ২০২৪ ২১:১৬:৩২ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

‘তাহারেই পড়ে মনে’: তপতী বসু

তপতী বসু

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০২:০৭ এএম, ২১ নভেম্বর ২০২১ রবিবার

বেগম সুফিয়া কামাল

বেগম সুফিয়া কামাল

সেদিন ছিল শ্রাবণের ধারার মতন বর্ষা৷ প্রাথমিক বিদ্যালয়টি বাড়ির কাছেই হওয়ায় নিতান্তই অসুখ না করলে রোজ হাজিরার একজন ছিলাম৷ মেঘের জলভরা অন্ধকার  দিয়ে ঘেরা মাটির ঘরে কাঠের বেঞ্চিতে বসে আমরা কয়েক জন৷ সামনে প্রধান শিক্ষক আবদুল হাই, আমার জীবনে প্রিয়তম শিক্ষকদের একজন৷ স্যার সেদিন বাংলা পড়িয়েছিলেন কবিতা—‘পল্লীস্মৃতি’৷
‘বহুদিন পরে মনে পড়ে আজি পল্লী মায়ের কোল,
ঝাউশাখে যেথা বনলতা বাঁধি হরষে খেয়েছি দোল

....
কল্পপূরীর স্বপনের কাঠি বুলাইয়া শিশু চোখে
তন্দ্রদোলায় লয়ে যেত মোরে কোথা দূর ঘুমলোকে
ঘুম হতে জেগে বৈশাখী ঝড়ে কুড়ায়েছি ঝরা আম
খেলার সাথীরা কোথা আজ তারা? ভুলিয়াও গেছি নাম।’

