আয়েশার হার না মানা গল্প
নিজস্ব প্রতিবেদক
উইমেননিউজ২৪
প্রকাশিত : ০৮:৫৭ পিএম, ৪ ডিসেম্বর ২০২১ শনিবার
ফাইল ছবি
আয়েশা সিদ্দিকা, মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। বাবা-মা ও ছোট তিন বোনসহ ছয় সদস্যের সংসার তাদের। বাবা কাঠমিস্ত্রি, মা গৃহিণী। আয়েশার নানার পরিবারের থেকে দাদার পরিবার বেশ ছিলো সচ্ছল। নানা মারা যাওয়াই পূর্বে মা মানুষের বাসায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। মায়ের বিয়ের পর কিছুটা পরিবর্তন আসলেও দুই কন্যা জন্মের পর পুনরায় আয়েশার মায়ের স্থান হয় নানা বাড়িতে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আবার শুরু হয় আয়েশার মায়ের জীবন যুদ্ধ।
নানাদের পরিবার সচ্ছল না হওয়াই তাদের সাপোর্ট দেওয়া মতো কেউ ছিল না। তখন আয়েশার বয়স ৭/৮ বছর হবে। তার মা সারাদিন মানুষের বাসায় কাজ করে বাবার পাশাপাশি সাপোর্ট দিয়েছেন সংসারে। এইভাবে একটি ছেলের আশায় আরও ২ কন্যার জন্ম হয় আয়েশাদের পারিবারে।
এভাবেই কাটতে থাকে আয়েশার দিন। খুব কষ্ট করে অষ্টম শ্রেণি পাস করেন আয়েশা। তারপর থেকে টিউশন খুঁজতে থাকেন। অবশেষে ৫০০ টাকা বেতনের টিউশনও খুঁজে পান। কিন্তু ভাগ্য সহায় না হওয়াই ৩ মাস পড়ানোর পর বেতন পান একমাসের। এরপর নবম শ্রেণির শেষের দিকে ২ জন শিক্ষার্থী নিয়ে পুনরায় টিউশন শুরু করেন। এভাবে সবার সহযোগিতায় এসএসসি সম্পন্ন করেন আয়েশা। আয়ের পরিমাণ বাড়াতে টিউশনের পাশাপাশি হাতের কাজও শেখেন তিনি। এমন অনেক কাজ করে পার করেন উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি। সেই সাথে বোনদেরও পড়াশোনার খরচ চালাতে হতো তাকে।
আয়েশার স্বপ্ন ছিল ভালো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার। কিন্তু সেই সুযোগ হলো না তার। পরবর্তীতে শহীদ জিয়াউর রহমান কলেজের ম্যাডামের সহযোগিতায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির ফরম নিয়ে পরীক্ষা দেন তিনি। এখানেও ভাগ্য তার সহায় হলো না। সিট পেয়েও পরিবারের আর্থিক অবস্থার কথা চিন্তা করে অ্যাডমিশন নিতে পারেননি আয়েশা। পরবর্তীতে ২০১১ সালে ফুপুর দেবরের সহযোগিতায় তিন হাজার টাকা বেতনে ‘জে বটতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’র প্যারা শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন। আয়েশার জীবন কাহিনী শোনার পর স্কুল কর্তৃপক্ষ তার বেতন বৃদ্ধি করে দিয়েছিল।
আয়েশার ডিউটি ছিল সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত। তার বাসা থেকে বিদ্যালয় ছিল অনেক দূরে। প্রতিদিন যাতায়াত খরচ ৬০ টাকা। ভাড়া যদি ১৮০০ টাকা চলে যায় তাহলে থাকবে কী? সেই চিন্তা করে শুধুমাত্র ২০ টাকা যাতায়াত খরচে ব্যয় করতেন তিনি। এভাবে ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত রাতে একবেলা খেয়েই চলত তার জীবন। কেননা স্কুলে যাওয়ার সময় খাবার নেওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না তার। শুধুমাত্র হালকা নাস্তা খেয়ে দিন পার করতেন আয়েশা। এরউপর আবার স্কুল ডিউটির পর ৩টি টিউশন করে বাসায় ফিরতে হতো রাত ৯টায়।
