ঢাকা, সোমবার ১৮, নভেম্বর ২০২৪ ১৯:৩৩:২৭ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

মন ভালো রাখে নির্মল হাসি

খালেদ ইমরান

উইমেননিউজ২৪.কম

প্রকাশিত : ০৩:৩৬ পিএম, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৭ বুধবার | আপডেট: ০২:৫৪ পিএম, ২ জানুয়ারি ২০১৮ মঙ্গলবার

শিশুর নির্মল হাসি মা-বাবার মনে প্রশান্তি যোগায়। হাসি মন-প্রাণকে সুস্থ্য রাখে। শিশুর মানসিক বিকাশে সহায়তা করে হাসি। হাসি নিয়ে গবেষণার অন্ত নেই। সেই আদিকাল থেকে হাসি নিয়ে গবেষণা করছেন গবেষকরা।


ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডাচের কেল্টনার বলেছেন, ‘হাসি আমাদের বিবর্তনের কেন্দ্র এবং মানব আচরণের শক্তিশালী অস্ত্রগুলোর একটি।’


তিনি গবেষণা করছেন হাসির বৈচিত্র্য ও প্রভাবসহ মুখের অভিব্যক্তির গুরুত্ব নিয়ে। হাসতে থাকা শিশুটি ঠিকই জানে, একটি স্বতস্ফুর্ত হাসি জ্ঞাতিত্ব তৈরিতে সাহায্য করে। হাসির কারণে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হয়। এর মাধ্যমে ইতিবাচক মস্তিস্ক রাসায়নিক অবমুক্ত হয়।

 

শিশু বিকাশের বিশেষজ্ঞরা শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের ইতিবাচক বিনিময়কে বলেন, ‘মিথস্ক্রিয়াগত নৃত্য’। হাসির প্রত্যুত্তরে শিশু হাসি দিলে বুঝতে হবে তার মস্তিস্কের বিকাশ ভালভাবেই ঘটছে। মা ও শিশুর মধ্যে হাসির বিনিময় হয় সাধারনত ছন্দবদ্ধ ও সমলয় গতিতে। শিশুর অনুরাগ ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জন্য এটি খুব জরুরি। এসব বলছিলেন শিশু বিকাশে বিশেষায়িত ভ্যানকুভার আইল্যান্ডের ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক উলরিশ মুয়েলার।


গবেষণার মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন যে, মা কিংবা বাবা সন্তানের হাসির উত্তর যদি অভিব্যক্তিহীন মুখে দেন তাহলে তার মন খারাপ হয়ে যায়। এতেই বোঝা যায়, যারা যত্নআত্তি করে, তাদের প্রকৃত হাসি শিশুর কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তার মতে, বিষন্ন মায়ের সন্তানেরা অবিষন্ন মায়ের সন্তানদের তুলনায় কম হাসে এবং সুখের লক্ষণগুলোও কম প্রকাশ করে।

 

১৮৭২ সালে চার্লস ডারউইন তার ‘দ্য এক্সপ্রেশান অফ ইমোশান ইন ম্যান এন্ড এনিম্যালস’ গ্রন্থে প্রস্তাব করেছিলেন, মুখের অভিব্যক্তির বিষয়টি জৈবনির্ভর এবং মানুষদের জন্য বৈশ্বিক। এটি বিবর্তনের সহায়ক। জ্ঞাতিত্ব ও বন্ধন তৈরি এবং সাহায্য ও সহযোগিতার উন্নয়ন ঘটিয়ে মানব প্রজাতির টিকে থাকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে।


সেলিব্রেটেড নৃবিজ্ঞানী মার্গারেট মিড লিখেছিলেন, হাসি হচ্ছে সাংস্কৃতিক আচরণ। সমাজভেদে এটি ভিন্ন হয়।



নানা হাসির নানা অর্থ। হাসির অর্থ সব দেশে এক নয়। এমনই বলছিলেন মার্গারেট মিড। কিন্তু তা মানতে রাজী ছিলেন না সান ফ্রান্সিসকোর মনোবিজ্ঞানী পল একম্যান। বিতর্কের ইতি টানতে মানুষের মুখের বিভিন্ন অভিব্যক্তির একগাদা ছবি নিয়ে পৃথিবী ঘুরতে বেরিয়ে পড়েন ১৯৬০’র দশকে। এগুলো তিনি দেখাতে থাকেন বিভিন্ন দেশের মানুষদের।

