ঢাকা, সোমবার ২৫, নভেম্বর ২০২৪ ১৯:৪৭:২৪ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

একজন  জীবনানন্দ ও প্রাসঙ্গিক কথা

তপতী বসু

উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০২:৩৪ এএম, ১ ডিসেম্বর ২০২১ বুধবার

ছবিঃ ঢাকায় বিবাহ বাসরে কবি ও কবিপত্নী৷

ছবিঃ ঢাকায় বিবাহ বাসরে কবি ও কবিপত্নী৷

চুনিলাল নামের এক চা বিক্রেতা তাঁর দোকানের সামনে ট্রামের ধাক্কায় একজন পথচারীকে আহত দেখতে পান৷ প্রথমবার নিজেকে সামলাতে পারলেও দ্বিতীয় ধাক্কাটায় তিনি ট্রাম লাইনে পড়ে যান! তাঁর হাতে ধরা ছিল সবুজ ডাব, জীবনের প্রতীক৷ যা তখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে ধুলো আর কিছুটা রক্ত মাখা৷ঘটনাটা এতটাই অভাবনীয় যে চুনিলাল প্রথমে হকচকিয়ে যান৷  নিজেকে সামলে তিনি ছুটে আসেন৷ সাহায্য করার জন্য দৌড়ে আসেন আশেপাশের পথচারী৷তাঁদের সহযোগিতায় আহত মানুষটিকে ধরাধরি করে "শম্ভুনাথ পন্ডিত" হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়৷। চিকিৎসক তাঁকে পরীক্ষা করে দেখেন তার শরীরে নিউমোনিয়া। এক সপ্তাহ পরেই তিনি মারা যান৷  

খুব দ্রুত সবাই জানতে পারেন তিনি 'জীবনানন্দ'! বাংলাদেশের প্রকৃতি ও নির্জনতার প্রতি একনিষ্ঠ একজন কবি ৷ চলে যান মানুষের নির্মম আচরণকে সঙ্গে নিয়ে৷তাঁর হাত ধরেই প্রকৃতি প্রেমিকের পরিচয় প্রকৃতির সাথে৷ কবিতা লিখে বুঝিয়েছেন শব্দ দিয়ে কী ভাবে ভালোবাসা যায় ধানসিড়ি-রূপসার ঘোলাজল-সোনালি ডানার চিল-নুইয়ে পড়া চালতার ডাল...আরো কত কিছুকে!

১৮৯৯ সালে ১৭ ফেব্রুয়ারি বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন, তখন তাঁর  ডাক নাম  "মিলু"! বাবা সত্যানন্দ দাশগুপ্ত ছিলেন বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলের শিক্ষক, আর মা কুসুম কুমারী লিখতেন কবিতা,গল্প..৷ জীবনানন্দ ছিলেন তাঁদের জ্যেষ্ঠ সন্তান৷  ভাই অশোকানন্দ এবং বোন সুচরিতা ৷ বাড়িতে মায়ের কাছেই তাঁদের বাল্যশিক্ষার সূত্রপাত।

কবির স্কুল জীবন শুরু হয় বরিশাল শহরের ব্রজমোহন স্কুলে৷ তিনি ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে সেখান থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি পরীক্ষায় পাস করেন। দু’বছর পর ব্রজমোহন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন প্রথম বিভাগে। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্র জীবন থেকেই কবিতা লেখা শুরু৷

বরিশাল শহরের প্রকৃতি  ছিল তাঁর সমস্ত শিরায় জড়িয়ে৷ সেখানকার পথ চলতেন আর  একের পর এক শব্দমালায় লিখতেন কবিতা৷ জীবনের আনন্দ খূঁজতে চেয়ে যিনি বাংলার বুকে ফিরে আসতে চেয়েছেন বারবার!