অপরদিকে নিজে পড়াশোনার করার প্রতি আগ্রহও ছিল ব্যাপক। তাই পুনরায় কোথাও অ্যাডমিশন নেওয়ার চেষ্টা করলেন তিনি। এভাবে অনেক কষ্ট করে ডিগ্রিতে ভর্তি হয়েছিলেন আয়েশা।
তারপরেও যেন ভাগ্য যেন পিছু টানছিল আয়েশার। এবার শুরু হল তার জীবনে ঘুরে দাঁড়ানোর নতুন যুদ্ধ। একদিকে পড়াশোনায় নিজেকে টিকিয়ে রাখা অন্যদিকে পরিবারকে আরেকটু গুছিয়ে নেওয়া। আশপাশের লোকজন আয়েশার মাকে দিনরাত বলতে থাকে, মেয়েদের পড়িয়ে কী লাভ? ওদের বিয়ে দিয়ে দাও। কিন্তু তিনি হার মানেননি। এভাবে কর্মজীবনে ব্যস্ততা পার করে ডিগ্রি পাস করেন আয়েশা। সেই সাথে বোনদেরও সুশিক্ষায় গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালিয়ে যান তিনি।
কষ্ট করলেও তা কখনো বুঝতে দেয়নি আয়েশা। হঠাৎ ২০১৫ সালে ওই স্কুল থেকে তার চাকরিটাও চলে যায়। মাত্র ৩ মাস ঘরে থাকার পর অন্য প্রাইভেট স্কুলে পুনরায় চাকরি হয় তার। সেখানেও স্কুল কর্তৃপক্ষ সাপোর্ট করে আয়েশাকে। তাদের সহযোগিতা পেয়ে মাস্টার্স পাসও করে ফেলেন তিনি।
নিজের জীবনে গল্প বলতে গিয়ে আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, ‘২০২০ সালে যখন চারদিকে কোভিড-১৯ ভয়াবহ পরিস্থিতি, তখন খুবই ডিপ্রেশন চলে যাই। এক ম্যাডামের সহযোগিতায় ফেসবুক গ্রুপ উইতে (উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম) যুক্ত হই। এর কিছুদিন পরে ই-ক্যাবের রাজিব স্যারের সাথে কাকলী আপুর ছবি দেখলাম। দেখে ভাবলাম, আসলে ব্যাপারটা কী। বোঝার জন্য চেষ্টা করি। ধীরে ধীরে সময় দিতে থাকি গ্রুপে।’
‘এরপর হঠাৎ করে নতুন করে কাজ করার আগ্রহ জন্মালো। পরিকল্পনা করে হাতের তৈরি বেবি নকশিকাঁথা নিয়ে উদ্যোগ শুরু করি। রাজিব স্যারকে অনুসরণ করে পড়াশোনার গ্রুপ ডিএসবিতে (ডিজিটাল স্কিল ফর বাংলাদেশ) যুক্ত হয়ে সবার পোস্টগুলো পড়তে থাকি এবং ছোট ছোট কমেন্ট করা শুরু করি। এরপর শিক্ষণীয় বিভিন্ন টপিকে ১০ মিনিট রাইটিং এবং প্রেজেন্টেশন পোস্ট লিখতে শুরু করি। এভাবে উদ্যোক্তা জীবনে টিকে থাকতে বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘উদ্যোক্তা ও নিজেদের পড়াশোনায় টিকে থাকতে রাজিব স্যারের তৈরি রিডিং সিলেবাস পড়ে আমার উন্নতির কথা না বললেই নয়। রিডিং সিলেবাসের ফলে আমার ইংরেজি যে দুর্বলতা ছিল তা কাটিয়ে উঠতে পারছি। সেই সাথে আনন্দের বিষয় হলো, ২টি ইংলিশ মিডিয়ামের স্টুডেন্ট পেয়েছি।’
বর্তমানে আমার প্রতি মাসে আয় ১৭৫০০ টাকা। অপরদিকে ১০ মিনিট রাইটিং পোস্ট লেখার ফলে সিনিয়রদের ক্লাস নিতে গিয়ে খুব ভালোভাবে বুঝাতে পারি। এর ফলে আমার ক্যারিয়ারে এখন বেশ ভালো উন্নতি করতে পারছি।
‘এ ছাড়াও নিজের পরিশ্রম ও উদ্যোগের টাকায় ছোট বাসা থেকে আজ নিজের তৈরি সেমি পাকা বাড়িতে সুন্দরভাবে বসবাস করছি। পাশাপাশি আমার মেঝো বোন মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করে টিউশনির টাকায় সংসারে সাপোর্ট দিচ্ছে। আর এর ছোট বোন চট্টগ্রাম নাসিরাবাদ ওমেন কলেজে ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে অনার্সের পড়ছে এবং সবার ছোট বোন এবার বিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাধ্যমিক দিয়েছে। এগুলো একমাত্র সম্ভব হয়েছে ডিজিটাল স্কিল গ্রুপের জন্য।’