 

একম্যন ও তার সতীর্থ ওয়ালেস ফ্রিজেন আট বছর কাটিয়ে দেন মুখমণ্ডলের গতিশীলতার বর্ননা ও প্রতিলিপি তৈরির কাজে, যাতে করে গবেষকরা গবেষণা করতে পারেন। তারা মুখের ৪৩টি পেশীর আলাদা গতিশীলতা ও ৩ হাজার অর্থবহ সমন্বয়কে পদ্ধতিগতভাবে শ্রেণিভূক্ত করেন। পদ্ধতির নাম দেন ফ্যাসিয়াল অ্যাকশান কোডিং সিস্টেম, সংক্ষেপে এফএসিএম। এই এফএসিএম মুখের অভিব্যক্তি গবেষণায় আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। এর ভিত্তিতেই চিহ্নিত হয় ১৮ প্রকার হাসি। যার মধ্যে আছে লজ্জা, হতবুদ্ধি, বিদ্রুপ ও ভালবাসার হাসি।

 

কিন্তু গবেষকদের কাছে সবচে’ আকর্ষনীয় হচ্ছে স্বতস্ফুর্ত আনন্দের হাসি ও নকল হাসি। প্রথমটি ডুসেন (Duchenne) হাসি নামেও পরিচিত। ফরাসি নিউরোলজিস্ট ডুসেন ঊণবিংশ শতাব্ধীতে সর্বপ্রথম এই হাসির বর্ণনা দেন। এই ধরনের হাসির সময় দুই সেট পেশী কাজ করে। নকল হাসিকে গবেষকরা নাম দিয়েছেন ‘বিমানবালা’ হাসি। এর ব্যবহার হয় সৌজন্যতার খাতিরে। ডুসেন হাসিই প্রকৃত হাসি।



১৯৫৮ ও ১৯৬০ সালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়ারবুক-এর জন্য পোজ দিয়েছিল ১১৪ জন ছাত্রী। তাদেরকে লক্ষ্য বানিয়ে সোত্সাহে গবেষণায় নেমে পড়েন ডাচের কেল্টনার। ছবিতে তিনজন বাদে বাকি সবাই হাসছিল। কেল্টনার ও তাঁর সহকর্মী লীয়ানে হারকার প্রথমেই ১১১ জনের হাসিকে শ্রেণিভূক্ত করেন। এর মধ্যে ৬১ জন হেসেছিল নকল হাসি; বাকিরা ডুসেন হাসি। পরবর্তী ৩০ বছর তাদের অনুসরণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায় যে, ছবির ডুসেন হাসি দেয়া নারীরা নকল হাসি দেয়া নারীদের চেয়ে দাম্পত্যজীবনে বেশি সুখি। শারীরিক ও মাসসিক সুস্থতার পরীক্ষাতেও তাদের স্কোর তুলনামূলকভাবে ভাল।

 

কেল্টনার এরকটি গবেষণায় দেখিয়েছেন, কিছু লোক জন্মই নেয় তুলনামূলকভাবে বেশি খুশি থাকার মেজাজ নিয়ে। এই লোকগুলো জীবনে সাফল্যও পায় বেশি। অবশ্য প্রকৃত হাসি শিখে নিয়েও জীবনে সফলতা অর্জণ করা যায়। তাঁর মতে সংযোগ সৃষ্টি হাসি অনন্য। যে কারণে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের হাসাটা খুবই জরুরি।



হাসিমুখ বন্ধু তৈরিতেই শুধুমাত্র সহায়ক নয়, সাহায্য করে ভাল অনুভবেও। পল একম্যান এবং উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানী ডেভিড রিচার্ডসন ব্রেইন স্ক্যানের মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছেন ডুসেন হাসি আনন্দ ও সুখের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মস্তিস্কের কিছু অংশকে সক্রিয় করে। তাঁরা সিদ্ধান্তে উপনীত হন, ডুসেন হাসির পেশীগুলোকে কৃত্রিমভাবে সক্রিয় করতে পারলেও মস্তিস্তের সক্রিয়তা হবে একই রকম। সুখ ও সামাজিক যোগাযোগের জন্য হাসি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।