 ...
সেদিন সেই বর্ষা আর কবিতা এতোটাই হৃদয় মথিত করেছিল, যে বাড়ি ফিরে সবটা একবারে মুখস্থ করে নেই এবং আগের বছরের পড়া ‘আজিকার শিশু’ কবিতাটাও মনে আছে কিনা ঝালিয়ে নেই৷ এই কবির ডাক নাম ‘হাসনা বানু’ যা তাদের পরিবারে প্রচলিত ছিল৷ তার ভাইয়া ডাকতেন ‘হাচুবানু’ বলে; কেউ কেউ বলতো ‘হাসুবানু’! আমাদের সবার কাছে তিনি পরিচিত ‘বেগম সুফিয়া কামাল’ নামে৷
১৯১১ সালে হাসুবানু' জন্মগ্রহণ করেন৷ তৎকালীণ সময়ের নিয়মেই তার লেখাপড়ার হাতেখড়ি মায়ের কাছে৷ এরপর নিজ চেষ্টায় তিনি হয়ে ওঠেন স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত। 
১৯১৮ সালে তিনি মায়ের সঙ্গে কলকাতা যান। সেখানে তার সাক্ষাৎ হয় বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এর সঙ্গে।রোকেয়া তাকে নিজের স্কুলে ভর্তি করতে চাইলেও নানা কারণে তা হয়নি৷
কলেজে তার লেখা ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতাটি পড়ি৷ জানতে পারি স্বামীর অকাল মৃত্যুতে ব্যথিত এক দয়িতার স্মৃতি এই কবিতার প্রেক্ষাপট৷ খুব অল্প সময় যিনি ছিলেন তার জীবনে, কিন্তু গড়ে দিয়েছিলেন এক সুবিশাল জীবনের বিচরণ মনোভূমি!যুবকের নাম ‘সৈয়দ নেহাল হোসেন’!
১৯২৩ সালে মামাতো ভাই নেহাল হোসেনের সাথে তার বিবাহ হয় এবং জীবনের দৃষ্টিভঙ্গী বদলে দেয়৷ সৈয়দ নেহাল ছিলেন  সময়ে থেকে অনেকটা আধুনিক৷ তিনি স্ত্রীকে পড়তে সাহায্য করেন৷ পড়ালেখা ছাড়াও তিনি বেগম সুফিয়া কামালকে সমাজসেবা ও সাহিত্য সাধনায় উৎসাহ যোগাতে থাকেন। 
বিয়ের পরে সেন্ট জেভিয়ার্স-এ পড়ার সময় সৈয়দ নেহাল হোসেন সস্ত্রীক কলকাতার তালতলায় এক বাসায় থাকতেন। কলকাতায় অবস্থান করার সুযোগে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল, শরত্‍চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে তিনি পরিচয় করিয়ে দেন স্ত্রীকে৷
রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা ও আশীর্বাদ বাংলা সাহিত্যে তাকে একটি স্থায়ী আসনে অধিষ্ঠিত করে। রবীন্দ্রনাথের সাথে তার প্রথম সাক্ষাৎ হয়, যখন সুফিয়ার বয়স মাত্র ১৭/১৮। প্রথম পরিচয়ের পর কবির জন্মদিনে তিনি কবিতা লিখে পাঠালেন। কবিও তাকে কবিতায় উত্তর দিলেন। তারপর তাদের সাক্ষাৎ এবং চিঠি আদান-প্রদান হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণের পর ১৯৪১ সালে কলকাতার নাগরিক শোকসভায় সুফিয়া কামালকে স্বরচিত কবিতা পাঠ করার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল!
বিয়ের পর স্বামী নেহাল হোসেনের সাহস ও সহযোগিতা পেয়ে ১৯২৯ এর ডিসেম্বর মাসে তিনি বিমানে ওঠেন। বিমানের নাম ‘লেডী জ্যাকসন’, পাইলট মি: ওয়ার্নার। মাত্র একজন যাত্রী নিয়ে পাইলট আকাশে উড়ে কলকাতা শহর ও আশেপাশের স্থানগুলো ঘুরে দেখাতেন। এই দুঃসাহসের জন্যে সমাজ তাকে শুভেচ্ছা না জানালেও পাশে ছিলেন নেহাল এবং বেগম রোকেয়া৷
১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে সুফিয়ার জীবনে নেমে আসে নিদারুণ বিষাদের ছায়া।সেই সময়ের এক দুঃসাহসী-আধুনিক এবং প্রেমিক স্বামী নেহাল হোসেন আক্রান্ত হলেন দুরারোগ্য ক্ষয়রোগে। স্বামীর সেবা শুশ্রূষায় সুফিয়া রাতদিন অতিবাহিত করতে লাগলেন। বোম্বে, মাদ্রাজ, নৈনিতাল ঘুরে ফিরে হাওয়া পরিবর্তন করেও রোগ উপশমের কোন লক্ষণ দেখা গেল না। শেষে অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে চলে এলেন শায়েস্তাবাদের বাড়িতে। শত চেষ্টায়ও নেহাল হোসেনের জীবন রক্ষা করা গেলো না। মাত্র ২৬ বছর বয়সে ১৯৩২ সালের ১৯ ডিসেম্বর তিনি মারা যান। 
স্বামীর অকাল মৃত্যুতে সুফিয়ার জীবনে নেমে আসে চরম দুর্যোগ ও দুর্ভোগ৷ তারপর অনন্ত যুদ্ধের পর হাসুবানু হয়ে ওঠেন -‘বেগম সুফিয়া কামাল’! কিন্তু নেহাল হোসেনের কথা কোনোদিন ভুলে যাননি৷ নানা কাজের ভিড়ে, শ্রদ্ধা বা নিজ সম্মানের চরমক্ষণেও বলেছেন-‘তাহারেই পড়ে মানে’...।
১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর সুফিয়া কামালের মৃত্যু হয়৷ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয় তাকে৷ বাংলাদেশী নারীদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই সম্মান লাভ করেন। 
২০১৯ সালের ২০ জুন তার ১০৮তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে গুগল ডুডল তৈরি করে সম্মাননা প্রদান করে।
আজ বেগম সুফিয়ার মৃত্যুদিনে—‘তাহারেই পড়ে মনে’!

তথ্য এবং ছবি
উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া৷

# তপতী বসু, লেখক। দিল্লি৷ গৌতম নগর৷