ভোরেরকাক-শঙ্খচিল-শালিক-কিশোরীর হাঁস যে কোনো রূপ ধরে! অন্ধকারেও কাঁঠাল পাতার নিচে ভোরের দয়েল দেখতেন৷ হাজার বছর পথ চলার আনন্দে বাংলার রূপকে ছূঁয়ে দেখতেন ৷ সেই রূপ, যা  প্রথম দেখেছিলেন  বরিশালের প্রকৃতিতে! লাজুক নীরবতার আড়ালে বেদনায় ধানসিড়ি নদীকে ছাড়তে চাননি  কোনোদিনও৷ আবার নির্জনে মগ্ন থাকায় ভ্রুক্ষেপ ছিল না যশ খ্যাতির প্রতি৷

তিনিই মনে হয়  অসংখ্য কবির মাঝে একমাত্র ,মৃত্যুর পরে যাঁর খ্যাতি এনে দিয়েছিল ৷  আঠারো লাইনের একটি কবিতা "বনলতা সেন"  —যা আজ পর্যন্ত পাঠকপ্রিয় এবং অন্যতম শ্রেষ্ট কবিতা হিসাবে পঠিত হবার জায়গা নিয়ে আছে!
         
চুনিলাল হাসপাতালে দিয়ে আসার পর সাথে ছিল কয়েকজন নবীন কবি৷ তারাই কাঁধে করে নিয়ে যায় শ্মশানে-শবানুগমনে ছিলনা হৈ হট্টগোল!বিদ্যুৎচুল্লি নয়, নিখাত চিতার আগুনে পঞ্চভূতে মিলিয়ে যায় দেহ, আবার আসার আশায়৷ বাংলার নদী মাঠ বা কিশোরীর লাল ঘুঙূর পায়ের হাঁস কেঁদেছিল কিনা-কে জানে?

তাঁরা কেঁদেছিলেন!সেই নবীন কবিদল, চিৎকার করে আবৃত্তিও করেছিলেন কবির কবিতা একটার পরে একটা! যেনো কে কতগুলো মুখস্থ করেছে, তারই প্রতিযোগিতা৷

সেই সব কবিতা! যেখানে ছড়িয়ে থাকতো বরিশালের প্রতি একনিষ্ঠ ভালোবাসার কথা৷ বরিশালই তাঁকে এক জনপ্রিয় কবির মর্যাদা দিয়েছিল৷ মৃত্যুর পরেও তিনি আসতে চেয়েছিলেন সেখানেই—।

কবির কবিতার এখন সর্বত্র যাতায়াত৷, সেই ২২ অক্টোবর মৃত্যুর পরেই জোয়ারের জলের মতন—চরাচর ভেসে যাওয়া চাঁদের আলোর মতই জীবনানন্দ দাশের কবিতারা বাংলা ভাষা, বাঙালি জনপদকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়! যে কবিতা তাঁকে আজও ছেড়ে যায়নি৷ অতিক্রম করতে পারেননি পরবর্তী কবি প্রজন্ম৷ বরিশালের কুসুম কুমারী দাশ আর মিলুর বাড়িটি আজ আর নেই৷ভাগকরা দেশের উৎপীড়ণে বদলে গেছে কত কিছু!

আছেও অনেক কিছু৷ সারা বাংলায় এপার থেকে ওপার ছড়িয়ে৷ ব্রজমোহন কলেজে পড়েছেন-পড়িয়েছেনও৷ কলেজ ক্যাম্পাসে আছে 'জীবনানন্দ ক্যাফে’-নামের ক্যান্টিন৷ আছে জীবনানন্দ দাশ পাঠাগার'৷ 'ধানসিড়ি' এখন ঝালকাঠি জেলায়৷ বনলতার নাটোর৷ কোলকাতায় আছে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতাল। বাংলা আকাদেমির মধ্যে ‘জীবনানন্দ সভাঘর’৷ রাস্তায় আবক্ষ মূর্তি৷

স্ত্রী লাবণ্যের সাথে স্মৃতিময় ঢাকার ইডেন-বিবাহ বাসর ব্রাক্ষ্ম মন্দির আজও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে৷ সব থেকে দাগ কেটে আছেন মানুষের মনে৷ একজন শিল্পীর  শিল্পকর্মে (রিক্সার অলংকরণ)৷

পাঠক তাঁর কবিতা সব থেকে বেশি পাঠ করেন৷ একমাত্র তিনিই এমন কবি-যাঁর স্মৃতি সব থেকে বেশি সংরক্ষিত দুই বাংলাতেই৷